বৈশাখে মেলা বসে ছোট্ট নদীর ধারে, কিংবা বটতলায়। বাহারি সব নামও থাকে সেইসব মেলার। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সে ‘বৈশাখি মেলা' হারাতে বসেছে তার লোকায়ত রূপ।
বিজ্ঞাপন
মাটি, বাঁশ, বেত আর সূতার কাজে যে মানুষগুলোর মুন্সিয়ানায় তৈরি হতো ‘লোক ও কারু শিল্প', সে মানুষেরাও আজ লড়ছেন অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। বৈশাখি মেলায় মানুষকে বিনোদন দিতো যে নাগরদোলা, লাঠিখেলা, বাঁশিখেলা, পুতুলনাচ, লোকসংগীত, যাত্রা, পালাগান কিংবা বায়োস্কোপ- সবই আজ বিলীনপ্রায়।
নদীর ধরে সাজানো সারি সারি শখের হাঁড়ি। কুমারদের গড়া সেই হাঁড়ি আজ মৃতপ্রায় নদীর মতোই সংকটে। সেই শখের হাঁড়ির মোটিফগুলো তখনকার কৃষিভিত্তিক সমাজের। শখের কেন? কারণ, ওর মধ্যে সৌখিন জিনিস ভরে মেয়ের বাড়িতে পাঠাতেন বাবা। এর সাথে আবার যোগ রয়েছে আমন ধানের। এই ধানের সাথেই বাড়তি ধান হিসেবে যে উৎপাদিত হতো ‘আউশ' ধান। সে আউস ধান বিক্রি করে যা পাওয়া যেত, তার অধিকার মেয়ের। আউশ থেকে হাউস, অর্থাৎ শখ। সে অর্থ দিয়ে বাবা শখের হাঁড়ি কিনে মেয়ের বাড়িতে পাঠতেন। মজার বিষয়, ঈদের সময় বেশি বিক্রি হতো এই শখের হাঁড়ি। ঈদগা'র পাশেই কুমারেরা পসরা সাজিয়ে বসতেন শখের হাঁড়ির।
নদী অববাহিকাতে এভাবেই গড়ে উঠেছে এই ব-দ্বীপের হাজারো বছরের গৌরবগাথা ‘লোক ও কারু শিল্প'। শখের হাঁড়ি, পট চিত্র, কাঠের পুতুল, হাত পাখা, জামদানি কিংবা টেপা পুতুল –এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের রুচির বহি:প্রকাশ।
কাঠে চিত্রিত পুতুল, হাতি, ঘোড়া গড়েন শিল্পী বীরেন্দ্র সূত্রধর। এই শিল্প নিয়ে তিনি ঘুরে এসেছেন নেপাল আর শ্রীলঙ্কা। দেশের মেলাগুলোর পরিচিত মুখ বীরেন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘‘যে পুতুল, বাঘ আমি গড়ি, তার মূল্য পাই না। চাইনিজ পণ্যে এখন বাজার ছেয়ে গেছে। বড় বড় কারুজ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে যান। কিন্তু টাকা বাকি রাখেন। যে বাঘটি আমি গড়ি তার জন্য পাই পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু চারুকলার কোনো শিল্পী যদি এটা তৈরি করেন, তাহলে তিনি পান লাখ টাকার ওপর'। বীরেন্দ্র জানান, পেট চলে না, তাই তিনি কাঠ পুতুলের পাশাপাশি রান্নার সামগ্রীও বিক্রি করেন।
শখের হাঁড়ি শিল্পী মৃত্যুঞ্জয় পালের হতাশাও একইরকম। বাবা সুশান্ত কুমার পালের উত্তরাধিকার মৃত্যূঞ্জয় বলছেন, ‘‘ইট-কাঠের অট্টালিকায় এখন আর ঠাঁই হয় না শখের হাঁড়ির।'' তাই তিনি এখন শখের হাঁড়ির পাশাপাশি মাটির নিত্য পণ্যও তৈরি করেন।
