দৈত্য বললে ভারতীয় বোঝে হিংসুটে দৈত্যের কাহিনি৷ শব্দও যে দৈত্য হতে পারে, হৃদয়বিদারক শব্দে যে শরীর মন অচল হয়ে পড়তে পারে, আম ভারতীয়দের এখনো সেই ধারণা তৈরিই হয়নি৷ তাই শব্দদূষণ নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই৷
বিজ্ঞাপন
ঘটনা এক
‘আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় প্রতিদিন৷ এটা মেনে নেওয়া যায় না৷’
কয়েকমাস আগে এই মর্মেই টুইট করেছিলেন ভারতের এক বিখ্যাত গায়ক সনু নিগম৷ যা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল দেশ জুড়ে৷ অনেকেই সনুকে সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দিয়েছিলেন৷ নিজের সপক্ষে অবশ্য যুক্তিও তৈরি করেছিলেন সনু৷ তাঁর বক্তব্য ছিল, আজান নিয়ে তাঁর কোনো সমস্যা নেই৷ বস্তুত, আজানের সুর তিনি পছন্দ করেন৷ কিন্তু যেভাবে প্রতিদিন ভোরে তাঁর বাড়ির পাশে ফাটা টোঙে আজান বেজে ওঠে, তার সঙ্গে সুরের কোনো সম্পর্ক নেই৷ এটা একপ্রকার শব্দদূষণই বটে৷ বিতর্ক অবশ্য থেমে থাকেনি৷ চলেছে নিজের তালে৷ থেমেও গিয়েছে সময়ের দাবিতে৷
কোন শহরে কেমন শব্দদূষণ?
বিশ্বের ৫০টি শহরের প্রায় দুই লক্ষ মানুষের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করে একটি তালিকা তৈরি করেছে বার্লিনের কোম্পানি ‘মিমি হিয়ারিং টেকনোলজিস’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Becker
সবচেয়ে বেশি দূষণ গুয়াংজুতে
চীনের এই শহরে শব্দদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি বলে এক জরিপে জানা গেছে৷ বার্লিনের কোম্পানি ‘মিমি হিয়ারিং টেকনোলজিস’ বিশ্বের ৫০টি শহরের মানুষের শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করে একটি তালিকা তৈরি করেছে৷
ছবি: CC/Karl Fjellstorm, itdp-china
এরপর দিল্লি
তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শব্দদূষণের শিকার শহর হিসেবে আছে ভারতের রাজধানীর নাম৷ ভারতেরই আরেক শহর মুম্বইয়ের নাম আছে চার নম্বরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Tyagi
শীর্ষ দশে দু’টি ইউরোপীয় শহর
মিমি হিয়ারিং টেকনোলজিস তাদের পাওয়া তথ্যের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও নরওয়ের একটি গবেষণা সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড হিয়ারিং ইন্ডেক্স’ নামের একটি তালিকা তৈরি হয়েছে৷ সেখানে সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার ১০টি শহরের মধ্যে ইউরোপের দু’টি শহর আছে৷ সেগুলো হচ্ছে, বার্সেলোনা (৭) আর প্যারিস (৯)৷ তালিকাটি দেখতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture-alliance/Prisma/Raga Jose Fuste
শীর্ষ দশের অন্যরা
সবচেয়ে খারাপ অবস্থার দশটি শহরের মধ্যে বাকিগুলো হচ্ছে কায়রো (৩), ইস্তাম্বুল (৫), বেইজিং (৬), মেক্সিকো সিটি (৮) ও বুয়েনস আইরেস (১০)৷
ছবি: Getty Images/K. Desouki
সবচেয়ে নীরব
সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহর শব্দদূষণের মাত্রা সবচেয়ে কম৷ এর পরেই আছে ভিয়েনা, অসলো, মিউনিখ ও স্টকহোম৷ অর্থাৎ সবচেয়ে কম শব্দদূষণ হওয়া পাঁচটি শহরই ইউরোপের৷
ছবি: picture-alliance/prisma/Etienne
জার্মানির চার শহর
শব্দদূষণ সবচেয়ে কম এমন ১০ শহরের মধ্যে জার্মানির শহর আছে সর্বোচ্চ চারটি৷ তালিকায় মিউনিখ ছাড়াও আছে ড্যুসেলডর্ফ (৬), হামবুর্গ (৭) ও কোলনের (৯) নাম৷ সবমিলিয়ে ৫০টি শহরের মধ্যে জার্মানির আরও চারটি শহর রয়েছে৷ সেগুলো হচ্ছে, স্টুটগার্ট, বার্লিন, হ্যানোভার ও ফ্রাংকফুর্ট৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/S. Ziese
তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি শহর
