প্রতিটি জাতির একটা নিজস্ব স্বকীয়তা আছে৷ আর সেই স্বকীয়তা বোঝা যায় লোক ও কারুশিল্প দিয়ে৷ বোঝা যায় জাতিটি সংস্কৃতিতে কতটা এগিয়েছে, সেটাও৷ বললেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷
বিজ্ঞাপন
‘‘বাঙালি জাতির আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য৷ জামদানি থেকে শুরু করে শীতল পাটি – বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে৷ তবে এখনও এমন অনেক কিছুই আছে যা স্বীকৃতি পেতে পারে৷ এর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷'' ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷ এই বিষয়েই জাপানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন জনাব মামুন৷
ডয়চে ভেলে: লোক ও কারুশিল্পের বর্তমান অবস্থাটা যদি সংক্ষেপে বলেন...
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল-মামুন: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্প আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ প্রতিটি জাতির গোষ্ঠী চরিত্র বহনকারী যে সমাজ থাকে, তারা তাদের বুদ্ধিমত্তা, নান্দনিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক বোধ দিয়ে লোক ও কারুশিল্প সৃষ্টি করে৷ এই ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতিকে কোথাও কোথাও দেশজ সংস্কৃতি হিসেবে মানুষ চেনে৷ বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প অত্যন্ত সমৃদ্ধ৷ এর একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে৷ মসলিন থেকে শুরু করে, শীতল পাটি, বিয়ের পিঁড়ি, বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি শিল্প, এবং পোড়া মাটির শিল্প আমাদের ঐহিত্যের মূর্ত প্রতীক৷ বাংলাদেশকে যে আবহমান বাংলা বলা হয়, চিরায়ত বাংলা বলা হয়, সেটার একটা দৃশ্যমান নান্দনিকতা এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যাবে৷
বাংলাদেশের কিছু লোকসংস্কৃতি
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বৈচিত্রময় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে৷ কিন্তু এর অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে কালের হাওয়ায়৷ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য কিছু উপাদান দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: M. M. Rahman
নৌকা বাইচ
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে শত শত বছরের ঐহিত্য হিসেবে এখনো টিকে আছে নৌকা বাইচ৷ সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নদীনালা যখন পানিতে টইটম্বুর থাকে, সেসময়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়৷ নৌকা বাইচের সময় ঢোল ও করতালের সাথে সাথে মাঝি-মাল্লারা এক সুরে গান গেয়ে বৈঠা চালান৷
ছবি: M. M. Rahman
ষাঁড়ের লড়াই
অতীতে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় একটি শৌখিন একটি খেলা ছিল ষাঁড়ের লড়াই৷ ফসল তোলার পরে ফাঁকা মাঠে আয়োজন করা হতো জনপ্রিয় এ খেলাটির৷ দূর-দূরান্ত থেকে মানুষেরা জড়ো হতেন শ্বাসরুদ্ধকর এ খেলা দেখতে৷ বর্তমানে এই শৌখিন এ খেলাটি বিলুপ্তির পথে৷ বাংলাদেশে অবশ্য খেলাটির আয়োজনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে৷
ছবি: M. M. Rahman
গরুর গাড়ির দৌড়
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় খেলা৷ ফসল তোলার পর কৃষকদের আনন্দ দিতে খালি মাঠে এ দৌঁড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়৷ আর গরুর গাড়ি নিয়ে এ খেলায় অংশ নেন মূলত কৃষকরাই৷ রোমাঞ্চকর এই প্রতিযোগিতাকে ঘিরে গ্রামীণ মেলাও বসে৷
ছবি: M. M. Rahman
মোরগ লড়াই
গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা মোরগ লড়াই৷ বাংলাদেশ থেকে এ খেলাটি হারাতে বসলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকায় এখনো মোরগ লড়াইয়ের ঐতিহ্য টিকে রয়েছে৷
ছবি: M. M. Rahman
লাঠি খেলা