গাইবান্ধার রঘুনাথ চক্রবর্ত্তীর শিষ্য রতন পালের পটচিত্রে উঠে আসে গাজির পট, মনসা রামায়ন আর মহাভারত। ১৪ বছর ধরে গুরুর কাছে পটচিত্র আঁকা শিখেছেন। ১৬ বছর ধরে নিজে আঁকছেন। তবু এই শিল্পের মানুষটির ঘর-সংসার চলে না। তার আক্ষেপ, ‘‘এই শিল্পের কদর নেই।''
নারায়নগঞ্জের হোসনেআরা নকশী কাঁথা বোনেন। ফুল, পাখি, প্রাণী আর মানুষের মুখ ফুটিয়ে তোলেন কাঁথায়। তিনি তার তিন মেয়েকেও এই শিল্প শিখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, হোসনেআরা তার গ্রামের নারীদেরও শেখাচ্ছেন নকশী কাঁথা বোনা। তাতে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তৃপ্তি নিয়ে হোসনেআরা বলেন, ‘‘শেখাতে পারার আনন্দের তুলনা হয় না।''
পঁচিশ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করেন বাসন্তী সূত্রধর। শ্বাশুড়ি'র কাছ থেকে শিখেছেন। এই হাত পাখা বিক্রিতেই চলে তার সংসার। নকশাও তারাই তৈরি করেন। একটা ভালো পাখা তৈরিতে সারাদিন লেগে যায়। সূতা আর নকশাভেদে একটা পাখার দাম দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা।
জামদানি কারিগর ইব্রাহিম মিয়ার নকশাটা থাকে তার মাথায়। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘যে কোনো নকশা একবার দেখলে তুলে ফেলতে পারি।'' সে নকশায় যে অপরূপ জামদানি বুনেন ইব্রাহিম৷ কিন্তু সেগুলোও খুব একটা বিক্রি হয় না। চিকন সূতার একটা ভালো জামদানি শাড়ি তৈরিতে তার মাস চলে যায়। আঠারো হাজার টাকা দামের সে জামদানির ক্রেতা নেই।তাই বেশির ভাগ জামদানি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে।
রিকশা পেইন্টার এসএ মালেক চল্লিশ বছর ধরে এই শিল্পের সাথে জড়িত। বাবার কাছ থেকে শিখেছেন এই ‘পপুলার আর্ট'। এখন এই শিল্প পুরো ডিজিটাল। শুধু রিকশাতেই নয়, টি শার্ট, টি পট, ছবির ফ্রেমসহ নানা কিছুতে ঠাঁই হয়েছে এই শিল্পের। তবে এসএ মালেকের মতে, দেশজুড়ে প্রায় পাঁচশতাধিক রিকশা পেইন্টার রয়েছেন। তার মতো যারা প্রচারের আলোয় এসেছেন, তারা টিকে আছেন। বাকিরা ধুঁকছেন।
‘কী চমৎকার দেখা গেল…' খঞ্জনির তালে বাক্সের পাল্টে যা্ওয়া ছবির সাথে এমন বর্ণণায় মেলা মাতিয়ে রাখেন জলিল মণ্ডল। এক সময়কার গ্রাম বাংলার সিনেমা ছিল যে বায়োস্কোপ, তা দেখিয়ে এখন আর জলিল মণ্ডলের পেট চলে না। তাই মেলা বাদে বাকি সময় কৃষি কাজ করেন জলিল। বলছেন, ‘‘হল বন্ধ, টিভি বন্ধ। এখন বায়োস্কোপ দেখিয়ে কি পেটের ভাত হয়? তবু বাপ-দাদার পেশা। মনের আনন্দে দেখাই।''
এই শিল্পধারার টিকে থাকার উপায় কী?
