আকাশ সংস্কৃতির কারণে লোকসংস্কৃতি থেকে আজ আমরা বিচ্ছিন্ন৷ কিন্তু নিজের শেকড়কে না জানলে কোনো জাতির উন্নয়ন সম্ভব না৷ আমাদের শেকড় লুকিয়ে লোকগান, হস্তশিল্প ও সাহিত্যে৷ তাই এগুলোকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারা তিনটি: নগরসংস্কৃতি, গ্রামসংস্কৃতি ও উপজাতীয় সংস্কৃতি৷ কিন্তু এ সব সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে আজ মুখ্য হয়ে উঠেছে আকাশ সংস্কৃতি৷ এই আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবেই আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি৷
ছোটবেলায় আমরা গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে যেতাম৷ গাইবান্ধার নূরপুর গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি৷ প্রতিদিন দুপুরের খাওয়া শেষে দেখতাম শীতল পাটি বিছিয়ে বাড়ির মেয়ে-বউরা কাঁথা সেলাই করতে বসতেন৷ একজন গান ধরতেন, যেটাকে তাঁরা বলতেন গীত৷ এই গীত কিন্তু কোনো শেখা গান নয়, যার যা মনে আসতো তাই দিয়ে একজনের কাছ থেকে আর একজন কথা কেড়ে নিয়ে গান বাঁধতেন৷ এ এক অপূর্ব দৃশ্য৷
এছাড়া ঢেঁকিতে ধান বা জলপান ভাঙার সময়ও তাঁরা গীত গাইতেন৷ বিয়ের সময় গায়ে হলুদের দিন বাড়ির বৃদ্ধারা গীত বানাতেন নতুন জামাই বা নতুন বউয়ের ‘বদনাম' করে৷ সেটা উপস্থিত প্রতিটা মানুষকে আনন্দ দিতো৷ পাশাপাশি এই যে সুখ স্মৃতি নিয়ে বড় হয়ে ওঠা এটা আমার কাছে একটা সম্পদের মতো৷ এই যে সংস্কৃতি এটা কিন্তু চলে আসছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে৷
বাংলাদেশের কিছু লোকসংস্কৃতি
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বৈচিত্রময় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে৷ কিন্তু এর অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে কালের হাওয়ায়৷ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য কিছু উপাদান দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: M. M. Rahman
নৌকা বাইচ
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে শত শত বছরের ঐহিত্য হিসেবে এখনো টিকে আছে নৌকা বাইচ৷ সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নদীনালা যখন পানিতে টইটম্বুর থাকে, সেসময়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়৷ নৌকা বাইচের সময় ঢোল ও করতালের সাথে সাথে মাঝি-মাল্লারা এক সুরে গান গেয়ে বৈঠা চালান৷
ছবি: M. M. Rahman
ষাঁড়ের লড়াই
অতীতে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় একটি শৌখিন একটি খেলা ছিল ষাঁড়ের লড়াই৷ ফসল তোলার পরে ফাঁকা মাঠে আয়োজন করা হতো জনপ্রিয় এ খেলাটির৷ দূর-দূরান্ত থেকে মানুষেরা জড়ো হতেন শ্বাসরুদ্ধকর এ খেলা দেখতে৷ বর্তমানে এই শৌখিন এ খেলাটি বিলুপ্তির পথে৷ বাংলাদেশে অবশ্য খেলাটির আয়োজনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে৷
ছবি: M. M. Rahman
গরুর গাড়ির দৌড়
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় খেলা৷ ফসল তোলার পর কৃষকদের আনন্দ দিতে খালি মাঠে এ দৌঁড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়৷ আর গরুর গাড়ি নিয়ে এ খেলায় অংশ নেন মূলত কৃষকরাই৷ রোমাঞ্চকর এই প্রতিযোগিতাকে ঘিরে গ্রামীণ মেলাও বসে৷
ছবি: M. M. Rahman
মোরগ লড়াই
গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা মোরগ লড়াই৷ বাংলাদেশ থেকে এ খেলাটি হারাতে বসলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকায় এখনো মোরগ লড়াইয়ের ঐতিহ্য টিকে রয়েছে৷
ছবি: M. M. Rahman
লাঠি খেলা
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির একটি অংশ লাঠি খেলা৷ ঢোলের তালে নেচে নেচে আত্মরক্ষার নানান কৌশল দেখানো হয় লাঠি খেলার মাধ্যমে৷ একসময় রোমাঞ্চকর এ খেলাটি গ্রামাঞ্চরে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো৷ তবে এখন আর আগের মতো খেলাটির আয়োজন হয় না৷
ছবি: M. M. Rahman
সার্কাস
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো কিছু সার্কাসের আয়োজন হয়৷ তবে লোকসংস্কৃতির এই অনুষঙ্গটির এখন দুর্দিন বলা যায়৷ নানারকম শারীরিক কসরত, পশু-পাখির খেলা আর হাস্যরসের খোঁজে সার্কাস দেখতে অতীতে দলবেঁধে যেতেন গ্রামবাংলা মানুষেরা৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারণে এ শিল্পটি এখন সংকটের মুখে৷
ছবি: M. M. Rahman