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির একটি অংশ লাঠি খেলা৷ ঢোলের তালে নেচে নেচে আত্মরক্ষার নানান কৌশল দেখানো হয় লাঠি খেলার মাধ্যমে৷ একসময় রোমাঞ্চকর এ খেলাটি গ্রামাঞ্চরে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো৷ তবে এখন আর আগের মতো খেলাটির আয়োজন হয় না৷
ছবি: M. M. Rahman
সার্কাস
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো কিছু সার্কাসের আয়োজন হয়৷ তবে লোকসংস্কৃতির এই অনুষঙ্গটির এখন দুর্দিন বলা যায়৷ নানারকম শারীরিক কসরত, পশু-পাখির খেলা আর হাস্যরসের খোঁজে সার্কাস দেখতে অতীতে দলবেঁধে যেতেন গ্রামবাংলা মানুষেরা৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারণে এ শিল্পটি এখন সংকটের মুখে৷
ছবি: M. M. Rahman
গ্রামীণ মেলা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান গ্রামীণ মেলা৷ বাংলাদেশের সর্বত্রই এখনো প্রচুর মেলা বসে৷ গ্রামের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে এখন শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে মেলার সংস্কৃতি৷ তবে হাজার বছরের পুরনো গ্রামীণ মেলা দিনে দিনেই জৌলুশ হারাচ্ছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বায়োস্কোপ
বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য বায়োস্কোপ৷ রং-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে গাঁয়ের মেঠোপথে এখন আর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না বায়োস্কোপওয়ালার৷ খঞ্জনি আর খালি গলায় গাওয়া গানের তালে বাক্সের ভেতর বদলে যাওয়া ছবি দেখে এককালে গল্পের জগতে হারিয়ে যেত গ্রামবাংলার মানুষ৷ টেলিভিশন শত শত চ্যানেলের ভিড়ে বায়োস্কোপের এখন তাই হারাতে বসেছে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
যাত্রা-পালা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে যাত্রাপালাও বেশ উল্লেখযোগ্য৷ তবে জঙ্গিবাদ আর অশ্লীলতার ছোবলে যাত্রাপালা এখন হারাতে বসেছে বাংলাদেশ থেকে৷ অতীতে শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামমাঞ্চলে যে যাত্রাপালা বসত নানা কারণে এখন আর তার দেখা মেলে না৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
লোকজ গান
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নানারকম লোকজ গান৷ ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, বাউলগান, গম্ভীরাসহ নানান লোকজ গানে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
নকশিকাঁথা
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতিতে যুগ যুগ ধরে টিকে আসে নকশিকাঁথা৷ এখনো বাংলাদেশের যশোর, জামালপুরসহ গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকার ঘরে ঘরে তৈরি হয় নজরকাড়া নকশিকাঁথা৷ ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা এখন বাংলাদেশের গণ্ডি পেড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছ বিশ্ব দরবারেও৷
ছবি: M. M. Rahman
তাঁত শিল্প
একসময় ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছিল বিশ্বজোড়া৷ মসলিন হারিয়ে গেলেও টিকে আছে ঢাকাই জামদানি৷ এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো টিকে আছে এই তাঁত শিল্প৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুমিল্লার খাদি, ঝালকাঠীর গামছা নরসিংদীর লুঙ্গি ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. Mamun
12 ছবি1 | 12
লোক ও কারুশিল্পের কোন কোন ক্ষেত্রের আলাদা বিশেষত্ব আছে?
লোক ও কারুশিল্পের মধ্যে বিশেষত পোড়া মাটির হাড়ি অথবা বুননের ক্ষেত্রে যদি চিন্তা করেন শতরঞ্জি, জামদানি শাড়ি এবং বেত কেন্দ্রিক যে শীতল পাটি, তার একটা স্বকীয়তা আছে৷ কাঁসা-পিতলেরও খ্যাতি আছে৷ ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল থেকে শুরু করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসা-পিতল বললেও আলাদা একটা স্বকীয়তা আছে৷ এছাড়া দেশ-জাতির যে আবেগের কথা বলা হয়, নকশিকাঁথাই সেটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়৷
লোক ও কারুশিল্পের মধ্যে কোনটি বেশি লোকজীবনে ব্যবহৃত হয়?
