প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন পুরোদমে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে নেমে পড়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি হয় জনসভা করছেন অথবা সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন করছেন। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন মোদী। আর তিনি এবার প্রচারে নিয়ে এসেছেন নতুন বিষয়। নতুন কৌশল।

কিছুদিন হলো মোদীর গ্যারান্টি নিয়ে ভরপুর প্রচার চলছে। এই গ্যারান্টি কি? গরিবদের আরো পাঁচ বছর বিনা পয়সায় সরকারি রেশন, পাঁচ লাখ পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিমা, কম দামে গ্যাসের সিলিন্ডার, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বিনা পয়সায় বাড়ি, নারী স্বনিযুক্ত গোষ্ঠীকে ১৫ হাজার টাকা, বয়স্কদের পেনশন, লাখপতি দিদির মতো একগুচ্ছ প্রকল্পই হলো মোদীর গ্যারান্টি।

এ সবই সরকারি প্রকল্প। রেডিও, টিভি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, খবরের কাগজ, পত্রিকা, পেট্রোল পাম্প সব জায়গাতে এর ভরপুর প্রচার চলছে। এই বিজ্ঞাপন কৌশল দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করতে চাইছেন মোদী। আগেরবার বলা হয়েছিল, 'মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়'। এবার বলা হচ্ছে, 'মোদী কা গ্যারান্টি হ্যায়'।

পশ্চিমবঙ্গে এসে মোদী এই প্রচার শুরু করেছেন। মোদী-পরিবারের প্রচার। বারাসতের সভায় তিনি বলেছেন, তরুণ বয়সে শুধু একটা ঝোলা নিয়ে তিনি গহত্যাগ করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যান। সেখানকার ভাষা জানতেন না। পকেটে পয়সা নেই। কিন্তু কোনো না কোনো পরিবার তাকে ঠিক খাবার দিয়েছে । মোদীর ঘোষণা, ভারতীয়রা সকলেই মোদীর পরিবার।

জনসভায় মোদী বলতে থাকেন, 'আমি'। সামনে বসা মানুষ জবাব দেন 'মোদীর পরিবার'। এটাই মোদী তথা বিজেপি-র নতুন স্লোগান। বিজেপি বলছে, এটাই তাদের তুরুপের তাস হয়ে উঠতে চলেছে। জনতার সঙ্গে মোদীর একাত্মতার মোকাবিলা বিরোধীরা করতে পারবে না বলে বিজেপি নেতাদের দাবি।

আরো বেশি করে নারীদের ভোট পেতে উদ্যোগী হয়েছেন মোদী। সংসদে ও বিধানসভায় নারীদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের বিল পাস হয়েছে। সেই ব্যবস্থা কার্যকর হবে ২০২৯ থেকে। মোদী গরিব মেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্য বিশ্বকর্মা যোজনা, ছোট ব্যবসা করার জন্য স্বনিধি যোজনার কথা বলছেন। লাখপতি দিদি নিয়ে প্রচার চলছে। মেয়েদের বিনা সুদে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা বছরে এক লাখ টাকা রোজগার করতে পারেন।

কিছুদিন আগেই বিজেপি নেতা ও কর্মীদের মোদী নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবার ১৮ বছর বয়সি যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের সকলের কাছে পৌঁছাতে হবে। মোদী এবার প্রচারে যুব ও প্রথমবারের ভোটদাতাদের মন পেতে তাদের জন্য তিনি কী করেছেন, তা বিস্তারিতভাবে বলবেন।

এবার মোদীর আরেকটি স্লোগান হলো, আব কি বার, চারশ পার। অর্থাৎ, এবার চারশ পার করে যাবে এনডিএ। বিজেপি পাবে অন্তত ৩৭০টি আসন। এবার এনডিএ-র পরিধি বাড়ানো হয়েছে। চন্দ্রবাবু নাইডু আবার এনডিএ-তে ফিরেছেন। বিজু জনতা দলের নেতা নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়াই করা নিয়ে বিজেপি-র আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে। মোদী একটা ধারণা তৈরি করতে চাইছেন, তিনি জিতবেনই।

পশ্চিমবঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মালদহ ও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ আছেন। তারা সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আসা নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ। বনগাঁও-সহ তিনটি লোকসভা কেন্দ্রে তারাই ভোটের ফল নির্ধারণ করেন। তাদের ভোটাধিকার থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিক স্বীকৃতি নেই। সিএএ চালু করে তাদের নাগরিক হওয়ার পথ সুগম করা হলো বলে বিজেপি প্রচারে নেমে গেছে।

পশ্চিমবঙ্গে গত দুই সপ্তাহে তিনবার এসেছেন মোদী। জনসভা করেছেন আরামবাগ, বারাসত, শিলিগুড়িতে। মেট্রো রেল সম্প্রসারণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। পড়ুয়াদের সঙ্গে নিয়ে মেট্রো সফর করেছেন। সন্দেশখালির নারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। গতবার ১৮টি আসনে জিতেছিল বিজেপি। এবার সেই সংখ্যা ধরে রেখে একটা হলেও আসন বাড়াতে চায় তারা। তাই এত ঘনঘন মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফর।