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হয় লস অ্যাঞ্জলসে (৩৩)৷ আর সবচেয়ে কম হয় পোর্টল্যান্ডে (৮)৷ বাকি শহরগুলো হচ্ছে নিউ ইয়র্ক (১৯), হিউস্টন (২১), শিকাগো (২৪) ও সান ফ্রান্সিস্কো (২৬)৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. C. Hong
যুক্তরাজ্যের পাঁচ
এগুলো হলো লিভারপুল (১২), গ্লাসগো (১৬), বার্মিংহাম (২৫), লন্ডন (২৭) ও ম্যানচেস্টার (৩০)৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/McPhoto
8 ছবি1 | 8
ঘটনা দুই
বিহারের গয়ার অনতি দূরে বুদ্ধগয়া৷ কেউ কেউ যাকে বোধগয়াও বলে থাকেন৷ মূলত বৌদ্ধদের জায়গা৷ এখানেই বোধীবৃক্ষের তলায় বসে গৌতম বুদ্ধ বোধী লাভ করেছিলেন বলে কথিত৷ এখন সেখানে বিশালাকার বুদ্ধমন্দির এবং মঠ৷ সারা পৃথিবীর বৌদ্ধেরা বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে নানা অনুষ্ঠান উদযাপন করেন এই মঠে৷ বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন দু’দিন ধরে বিপুল অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়৷ সকালে শান্তি প্রার্থনার পর বিকেলে আয়োজন হয় বিশাল প্রদীপ মিছিলের৷ হাজার হাজার বৌদ্ধ নিঃশব্দে যোগ দেন সেই মিছিলে৷ মঠ পরিক্রমা হয়৷ পিনপতনের নিস্তব্ধতা মাঝে মাঝে ভঙ্গ হয় ‘ওম মনি পদ্মে হুম’ শ্লোক উচ্চারণে৷ অথচ সামান্য এই নিরবতাও পছন্দ নয় অনেকের৷ পার্শ্ববর্তী শংকরাচার্যের আশ্রমে ঠিক সেই সময়েই শুরু হয় অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন৷ ফাটা চোঙে তীব্র শব্দে যা বাজে, তাকে ‘ব্যঙ্গকীর্তন’ বলাই অনেক বেশি শ্রেয়৷ নামকীর্তনের মধুরতার ‘ম’টুকুও থাকে না সেখানে৷ অনেকেই বলেন, বৌদ্ধ মঠের উৎসবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যই নাকি সেখানে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে দেওয়া হয়৷
ব্লো হর্ন প্লিজ
পাল্লা৷ ভারতের শব্দদূষণের গোড়ার কথাই সম্ভবত পাল্লা দেওয়া৷ রাস্তায় একটি গাড়ি একবার হর্ন বাজালে, দ্বিতীয় গাড়িটিকে পাল্লা দিতেই দু’বার হর্ন বাজাতে হয়৷ যা শুনে তৃতীয় গাড়ি চক্রবৃদ্ধিহারে হর্ন বাজাতে শুনে করে৷ শেষপর্যন্ত যার পরিনামে রাস্তায় যা ঘটে, তাকে এককথায় ক্যাকোফোনি বলা যায়৷ কোনো একটি শহরে নয়, ভারতের সর্বত্র একই ছবি৷ হর্ন বাজানো যে অন্যায়, শব্দদূষণ যে একটা সমস্যা, এর ফলে মানুষের যে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, এই সাধারণ ধারণাটাই নেই অধিকাংশ মানুষের৷ বরং শব্দ করাই যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তা সে বাজিই হোক অথবা মাইক, হর্ন হোক অথবা উচ্চৈস্বরে চিৎকার৷ গাড়ির পিছনে ‘ব্লো হর্ন’ লেখাই তাই ভারতের স্বাভাবিক প্রবণতা৷
শব্দদূষণের নানান উৎস
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেল শব্দে সাময়িকভাবে শ্রবণশক্তি নষ্ট আর ১০০ ডেসিবেলে চিরতরে তা হারাতে হতে পারে৷ অথচ রাজধানী ঢাকার অনেক জায়গাতেই শব্দ ১০৭ ডেসিবেল পর্যন্ত ওঠে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
যত্রতত্র মাইকের ব্যবহার
ঢাকা শহরে উচ্চ শব্দের মাইকের ব্যবহারে আইনি বিধিনিষেধ থাকলেও বাস্তবে তা মানা হয় না৷ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নানা কারণে ঢাকায় ব্যবহৃত হয় উচ্চ শব্দের মাইক৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
রাজনৈতিক সমাবেশ
ঢাকায় শব্দ দূষণের অন্যতম কারণ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ৷ এসব সমাবেশে প্রচুর মাইকের ব্যবহার হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাবেশস্থল থেকে আশপাশের অনেকটা এলাকা জুড়ে মাইক স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ধর্মীয় অনুষ্ঠান