লোক ও কারুশিল্পের দু'টি দিকই মানুষের জীবনে প্রয়োজন বলে মানুষ এটা সৃষ্টি করেছে৷ তাঁরা তাঁদের ব্যক্তি জীবনে, ব্যবহারিক জীবনে বা নান্দনিকতার কারণে প্রাত্যহিক জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করেন৷ আপনি যদি আলপনার কথা বলেন, দেয়াল চিত্রের কথা বলেন, তাহলে হয়ত এগুলোর ব্যবহারিক উপযোগিতা সেভাবে নেই৷ কিন্তু মননের দিক থেকে, ভালোলাগার দিক থেকেও এগুলোর উপযোগিতা কম নয়৷ আর যদি সরাসরি ব্যবহারের কথা বলেন, তাহলে কারুশিল্পগুলো আমাদের ব্যবহারিক জীবনে অনেক বেশি কার্যকর এবং প্রয়োজনীয়৷
গ্রামের অনেক লোকশিল্প লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? সেগুলো চলমান করার ক্ষেত্রে কী করা উচিত?
‘দেশ-জাতির যে আবেগের কথা বলা হয়, নকশিকাঁথাই সেটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়’
কোনো দেশ বা জাতি যদি তার শেকড়ের কথা বলে বা সেই পরিচয় বহন করে, এমনকি জাতীয়তাবোধের পরিচয় বহন করতে চায়, তাহলে এগুলোর চর্চা খুবই জরুরি৷ মূলত এটি সংরক্ষণ, সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ প্রয়োজন৷ এক্ষেত্রে সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান মূল ভূমিকা পালন করতে পারে৷ এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে যদি এ বিষয়ে পঠন-পাঠন বাড়িয়ে দেয়া যায় এবং এই বিষয়কে কেন্দ্র করে দক্ষ জনবল তৈরি করা যায়, তাহলে এর সংগ্রহ-সংরক্ষণ বৈজ্ঞানিকভাবে করা সম্ভব এবং এর বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ মানুষের কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব৷
লোকশিল্প কীভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়?
লোকশিল্প সংরক্ষণের কথা যদি বলেন তাহলে এগুলো সংগ্রহ করা হয় খুবই আবেগের সঙ্গে৷ যাঁরা সংগ্রহ করেন, তাঁরা সেটা করেন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে, ভালোলাগা থেকে৷ যদি সংরক্ষণের কথা বলেন, তাহলে আমি বলবো এখানে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে৷ আমি মনে করি, সোনারগাঁওয়ে যে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আছে, জাদুঘর আছে, সেখানে একভাবে সংরক্ষণ করা হয়, পাশাপাশি অনেকগুলো জাদুঘরেও লোক ও কারুশিল্প সংরক্ষণ করা হয়৷ এটা যদি আপনি বৈজ্ঞানিকভাবে করতে চান তাহলে প্রশিক্ষণ জরুরি৷ এ বিষয়ে আমার উত্তর, এর জন্য জ্ঞানলাভ করা জরুরি৷
সোনারগাঁওয়ের জাদুঘরের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কোনো সম্পর্ক আছে?
সোনারগাঁওয়ের জাদুঘরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঠিক সেভাবে নেই৷ আমরা যাঁরা নিজেদের আগ্রহ থেকে পরিদর্শনে যাই, খোঁজ নিতে যাই – সেটুকুই৷ আর জাদুঘর যদি কোনো আলোচনায় আমাদের ডাকে, তবে ঐটুকুই৷ এর পরিসর বাড়ানো যেতে পারে৷ আমাদের শিক্ষার্থীরা সেখানে ‘ইন্টার্নশিপ' করতে পারে৷ যাঁরা ফোকলোর নিয়ে বা লোকজ শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করেন তাঁরা ওখানে গিয়ে এই ‘ইন্টার্নশিপ' করতে পারেন, গবেষণা করতে পারেন৷ যদি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সমন্বয় থাকত তাহলে লোক ও কারুশিল্পের বৈজ্ঞানিকভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো যেত৷
এই জাদুঘরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগে পড়াশোনা করছেন, এমন শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্ক আছে কি?