মোদীর নির্বাচনী কৌশলের একটা অঙ্গ হলো, নতুনদের প্রার্থী করা। পুরনোদের মধ্যে যাদের জয় নিয়ে তিলমাত্র সন্দেহ আছে, তাদের বাদ দিয়ে দেয়া। এবারো সেই পথে হেঁটেছেন মোদী। দিল্লিতে পাঁচটি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। চারটিতে নতুন প্রার্থীকে সুযোগ দেয়া হয়েছে।

কংগ্রেস জানিয়েছে, ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয় সরকারের ৩০ লাখ শূন্য পদ পূরণ করা হবে। যুবদের চাকরি দেয়া হবে। রাহুল গান্ধীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে ৩০ লাখ পদ খালি আছে। নরেন্দ্র মোদী তা পূরণ করছেন না। শুধু এই সব খালি পদে নিয়োগই নয়, ভবিষ্যতে যে পদ খালি হবে, তাতেও দ্রুত নিয়োগ করা হবে। দেরি করা হবে না। কংগ্রেস এই গ্যারান্টির নাম দিয়েছে 'ভর্তি ভরোসা'।

কংগ্রেসের গ্যারান্টি, ক্ষমতায় এলে তারা এই আইন করবে যে, যুবরা স্নাতক হওয়ার পরই একবছর কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থায় ইন্টার্ন হিসাবে কাজ করতে পারবেন। সরকার তাদের ওই এক বছর মোট এক লাখ টাকা দেবে। রাহুল জানিয়েছেন, শিক্ষা শেষ করার পর প্রথম কর্মসংস্থান নিয়ে পড়ুয়াদের চিন্তা করতে হবে না।

গিগ কর্মী মানে তাদের বোঝায় যারা পরিষেবা খাতে একজন ঠিকাদারের অধীনে বা ফ্রিল্যান্সার হিসাবে কাজ করেন। যারা গাড়ি চালান, বাড়িতে জিনিস পৌঁছে দেন, এদের মতো অসংখ্য গিগ কর্মীর জন্য রাহুল গান্ধীর গ্যারান্টি, ক্ষমতায় এলে তাদের সামাজিক সুরক্ষা ও কাজের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইন করা হবে।

তরুণ উদ্যোগপতিদের জন্য কংগ্রেসের গ্যারান্টি, প্রতিটি জেলার জন্য পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হবে। তা দিয়ে স্টার্ট আপগুলিকে সাহায্য করা হবে। নিজের শিল্প বা ব্যবসার জন্য ৪০ বছরের কম বয়সিরা এই তহবিলের থেকে অর্থসাহায্য পাবেন।

কংগ্রেসের আরেকটি গ্যারান্টি হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা হবে। এর জন্য নতুন কড়া আইন করা হবে। চাকরি-সহ সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস কড়াহাতে বন্ধ করা হবে।

কংগ্রেস জানিয়েছে, আন্দোলনরত কৃষকদের অন্যতম দাবি হলো, ফসলের ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্যকে আইনি রূপ দেয়া। যাতে সকলেই ওই ন্যূনতম দামে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনে। রাহুল বলেছেন, কংগ্রেস এলে এই আইন করা হবে। এটা কৃষকদের জন্য তাদের গ্যারান্টি।

কংগ্রেসের আরেকটি গ্যারান্টি হলো, ক্ষমতায় এলে জাতিগত জনগণনা করা হবে। তাতে স্পষ্ট হয়ে যাবে, উচ্চবর্ণ, অনগ্রসর, অতি অনগ্রসর, দলিত, অতি-দলিত, আদিবাসীদের সংখ্যা কত। প্রতিটি রাজ্যে কোন জাতের কত মানুষ বাস করেন।

ভারতে এখন গ্যারান্টির লড়াই চলছে। টিভি, রেডিও, কাগজ, হোর্ডিংয়ে মোদীর গ্যারান্টির প্রচার চলছে। সেখানে বলা হচ্ছে, গরিবদের পাঁচ বছর রেশন দেয়া মোদীর গ্যারান্টি, গরিবদের পাঁচ লাখ টাকা বিমা হলো মোদীর গ্যারান্টি, উন্নত ভারত হলো মোদীর গ্যারান্টি, পাঁচ বছরে বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হলো মোদীর গ্যারান্টি। তার মোকাবিলা করতেই কংগ্রেস ইস্তাহার প্রকাশের অনেক আগেই সাত গ্যারান্টির প্রতিশ্রুতি দিলো।

কংগ্রেসের প্রথম প্রার্থী তালিকা তৈরি হয়ে গেছে। সূত্র জানাচ্ছে, রাহুল গান্ধী আবার কেরালার ওয়ানাড়েই লড়বেন। কেরালায় ২০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস লড়বে ১৬টি আসনে বাকি চারটি দেয়া হবে শরিকদের। শশী থারুরও সম্ভবত তিরুবনন্তপুরমে কংগ্রেস প্রার্থী হবেন।

সোনিয়া গান্ধীর কেন্দ্র রায়বেরিলি থেকে লড়তে পারেন প্রিয়াংকা গান্ধী। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট করে লড়ছে কংগ্রেস। তাই রায়বেরিলিতে জয়ের ব্যাপারে কংগ্রেস আশাবাদী।