‘‘বায়োস্কোপওয়ালা জলিল মণ্ডলরা যে আনন্দে এখন মেলা থেকে মেলায় বায়োস্কোপ দেখিয়ে বেড়ান, সে আনন্দই শক্তি''- বলছেন শিল্পী ও নাট্য নির্দেশক মুস্তফা মনোয়ার। তাঁর মতে, পৃষ্ঠপোষকতা করে এই শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। এটা হতে হবে সমাজের মধ্য থেকেই। শিল্পী বলছেন, ‘ গ্রামে যে শিল্পকলা ছিল, তা ধর্ম বিচারে ছিল না। ধর্ম বিচারে ব্যবহার হতো না। গ্রামীণ সৌন্দর্যের সঙ্গে সরলতা মিশে তা হতো। কোনো বিশেষ কায়দা, কোনো বিশেষ রূপরেখা নেই, করে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে। এই যে আনন্দের সঙ্গে করছে, এবং হয়ে যাচ্ছে- এটাই শিল্পকলার বড় কথা। পট চিত্রের কথাই ধরো। পটে আঁকা ছবি তাদের মনের ছবি। যে পাখিটা তারা আঁকছে তা মনের পাখি। এবং এর রক্ষা সমাজে-জীবনে থাকে। ধর্মীয় বিষয় একটু এদিক-ওদিক হয়েছে। কিন্তু টিকে থাকাটা সমাজের ভেতর থেকেই আসতে হবে।''
‘‘লোক শিল্প স্বতঃস্ফূর্ত। এটিকে যখন পৃষ্ঠপোষকতা করবেন, তখন তা অভিজাত শিল্পের দিকে ধাবিত হবে,'' এমনই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন। তাঁর মতে, ‘‘লোক শিল্প হচ্ছে আম জনতার রুচি অনুযায়ী আম জনতার প্রয়োজনে আম জনতার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আম জনতার পর্যায়ের মানুষের তৈরি শিল্প। আমাদের ট্র্যাডিশনাল আর্টে দেখেন, একজন শিল্পী তার অঞ্চলে সাধারণ মানুষের জন্য তার কাজগুলো করেন।''
শম্ভূ আচার্যের পটচিত্রের উদাহরণ টেনে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, ‘‘তাঁর বাবা সুধীর আচার্য ১৯২০-২১ সাল থেকে পটচিত্র করেছেন। এবং এই পটচিত্রগুলো বিক্রির জন্য ছিল না। বিক্রিও হতো না। পটচিত্রের গল্পটা কমিউনিকেট করে যেন আনন্দ দেয়, সে কারণেই পটুয়ারা পটগুলো নিয়ে আসতো। আমাদের দেশে এগুলো বেদেরা ঘুরে ঘুরে দেখাতো। এটা সরাসরি বিক্রি হতো না। বেদেরা যে মাধুকরী পেতো, তাই দিয়ে তারা পটুয়াদের কাছ থেকে নিতো। সুধীর আচার্যরা জীবন নির্বাহ করতেন কুণ্ডলিসহ নানা কিছু করে। তারা পট আঁকতেন অনেকটাই মনের আনন্দে। কিন্তু ছেলে শম্ভূ আচার্যের কাছে তা আর সহজ, সরল রইলো না। তিনি অনেক সময় নিয়ে অনেক শিল্পীতভাবে আঁকেন। এবং তা ভালো দামে বিক্রিও হয়।
নিসার হোসেনের মতে, ‘‘লোক শিল্প তার সংজ্ঞার মতোই চলবে নদীর মতো। কখনো শুকিয়ে যাবে। কখনো উপচে পড়া বন্যা হবে। এটা নিজে থেকে চলার শিল্প!''
ঢাকাই জামদানির ইতিকথা
নান্দনিক ডিজাইন এবং সূক্ষ্ম কারুকাজের জামদানি শাড়ি বাঙালির ঐতিহ্যের অংশ। এ শাড়ির সমাদর বিশ্বব্যাপী। ছবিঘরে ঢাকাই জামদানি সম্পর্কে বিস্তারিত....
