লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতদূর?
১৯ ডিসেম্বর ২০১৮![Bangladesch Wahlkommissar Mahbub Talukdar](https://static.dw.com/image/46807380_800.webp)
নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অপর চার জন নির্বাচন কমিশনারের মতবিরোধ এখন প্রকাশ্য৷ গত দু'দিন ধরে এটাই প্রধান আলোচনার বিষয়৷ ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনে তাঁর নিজ কার্যালয়ে সাংবাকিদের বলেন,‘‘আমি মোটেও মনে করি না নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে কিছু আছে৷ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কথাটা এখন একটা অর্থহীন কথায় পর্যবসিত হয়েছে৷''
কয়েকজন সাংবাদিকের লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে৷ আপনি এ কথার বিরোধিতা করছেন কেন? এমন আরেকটি প্রশ্নের জবাবে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘‘আমি কখনো তাঁর (সিইসি) বক্তব্যের বিরোধিতা করি না৷ তিনি তাঁর কথা বলেছেন৷ আমি প্রয়োজনে আমার ভিন্নমত প্রকাশ করি৷ আপনারা তো সাংবাদিক৷ আপনারা দেশের সব খবরাখবর রাখেন৷ সবকিছু দেখেন৷ আপনারা আপনাদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন নির্বাচনে এখন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কিনা, তাহলে উত্তর পেয়ে যাবেন৷''
পরেরদিন ১৮ ডিসেম্বর মাহবুব তালুকদারের এই কথার জবাব দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা৷ রাঙামটিতে তিন পার্বত্য জেলার আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই– নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের এমন বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত ও অসত্য৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে৷ নির্বাচনে ছোটখাটো কিছু সংঘাত হয়ে থাকে, সেটা তেমন বড় কিছু নয়৷ সেগুলো আবার স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক দল ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই সমাধান করছে৷''
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এই কথার জবাবে বুধবার (১৯ ডিসেম্বর) নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা ১৮ ডিসেম্বর রাঙামাটিতে বলেছেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলে আমি মিথ্যা কথা বলেছি৷ আমি তাঁর এই বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷ কারণ, এ কথা বলে তিনি একজন নির্বাচন কমিশনারের অস্তিত্বে আঘাত করেছেন৷ একটা কথা মনে রাখতে হবে, সিইসিসহ সব নির্বাচন কমিশনার সমান৷''
তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডেকে তিনি আরো বলেন, ‘‘ইতোপূর্বে সিইসি মহোদয় আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিরূপ উক্তি করেছেন৷ আমি কখনো তাঁর কথার প্রতিবাদ করিনি৷ কিন্তু নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই বলে আমি নাকি মিথ্যা কথা বলেছি– তাক্ষর এ কথার প্রতিবাদ না করে পারলাম না ৷ আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ১৭ ডিসেম্বর বলেছিলাম ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কি নেই সাংবাদিকরা নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর পেয়ে যাবেন৷ এখন আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলছি, আপনারা নিজেরা বিচার-বিবেচনা করে দেখুন৷ নিজেদের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে কি নেই৷''
এ নিয়ে মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও মানবাধিকার সংঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যখন একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরস্পরবিরোধী কথা আসে, তখন নিশ্চয়ই এর একটা ভিত্তি থাকে৷ এরা সবাই সম্মানিত ব্যক্তি৷ তাঁরা সাংবিধানিকভাবে কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন৷ তাঁরা যখন কথা বলেন তা আমাদের বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে৷ মাহবুব সাহেব যা বলছেন, সমতল ভূমি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি৷ আমাদের অভিজ্ঞতাও সেটা বলছে৷ সেক্ষেত্রে আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই প্রশ্ন করা উচিত যে, কোন ভিত্তিতে তিনি বলছেন যে মাহবুব সাহেব যা বলছেন, তা অসত্য৷''
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রাহমান কার্জন পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘‘কে সত্য বলছেন আর কে সত্য বলছেন না সেই বিবেচনার আগে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের একটি নাজুক নির্বাচন কমিশন দিয়ে কিভাবে ভালো নির্বাচন আশা করা যায়? মতভিন্নতা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটা এখন মতবিরোধে পরিণত হয়েছে৷ পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে কথা বলছেন৷ এটা খুবই খারাপ পরিস্থিতি৷ আমরা বিচার বিভাগেও এর আগে এই অবস্থা দেখেছি৷''
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপি'র ১৩ জন প্রার্থীর ওপর হামলা হয়েছে৷ আর বিএনপিসহ বিরোধী ৪জন সংসদ সদস্য আটক হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ কারাগারে পাঠানো হয়েছে দু'জনকে৷
অন্যদিকে নির্বাচনি সহিংসতায় আওয়ামী লীগের দুজন নিহত হয়েছেন৷ আহত হয়েছেন প্রায় একশ' নেতা-কর্মী৷ ঢাকায়ও মিরপুরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী কামাল আহমেদ মজুমদারের নির্বাচনি ক্যাম্পে হামলা হয়েছে মঙ্গলবার রাতে৷
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি'র দাবি, তারা এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না৷ ১৪ ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতীয় ঐক্যফন্টের আহ্ববায়ক ড. কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলায় এখনো কেউ আটক হয়নি৷ আওয়ামী লীগ অবশ্য দাবি করছে, বিএনপি নিজেদের ওপর নিজেরা হামলা চালিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্ট করতে চাইছে৷
সুলতানা কামাল বলেন,‘‘সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে৷ এবার নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করছে, তাই আমরা আশা করেছিলাম যে, নির্বাচন উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ হবে৷ কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে সহিংসতার আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন মহল৷ আর যাদের এটা দেখার কথা, সেই নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না৷''
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, এক পক্ষের ওপর হামলা বেশি হচ্ছে৷ আর তাদের অভিযোগগুলো তেমন আমলে নেয়া হচ্ছে না৷ নির্বাচন কমিশন প্রত্যাশিতভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷ ফলে সাদা চোখে আমরা যা দেখি এবং বুঝি, তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠা করা যায়নি৷''
আর শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘নির্বাচনে সহিংসতা আমাদের রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হয়েছে৷ সেটা আমাদের পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানেও হয়৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটা বন্ধে নির্বাচন কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ ফলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলতে আমরা যা বুঝি, তা দেখছি না৷ তবে আরো একটি কথা, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণেও বিএনপি কোথাও কোথাও মাঠে নামতে পারছে না বা নামছে না৷ এই দু'টো মিলেই পরিস্থিতি নাজুক হয়েছে৷ আমি একপক্ষকে দোষ দিতে রাজি না৷''