গ্রামীণ মেলা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান গ্রামীণ মেলা৷ বাংলাদেশের সর্বত্রই এখনো প্রচুর মেলা বসে৷ গ্রামের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে এখন শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে মেলার সংস্কৃতি৷ তবে হাজার বছরের পুরনো গ্রামীণ মেলা দিনে দিনেই জৌলুশ হারাচ্ছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বায়োস্কোপ
বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য বায়োস্কোপ৷ রং-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে গাঁয়ের মেঠোপথে এখন আর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না বায়োস্কোপওয়ালার৷ খঞ্জনি আর খালি গলায় গাওয়া গানের তালে বাক্সের ভেতর বদলে যাওয়া ছবি দেখে এককালে গল্পের জগতে হারিয়ে যেত গ্রামবাংলার মানুষ৷ টেলিভিশন শত শত চ্যানেলের ভিড়ে বায়োস্কোপের এখন তাই হারাতে বসেছে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
যাত্রা-পালা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে যাত্রাপালাও বেশ উল্লেখযোগ্য৷ তবে জঙ্গিবাদ আর অশ্লীলতার ছোবলে যাত্রাপালা এখন হারাতে বসেছে বাংলাদেশ থেকে৷ অতীতে শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামমাঞ্চলে যে যাত্রাপালা বসত নানা কারণে এখন আর তার দেখা মেলে না৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
লোকজ গান
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নানারকম লোকজ গান৷ ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, বাউলগান, গম্ভীরাসহ নানান লোকজ গানে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
নকশিকাঁথা
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতিতে যুগ যুগ ধরে টিকে আসে নকশিকাঁথা৷ এখনো বাংলাদেশের যশোর, জামালপুরসহ গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকার ঘরে ঘরে তৈরি হয় নজরকাড়া নকশিকাঁথা৷ ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা এখন বাংলাদেশের গণ্ডি পেড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছ বিশ্ব দরবারেও৷
ছবি: M. M. Rahman
তাঁত শিল্প
একসময় ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছিল বিশ্বজোড়া৷ মসলিন হারিয়ে গেলেও টিকে আছে ঢাকাই জামদানি৷ এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো টিকে আছে এই তাঁত শিল্প৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুমিল্লার খাদি, ঝালকাঠীর গামছা নরসিংদীর লুঙ্গি ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. Mamun
12 ছবি1 | 12
আরও একটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করতেই হয়৷ সেটা হলো দুর্গা পূজার সময় এই ছোট্ট গ্রামটিতে যাত্রাপালা হতো পুরো পাঁচ দিনব্যাপী৷ এই যাত্রার শিল্পীদের ঐ গ্রামের বাইরে থেকে আনা হলেও স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীরাও কিন্তু অংশ নিতেন এতে৷
গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই কিন্তু তালপাখা বানাতে জানতেন৷ প্রচণ্ড গরমে শিতলপাটি আর তালপাখার হাওয়ার শীতল পরশ বুলিয়ে দিত শরীরে৷ আর একটি বিষয় ছিল পুঁথি পড়া৷ সোনাভানের পুঁথি – কী অসাধারণ লাগত গানের সুরে পুঁথি পড়া৷ শহুরে শিশুদের কথা দূরে থাক, গ্রামের শিশুরাও কিন্তু এ সব সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত৷ কারণ প্রত্যন্ত গ্রামেও ঢুকে পড়েছে বোকা বাক্স৷ আর তাতেই বন্দি তাদের শৈশব৷ এরা জানে না পুঁথি কী, যাত্রা কী, প্রবাদ-প্রবচন কী, লোকগান কী৷ তবে এটা তাদের ব্যর্থতা নয়৷ ব্যর্থতা আমাদের, এই রাষ্ট্রের৷ কারণ আমরা আমাদের লোকসংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করার কোনো চেষ্টাই করিনি৷
এখন বিভিন্ন স্কুলে যেসব প্রতিযোগিতা হয়, সেখানে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি – এ সব গানের কোনো প্রতিযোগিতা হয় না৷ হয় না কোনো গম্ভীরা৷ যাত্রাপালার নামে বসে মাদকের আড্ডা৷ ভাটি অঞ্চলের মানুষ তাঁদের গানের মাধ্যমে কী কথা বলতে চাইছেন সেটা যখন গানের মাধ্যমে শেখা হয়, তখন সেই অঞ্চলের সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়৷
বাংলাদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্রধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে৷ দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি জাতির প্রকৃত পরিচয় বহন করে৷
আমাদের হস্তশিল্প আজ বিদেশে ভীষণ চাহিদা৷ কিন্তু নিজের দেশে এর চাহিদা আছে কি? আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় দেখেছি পাটের দড়ি দিয়ে বানানো শিকায় মাটির ভাড়ে রসুন, শুকনো মরিচ এ সব রাখা হতো৷ অথবা শিকায় গাছ ঝোলানো হতো৷ এখন শিকা কয়জনের বাসায় দেখতে পাওয়া যায়?