ছবি: DW/S. Hossain
জামদানির ইতিহাস
জামদানির প্রাচীনতম উল্লেখ রয়েছে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে। ‘জামদানি’ নামকরণ সম্পর্কে একাধিক মতবাদ রয়েছে। ফারসি থেকে জামদানি, যা ‘জামা’, অর্থাৎ কাপড় এবং ‘দানা’, অর্থাৎ বুটি- এই দুই শব্দের যোগফল। আরেকটি মতবাদ অনুযায়ী, ফারসি শব্দ ‘জাম’, অর্থাৎ উৎকৃষ্ট মদ এবং ‘দানি’, অর্থাৎ পেয়ালা- এই দুইয়ের মিলিত ফল জামদানি। জাম পরিবেশনকারী ইরানি সাকীর পরনের মসলিন থেকে জামদানি নামের উৎপত্তি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জামদানির প্রকারভেদ
জামদানি হলো কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরি পরিধেয় বস্ত্র যার বুনন পদ্ধতি অনন্য। জামদানি শাড়ী অনেক রকমের হলেও প্রাথমিকভাবে উপাদান অনুযায়ী এটি তিন প্রকারের- হাফ সিল্ক, ফুল কটন এবং ফুল সিল্ক জামদানি। সুতার মান, কাজের সূক্ষ্মতা, ডিজাইনে নতুনত্ব- এই তিনের তারতম্য ভেদে একটি জামদানি শাড়ির দাম তিন হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নানা নামের জামদানি
নকশা অনুযায়ী জামদানির নানা নাম হয়ে থাকে। যেমন, তেরছা, জলপাড়, পান্না হাজার, করোলা, দুবলাজাল, সাবুরগা, বলিহার, শাপলা ফুল, আঙ্গুরলতা, ময়ূরপ্যাঁচপাড়, বাঘনলি, কলমিলতা, চন্দ্রপাড়, ঝুমকা, বুটিদার, ঝালর, ময়ূরপাখা, পুইলতা, পানসি, কল্কাপাড়, কচুপাতা, প্রজাপতি, জুঁইবুটি, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল- এসব নাম-ই বেশি জনপ্রিয়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জামদানির হাট
দেশের বিভিন্ন মার্কেট এবং শপিংমলে জামদানি শাড়ি পাওয়া গেলেও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিসিক জামদানি শিল্প নগরী এবং ডেমরাতে দেশের অন্যতম প্রাচীন পাইকারি ও খুচরা জামদানি শাড়ি বিক্রির হাট বসে। স্থানীয়দের মতে, রূপগঞ্জ জামদানি হাটের বয়স এক যুগ হলেও ডেমরার হাটটি বসছে ব্রিটিশ আমল থেকে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সুতার কাউন্ট
জামদানি শাড়ি বোনায় সুতি ও সিল্কের সুতা ব্যবহৃত হয়। সুতার সূক্ষ্মতাকে ‘কাউন্ট’ বলে। কাউন্ট যত বেশি, সুতা তত ভালো এবং সুতা যত ভালো শাড়ি তত মসৃণ এবং আরামদায়ক। জামদানি বয়নে সাধারণত ২৬ কাউন্ট থেকে শুরু করে ২৫০ কাউন্টের সুতা ব্যবহৃত হয়। পাকা রং এবং চিকন সুতা হওয়ার কারণে নীল, ধানী সবুজ, আকাশি, মেরুন রংয়ের সুতা ৩০-৩৫ টাকা এবং টিয়া, গাব, পেস্ট, কাঁঠালি, সোনালী রংয়ের মোটা সুতা ১৪ টাকা দরে বিক্রি হয়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরঞ্জাম
জামদানি হাটের কাছে জামদানি শাড়ি তৈরির বেশ কিছু সরঞ্জাম দেখা যায়। মনজু মিয়া নামের একজন বিক্রেতা জানান, চরকার দাম ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা, টাক্কু ১০০ টাকা, মাক্কু ৪৫০ টাকা, কান্ডুল ১৫০ টাকা, চাকু ১০ টাকা, ছোট-বড় চরকি ১৬০ টাকা, শাড়ির রোল ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা, শানা ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হাটে কোটি টাকার শাড়ি বিক্রি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বিসিক জামদানি শিল্প নগরী এবং ডেমরার জামদানি হাটে প্রতি শুক্রবার হাট বসে। সপ্তাহব্যাপী তাঁতিরা শাড়ি বোনেন৷ এসব হাটে বিক্রি হয় তাদের শাড়ি৷
