২৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক দেশগুলির সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এক নতুন নজির সৃষ্টি করতে চলেছে বিজেপি৷ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য সার্কভুক্ত পড়শি দেশগুলির সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে হবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক অভূতপূর্ব নজির রাখলেন৷ দিল্লির কূটনৈতিক মহল মনে করছেন, ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে মৈত্রীর একটা তাজা হাওয়া আনতে চাইছেন মোদী৷
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক বাধাগুলি কার্পেটের তলায় না রেখে প্রথম দিন থেকেই তার মুখোমুখি হওয়া জরুরি৷ আগেকার কংগ্রেস জোট সরকার সেভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷ ভারতের নেতৃত্বে এই অঞ্চলকে সংঘবদ্ধ করে এক আর্থিক কেন্দ্রে পরিণত করার যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছে বিজেপি সরকার৷ শুধু উন্নত দেশগুলির সহযোগিতা যথেষ্ট নয়৷
তবে মোদীর মূল লক্ষ্য পাকিস্তানের সঙ্গে মোদী সরকারের তাল মিলটা কেমন হতে পারে – এই সুযোগে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তা ঝালিয়ে নেয়া৷ বিশেষ করে মোদী-নওয়াজ শরিফের ‘কেমিস্ট্রিটা' কেমন হতে পারে৷ বিজেপির প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর সঙ্গে নওয়াজ শরিফের রসায়ন অনুকূল ছিল বলেই বাজপেয়ী লাহোর শান্তি সফরে গিয়েছিলেন দু'দেশের সম্পর্কটা সদর্থক করতে৷ কিন্তু তা ভেস্তে দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক কর্তারা কারগিল যুদ্ধ শুরু করে৷
তাই এবারে মোদীর আমন্ত্রণে নওয়াজ শরিফ পড়েছেন উভয় সংকটে৷ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও সামরিক কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে স্বেচ্ছায় আসতে পারা তাঁর পক্ষে মুশকিল৷ সামরিক কর্তাদের উপেক্ষা করার শক্তি নেই তাঁর৷ ভারত-পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্ব অনেকবার বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চাইলেও সামরিক বাহিনীর চাপে পাকিস্তান তাতে এগোতে পারেনি৷ তবে জার্মান বার্তাসংস্থা ডিপিএ শনিবার জানিয়েছে, ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ নওয়াজ শরিফ গ্রহণ করেছেন এবং শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
অন্যদিকে মোদী নিজে ফাঁপরে পড়েছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসকে আমন্ত্রণ জানিয়ে৷ দক্ষিণী রাজ্য তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক দলগুলি এতে বেজায় খাপ্পা মোদীর ওপর৷ শ্রীলঙ্কার তথাকথিত তামিল নিধনে রাজাপাকসের ভূমিকা থাকার অভিযোগে তামিল জনমানসের ক্ষত এখনো শুকায়নি৷ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মোদী কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা৷ একই সুর বিজেপি সহযোগী এমডিএমকে নেতার৷ বিজেপির তরফে অবশ্য বিষয়টিকে হাল্কা করার জন্য বলা হয়েছে, রাজাপাকসেকে আমন্ত্রণ জানানোর অর্থ সেখানকার তামিল জনগোষ্ঠীর অধিকারের সঙ্গে আপোষ করা নয়৷ করুণানিধির ডিএমকে দলের মতে, তামিল নিধনযজ্ঞ আর আমন্ত্রণ একসঙ্গে চলতে পারে না৷ তামিল আবেগকে মাথায় রেখে মনমোহন সিং শ্রীলঙ্কায় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যাননি৷ বিপুল জনাদেশে জয়ী মোদী পররাষ্ট্র নীতিতে অন্য দলের ছড়ি ঘোরানো বরদাস্ত করবেন না এটাই বোঝাতে চেয়েছেন৷
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা৷ তিস্তা জল বণ্টন চুক্তি এবং স্থলসীমা চুক্তি প্রায় হয়েই আছে, শুধু সরকারি শিলমোহর পড়া বাকি৷ তবে স্থলসীমা চুক্তির ক্ষেত্রে কিছু প্রকরণগত প্রক্রিয়া বাকি৷ যেহেতু সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ড হস্তান্তরের প্রশ্ন আছে তাই সংবিধান অনুযায়ী সংসদের অনুমোদন জরুরি৷ নতুন সংসদে বিজেপির যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, তাই অন্য দলের বিশেষ করে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের তৃণমূলের সমর্থন না পেলেও মোদী দমবার পাত্র নন৷