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও বিচিত্র কয়েকটি মেলা
বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ গ্রামীণ মেলা৷ বিভিন্ন পালা পার্বণকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ছোট-বড় গ্রামীণ লোকজ মেলা বসে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে৷ কয়েকটি গ্রামীণ মেলা দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লোক ও কারুশিল্প মেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে প্রতি বছর মাসব্যাপী বসে লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব৷ সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে প্রতি বছর এ মেলা শুরু হয় জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এ লোকজ মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকার সব রকম লোকজ সংস্কৃতি ও কুটির শিল্প সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন শিল্পীরা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বৈশাখী মেলা
এটি মূলত সার্বজনীন লোকজ মেলা৷ বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের সর্বত্রই আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার৷ নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে এ বৈশাখী মেলা৷ স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলার মূল আকর্ষণ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাস মেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রতিবছর কার্তিক-অগ্রহায়নের পূর্ণিমা তিথিতে বসে রাসমেলা৷ অনেক হিন্দু পুন্যার্থী আর পর্যটক এ উৎসবে শামিল হতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন৷ এ উপলক্ষ্যে পাঁচ দিনের একটি মেলাও মেলা বসে দুবলার চরে৷ মেলাটি চলে আসছে ১৯২৩ সাল থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লাঙ্গলবন্দের মেলা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলমম্বীরা চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী বা অশোকাষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নানের জন্য সমবেত হন৷ এ উপলক্ষে তিন দিন ব্যাপী মেলা বসে ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গুড়পুকুরের মেলা
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এ মেলাটি ৩০০ বছরেরও বেশি৷ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ চলে একমাস৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
পোড়াদহের মেলা
গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ি এলাকায় ইছামতি নদীর তীরে আড়াইশ বছর ধরে বসে ব্যতিক্রমী এক মেলা৷ প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার বসে দুই দিনের এ মেলা৷ এ মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় আকৃতির নানা রকম মাছ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশ লীলার মেলা
মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর আদমপুরে কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাস লীলা৷ এ উপলক্ষে তিন দিনের মেলা বসে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুরের সনাঠাকুর মণ্ডপ এলাকায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রথের মেলা
সাধারণত বাংলা বছরের আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথের মেলা বসে৷ সবচেয়ে বড় রথের মেলা বসে সাভারের ধামরাইয়ে৷ এছাড়া কুষ্টিয়ার রথখোলার মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা উল্লেখযোগ্য৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লালন মেলা
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে মরমী শিল্পী লালন সাঁইয়ের সামাধিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দুইবার লালনমেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ তার একটি হচ্ছে লালন সাঁইজির তিরোধান তিথি উপলক্ষে এবং অন্যটি দোলপূর্ণিমায় লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গ উপলক্ষে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মধু মেলা
যশোরজেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়িতে প্রতি বছর বসে সপ্তাহব্যাপী মধু মেলা৷ বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হয় এ মেলার আয়োজন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বটতলায় বৌমেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চারশ’বছরের পুরানো একটি বট গাছকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে বউ মেলা৷ বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা পরিবারের সুখ শান্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে এখানকার বট গাছকে পূজা করেন৷ এ উপলক্ষে পাঁচদিনের মেলাও বসে বট গাছের চারপাশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