আমি যতদূর মনে করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে বেড়াতে গেছেন, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক বা সমঝোতা এখনো তৈরি হয়নি৷ আমি মনে করি, আমাদের একটা চমৎকার সুযোগ আছে জাদুঘরটির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন তৈরি করার৷ শিক্ষার্থীরাও এই ফাউন্ডেশনে অবদান রাখতে পারবেন বলে আমি মনে করি৷
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন বা জাদুঘরের সঙ্গে ফোকলোর একাডেমি বা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনো আলোচনা আছে কি?
এই ফাউন্ডেশন বা জাদুঘরের যে সম্পদ, অবকাঠামো বা ব্যবস্থাপনা আছে – তা দেখে আমি সত্যিই বিমোহিত৷ এখানে ফোকলোর একাডেমি বা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা সম্ভব৷ এতে নতুন করে কোনো বরাদ্দ না-ও লাগতে পারে৷ শুধু নামকরণ ও কাজ শুরু করা গেলে আমাদের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্র তৈরির যে সীমাবদ্ধতা আছে তা অনেকখানি পূরণ করা যাবে৷
বাংলাদেশের এই শিল্প বিশ্বজুড়ে কতটা আলোচনায় আছে? কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কার আছে কি?
বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প বিশ্বখ্যাত৷ বিশেষ করে আপনি যদি মসলিনের কথা বা জামদানির কথা অথবা শীতল পাটির কথা বলেন, তাহলে দেখবেন এর একটা আলাদা স্বকীয়তা আছে, পরিচিতি আছে৷ আপনি হয়ত শুনেছেন, খুব সম্প্রতি শীতল পাটি ও জামদানিকে সাংস্কৃতিক ঐহিত্য হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে৷ আমি মনে করি, ইউনেস্কো যখন এই স্বীকৃতি দেয় তখন এগুলোর মর্যাদা অনেকগুণ বেড়ে যায়৷ এমন অনেক আরো শিল্প আমাদের আছে, যেগুলো ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে ঢুকতে পারে৷ তাই আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে৷
শিল্প সংরক্ষণে সরকারিভাবে আর কি কিছু করার আছে?
সরকারের অনেক কিছু করার আছে৷ সরকার চাইলেই একটি লোকজ সাংস্কৃতিক অধিদপ্তর করতে পারে৷ চাইলে সরকার তার বাজেটের মধ্যে এর বিকাশে বরাদ্দ রাখতে পারে৷ চাইলে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে পারে৷ চাইলে আলাদাভাবে মনিটরিং বা নজরদারি করতে পারে৷ সরকার চাইলে আরো যেটা পারে, সেটা হলো দেশের কলেজগুলোতে বা পিএসসিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে লোকজ সংস্কৃতি বা ফোকলোর বিষয়ে যাঁদের জ্ঞান আছে তাঁদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে৷
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও বিচিত্র কয়েকটি মেলা
বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ গ্রামীণ মেলা৷ বিভিন্ন পালা পার্বণকে কেন্দ্র করে বছরজুড়ে প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ছোট-বড় গ্রামীণ লোকজ মেলা বসে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে৷ কয়েকটি গ্রামীণ মেলা দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লোক ও কারুশিল্প মেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে প্রতি বছর মাসব্যাপী বসে লোককারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব৷ সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে প্রতি বছর এ মেলা শুরু হয় জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এ লোকজ মেলায় দেশের বিভিন্ন এলাকার সব রকম লোকজ সংস্কৃতি ও কুটির শিল্প সামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হন শিল্পীরা৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বৈশাখী মেলা
এটি মূলত সার্বজনীন লোকজ মেলা৷ বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বাংলাদেশের সর্বত্রই আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার৷ নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে এ বৈশাখী মেলা৷ স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলার মূল আকর্ষণ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাস মেলা