বিক্রেতারা জানান, শাড়িগুলো দামি হওয়ায় প্রতি হাটে কোটি টাকার বেশি দামের শাড়ির বেচাকেনা হয়ে থাকে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কঠোর পরিশ্রম
জামদানি শিল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতি সপ্তাহে শনি থেকে বৃহস্পতিবার তাঁতিরা শাড়ি বুনেন। একটা শাড়ি বুনতে ২ জন শ্রমিককে দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হয়। ২০ হাজার টাকা দামের একটি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন। এছাড়া কাজের সূক্ষ্মতা এবং ডিজাইনভেদে একটি শাড়ি বুনতে সময় লাগতে পারে ৩ দিন থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। তাঁতিরা মজুরি পান শাড়ি বিক্রির কমিশন এবং ডিজাইনের ভিত্তিতে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নারী উদ্যোক্তা
ঢাকার নারায়ণগঞ্জ এবং ডেমরার হাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একাধিক নারী উদ্যোক্তা শাড়ি কিনছেন। ঢাকার ধানমন্ডি থেকে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী উদ্যোক্তা জানান, তিনি প্রায় ৫ বছর ধরে জামদানি, বেনারশি শাড়ি বিক্রি করছেন। আগে পরিচিতদের কাছে বিক্রি করলেও এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে বিক্রি করছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
জামদানী নানা স্থানে তৈরি করা হলেও ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়। জামদানি বয়নে অতুলনীয় পদ্ধতি ইউনেস্কো কর্তৃক একটি ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পায় জামদানি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আসল জামদানি চেনার উপায়
আসল জামদানি চেনার কয়েকটি উপায় হলো, শাড়ির শুরুতে সাড়ে পাঁচ হাত পর্যন্ত কোনো পাড় থাকে না। শাড়ির ডিজাইন হয় খুব সূক্ষ্ম, নিখুঁত এবং মসৃণ। জামদানি শাড়ির সামনের অংশ আর ভেতরের অংশ পার্থক্য করা বেশ কঠিন। জামদানির সিল্ক সুতায় মাড় দেয়া থাকায় সেটা হবে অপেক্ষাকৃত অমসৃণ। সাধারণ পিওর সিল্কের সুতা টানাটানি করলে ছিঁড়ে যায় এবং আগুনে পোড়ালে চুলের মতো পোড়া গন্ধ বেরোয়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বিদেশে রপ্তানি
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি পল্লীতে শাড়ি কিনতে আসা পাইকার মো. সালাউদ্দিন বলেন, তিনি কোলকাতায়ও জামদানি শাড়ি সরবরাহ করেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ছাড়াও ইউরোপ, অ্যামেরিকার বাঙালিদের মধ্যে এ শাড়ির চাহিদা রয়েছে। তার পরিচিত অনেক ব্যবসায়ীই বিভিন্ন দেশে জামদানি সরবরাহ করে থাকেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মেশিনে বোনা জামদানি
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চলে মূলত মেশিনে জামদানি তৈরি হয়। মেশিনে বোনা শাড়ি পলেস্টার বা নাইলনের মতো কৃত্রিম সুতোয় তৈরি হয় বলে সেগুলো ভারি এবং খসখসে হয়। মেশিনে বোনা শাড়ি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায় এবং দামেও সস্তা। মেশিনে বোনা শাড়ির উল্টো পিঠের সুতাগুলো কাটা কাটা অবস্থায় বের হয়ে থাকে, বুনন ঘন এবং পুরো শাড়ি জুড়েই পাড় থাকে। একটি মেশিনে দিনে একাধিক জামদানি শাড়ি তৈরি করা যায় বলে সময়ও শ্রম কম লাগে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দাম বেশি
অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি জানান, বছর তিনেক আগে যখন এ হাটে এসেছিলেন, তখন খুচরা দোকানের চেয়ে এখানে দাম বেশ কম ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এখন তাঁতিরা হাল দাম জানতে পারেন এবং তারাও প্রায় সমান দাম হাঁকান। তাই এবার এসে জামদানির দাম যথেষ্ট বেশি মনে হয়েছে তার কাছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বিক্রির মৌসুম
তাঁতি এবং পাইকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সারা বছর জামদানির মোটামুটি চাহিদা থাকলেও রোজার ঈদের ১৫ দিন আগে থেকে চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যেমন পহেলা বৈশাখ, বড়দিন, হিন্দুদের পূজা-পার্বনে এ শাড়ির চাহিদা বেড়ে থাকে। তবে হালকা হওয়ায় শীতের সময় এ শাড়ির চাহিদা কম থাকে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা
রোকেয়া জামদানি উইভিং ফ্যাক্টরির মালিক জামান মিয়া বলেন, জামদানি শিল্পের কদর থাকায় সরকারি এবং বেসরকারি ঋণ পাওয়া যায়। তিনি সরকারিভাবে ১০টি তাঁতের বিপরীতে ৫ লক্ষ টাকা ঋণ পেয়েছেন বলে জানান। প্রতিটি তাঁত বা পডি’তে ছয় মাসে তাকে নয় হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। তবে এর চেয়ে কম সুদে ঋণ পেলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ উপকৃত হতো বলে মনে করেন তিনি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আছে শিশু তাঁত শ্রমিকও
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি পল্লীতে প্রতি ঘরেই তাঁতের ব্যবসা বা মেশিন রয়েছে। শিশুরাও পড়াশোনা বন্ধ করে এ পেশায় যোগ দিচ্ছে। এক তাঁতি বলেন, তার ফ্যাক্টরিতে একাধিক শিশু কাজ করেন। প্রথম দুই বছর তাদের শিক্ষানবিশকালীন সময়। এ সময়ে শিশুটির যাবতীয় খরচ মালিকের। এছাড়া কাজ শিখে গেলে বাচ্চার অভিভাবকের হাতে এককালীন টাকা দেওয়া হয়ে থাকে। ঝুঁকিহীন এবং আয় বেশ ভালো বলে এ কাজে অনেক শিশু আসছে বলে জানান তিনি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সকাল নয়টার মধ্যেই বেচাকেনা শেষ
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি হাট এবং ডেমরার হাটে বেচাকেনা শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগেই। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারি ক্রেতা, বিক্রেতা এবং তাঁতিরা ভিড় করতে থাকেন হাটে। হাটগুলোতে হাজার হাজার শাড়ি বিক্রি হয় এবং সকাল ৯টার মধ্যেই বেচাকেনা শেষ হয়ে যায়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হাটে কিভাবে যাবেন
যারা ঢাকা থেকে ডেমরা অথবা রূপগঞ্জের জামদানি হাটে যেতে চান, তারা বাসে গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ডেমরা রুটে অথবা মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে কাঁচপুর ব্রিজ হয়ে তারাব বিশ্বরোডে গিয়ে নামতে পারেন। সেখান থেকে ১ কিলোমিটার ভিতরেই রূপগঞ্জ বিসিক জামদানি পল্লী। এছাড়া ৩০০ ফিটের রাস্তা হয়েও সেখানে যাওয়া যায়।