11 ছবি1 | 11
হস্তশিল্পের জায়গা দখল করেছে সস্তার প্লাস্টিকের দ্রব্য৷ মোড়া বা বেতের চেয়ারের জায়গা দখল করেছে প্লাস্টিকের চেয়ার৷ শীতল পাটিরও বিকল্প বের হয়েছে৷
গরমের সময় মাটির কুঁজোর পানি যে কী ঠান্ডা লাগতো! রেফ্রিজেটরের কারণে এখন তো এটা কেউ ব্যবহারই করে না৷ আমাদের এলাকায় প্রতি বৃহস্পতিবার হাটে কুমোরেরা মাটির জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসত৷ দু'বছর আগে সেই হাটে গিয়েছিলাম একটা কুঁজো কিনবো বলে৷ কিন্তু খুঁজেই পেলাম না৷ কেবল মাটির টব আর খুঁটি নাটি কয়েকটা জিনিস৷ আগে বিশাল জায়গা জুড়ে যে পসরা বসত৷ আজ তা দু-তিনটি দোকানে সীমাবদ্ধ৷
পটুয়া কামরুল হাসান আমাদের সরা শিল্পকে বিখ্যাত করে তুলেছেন৷ আগে পূজামণ্ডপে এই মাটির সরাতেই প্রাদ বিতরণ করা হত৷ আজ হয় প্লাস্টিকের ব্যাগে৷
আমাদের লোকগান সংগ্রহ করা হচ্ছে কি? না কিছু ব্যান্ডের বদৌলতে অল্প কয়েকটি গান হয়ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ কিন্তু আমাদের লোকগানের যে বিশাল ভাণ্ডার তা সংরক্ষণ করা তো হচ্ছে না৷ তার চর্চাও হচ্ছে না৷
আমাদের যে হস্তশিল্প তাতে কিন্তু মানুষের কথাই বলা হয়েছে , বলা হয়েছে গ্রাম বাংলার কথা৷ এ দেশে লোক সংস্কৃতির ধারা প্রায় অচল হতে বসেছে আমাদেরই কারণে, আমাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে৷ আমরা আমাদের লোকসংস্কৃতিকে হাতে ধরে নষ্ট করছি৷
পরনির্ভর মানসিকতার কারণে আমরা নিজেদের দিকে তাকাই না, নিজের সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকেও তাকাই না৷ এমনিভাবে লোকসংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করি না, লোকসংস্কৃতিকে জীবনের আহ্বানে সম্পর্কিত করি না৷
লোককাঁথা চকচকে ঘরে শোভা পায়, ড্রইংরুমে শোভা পায়, লোকশিল্পের হস্ত নির্মিত বিভিন্ন সামগ্রী ড্রইংরুমে প্রদর্শিত হয়, এর বৈচিত্র্যময় আবেদনের কারণে৷ এছাড়া লোকসংস্কৃতির সামগ্রীসমূহ বিদেশে রপ্তানি করে অনেকে টাকা-পয়সা রোজগারে সফলও হচ্ছেন৷ এভাবে একদিকে লোকসংস্কৃতির ব্যবহার ও চাহিদা বাড়ছে৷ কিন্তু দেশের মধ্যে দেশের মানুষের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যে টেনে আনি না৷ এ জন্য সচল ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন৷ এ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে আপন সংস্কৃতির প্রতি টান থেকে, মান থেকে; গড়ে উঠতে পারে জীবনকে নিজস্ব ঐতিহ্যে রূপময় করে বিকশিত করার ইচ্ছে থেকে৷ এ জন্য জাগরণ প্রয়োজন বিভিন্ন স্তরে৷
অনেক লোককাহিনি এখনো গ্রামবাংলায় টিকে আছে৷ সেইসব লোককাহিনি গ্রন্থে গ্রন্থে প্রকাশিত হতে পারে৷ এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিসহ উৎসাহী প্রকাশক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন৷ লোককাহিনি, ছড়া, প্রবচন ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ আমাদের লোক সংস্কৃতির ভাণ্ডার৷ অথচ সেগুলো সংগ্রহ বা সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হস্তশিল্পগুলো যেমন বেতশিল্প, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, চামড়াশিল্প, বুননশিল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ কিন্তু হস্তশিল্পের সঙ্গে যেসব পেশাজীবী জড়িয়ে আছেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে শোষিত৷ তাঁরা পণ্যের সঠিক মূল্য পান না৷ তাই এ সব পেশায় টিকে থাকা তাঁদের জন্য বেশ কষ্টকর৷ এ বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা দরকার৷ এদের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি, না হলে হস্তশিল্পের সম্ভাবনা যেটুকু আছে তাও হারিয়ে যাবে৷
লোকসংস্কৃতির আর এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঐশ্বর্য গ্রামীণ খেলাধুলা৷ বহু যুগ ধরে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গ্রাম বাংলায় নানা ধরনের খেলাধুলার প্রচলন রয়েছে৷ কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে৷
অবহেলায় অবহেলায় লোকসংস্কৃতির সহজ সরল ধারা আজ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘর্ষে উপনীত হচ্ছে৷ এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে রাষ্ট্রও৷ রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম – সংস্কৃতির ধারাকে বেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সে কারণে এ সবের ওপর সংস্কৃতির বিকাশও নির্ভরশীল৷
মোদ্দা কথা হলো, নিজের সংস্কৃতিকে যদি না জানি, যদি চর্চা না করি তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের উন্নয়ন সম্ভব না৷ আর জাতির উন্নয়ন না হলে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন কীভাবে হবে?
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলঅর থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