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের দুবলার চরে প্রতিবছর কার্তিক-অগ্রহায়নের পূর্ণিমা তিথিতে বসে রাসমেলা৷ অনেক হিন্দু পুন্যার্থী আর পর্যটক এ উৎসবে শামিল হতে দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন৷ এ উপলক্ষ্যে পাঁচ দিনের একটি মেলাও মেলা বসে দুবলার চরে৷ মেলাটি চলে আসছে ১৯২৩ সাল থেকে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লাঙ্গলবন্দের মেলা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের ব্রহ্মপুত্র নদে সনাতন ধর্মাবলমম্বীরা চৈত্র মাসের শুক্লাষ্টমী বা অশোকাষ্টমী তিথিতে পুণ্যস্নানের জন্য সমবেত হন৷ এ উপলক্ষে তিন দিন ব্যাপী মেলা বসে ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
গুড়পুকুরের মেলা
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এ মেলাটি ৩০০ বছরেরও বেশি৷ বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ চলে একমাস৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
পোড়াদহের মেলা
গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ি এলাকায় ইছামতি নদীর তীরে আড়াইশ বছর ধরে বসে ব্যতিক্রমী এক মেলা৷ প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার বসে দুই দিনের এ মেলা৷ এ মেলার মূল আকর্ষণ বড় বড় আকৃতির নানা রকম মাছ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাশ লীলার মেলা
মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর আদমপুরে কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালিত হয় মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব রাস লীলা৷ এ উপলক্ষে তিন দিনের মেলা বসে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুরের সনাঠাকুর মণ্ডপ এলাকায়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রথের মেলা
সাধারণত বাংলা বছরের আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রথের মেলা বসে৷ সবচেয়ে বড় রথের মেলা বসে সাভারের ধামরাইয়ে৷ এছাড়া কুষ্টিয়ার রথখোলার মেলা, রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা, সিলেটের লামাপাড়া রথযাত্রার মেলা উল্লেখযোগ্য৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লালন মেলা
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার ছেঁউড়িয়া গ্রামে মরমী শিল্পী লালন সাঁইয়ের সামাধিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর দুইবার লালনমেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ তার একটি হচ্ছে লালন সাঁইজির তিরোধান তিথি উপলক্ষে এবং অন্যটি দোলপূর্ণিমায় লালন প্রবর্তিত সাধুসঙ্গ উপলক্ষে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
মধু মেলা
যশোরজেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়িতে প্রতি বছর বসে সপ্তাহব্যাপী মধু মেলা৷ বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হয় এ মেলার আয়োজন৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বটতলায় বৌমেলা
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে চারশ’বছরের পুরানো একটি বট গাছকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে পালিত হচ্ছে বউ মেলা৷ বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীরা পরিবারের সুখ শান্তি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করে এখানকার বট গাছকে পূজা করেন৷ এ উপলক্ষে পাঁচদিনের মেলাও বসে বট গাছের চারপাশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
11 ছবি1 | 11
এই শিল্প সংরক্ষণ ও বিকাশে আপনার পরামর্শ কী?
প্রায় ২০ বছর হলো, আমি ফোকলোর স্টাডিজ পড়ছি-পড়াচ্ছি৷ এতে করে মনে হচ্ছে এই বিষয়টির পঠন-পাঠন আরো জনপ্রিয় করা দরকার৷ মেধাবীদের এই পঠন-পাঠনে এগিয়ে আসা দরকার৷ এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফোকলোর-এর পঠন-পাঠন বাড়িয়ে দিতে পারে৷ স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে৷ যেমন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে৷ আর তা হলো, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ফোকলোর স্টাডিজ হিসেবে পৃথক একটি বিভাগ চালু করেছে৷ এরপর কবি নজরুল ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা চালু হয়েছে৷ এবার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও যদি চালু করা যায় তাহলে দক্ষ জনবল তৈরি হবে আর প্রয়োগিক দিকটাও আমরা কাজে লাগাতে পারব৷ আমি বলব, দেশকে ভালোবাসুন, আমাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসুন৷ লোকজ সংস্কৃতি আমাদের জাতীয়তাবোধের পরিচয় বহন করে, এটা আমাদের মানসিক শক্তি দেয়, এগিয়ে যাবার প্রেরণা দান করে৷
এই সাক্ষাৎকারটি নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