শব্দ দূষণের আরেক কারণ বিভিন্ন ধর্মের নানান অনুষ্ঠান৷ এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ওয়াজ মাহফিল৷ শহরের বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়৷ হিন্দু ধর্মের নানান অনুষ্ঠানেও গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ওপেন কনসার্ট
ঢাকা শহরের নানান এলাকায় বিভিন্ন দিবস উপলক্ষ্যে ওপেন এয়ার কনসার্টের আয়োজন করা হয়৷ সেখানে ব্যবহৃত হয় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাউন্ড সিস্টেম৷ তাতেও ভয়ঙ্কর শব্দ দূষণ হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
হাইড্রোলিক হর্ন
ঢাকার শব্দ দূষণের আরেক কারণ বিভিন্ন বাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার৷ হাইকোর্টের রায়ে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবে খুব একটা মানা হয় না৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
অযাচিত হর্ন
ঢাকা শহরে চালকরা অপ্রয়োজনে প্রচুর হর্ন বাজান৷ এমনকি যানজটে আটকে থাকলেও অনেক চালককে হর্ন বাজাতে দেখা যায়৷ ফলে ভয়াবহ শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লক্করঝক্কর পরিবহন
ঢাকা শহরের বাসগুলোর বড় একটা অংশই বহু বছরের পুরনো৷ ফলে এসব বাহনের ইঞ্জিন থেকে অস্বাভাবিক উচ্চ শব্দের সৃষ্টি হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
ভবন নির্মাণ
ঢাকা শহরের সর্বত্রই বছরজুড়ে চলে ভবন নির্মাণকাজ৷ প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিকট শব্দে রড কাটা, ইট-পাথর ভাঙার কাজ হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
লোড শেডিংয়ে জেনারেটর
ঢাকা শহরে সারা বছর, বিশেষ করে গ্রীষ্ম মৌসুমে লোড শেডিং একটি বড় সমস্যা৷ এ সময়ে বিভিন্ন এলাকায় উচ্চ শব্দের জেনারেটরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয়৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
শিল্প কারখানা
শিল্প কারখানা কারখানা থেকেও সৃষ্টি হয় শব্দ দূষণ৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
10 ছবি1 | 10
দিল্লি কা লাড্ডু
২০১১ সালে সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সংক্ষেপে সিএসই একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল৷ বিশ্বের ৫০টি শহরের ২০ হাজার মানুষের থেকে স্যাম্পল জোগাড় করে তারা একটি সার্ভে করে৷ যেখানে দেখা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শব্দ দূষণে আক্রান্ত শহরগুলির মধ্যে দিল্লি অন্যতম৷ খুব পিছনে নেই মুম্বইয়েও৷ তাদের রিপোর্ট বলছে, শ্রবণসমস্যায় আক্রান্ত দিল্লির ৬৪ শতাংশ মানুষই আসলে শব্দদূষণের শিকার৷ শুধু তাই নয়, তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, দিল্লির অধিকাংশ জায়গায় শব্দমাত্রা ১০৫ ডেসিবল৷ অথচ, সাইলেন্স জোনে ডেসিবলের মাত্রা হওয়ার কথা ৫০, এবং রেসিডেন্সিয়াল অঞ্চলে শব্দমাত্রা ৫৫ ডেসিবল হওয়ার কথা৷ অর্থাৎ, স্বাভাবিকের চেয়ে শব্দমাত্রার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ৷ অথচ কারও সে বিষয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই৷ এর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেই মানসিকতাটিই প্রশাসনের গড়ে ওঠেনি৷ শুধু সিএসই নয়, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন বা হু’র রিপোর্টেও সম্প্রতি বলা হয়েছে, ভারতের প্রায় ছ’শতাংশ মানুষ শ্রবণসমস্যায় আক্রান্ত৷ এবং যার পুরোটাই শব্দদূষণের কারণে৷ ৩৩০ কোটি মানুষের দেশে ছ’শতাংশ কিন্তু নেহাত কম সংখ্যা নয়৷ এবং এ হারে শব্দদূষণ চলতে থাকলে সখ্যাটা অচিরেই দুই অঙ্কে গিয়ে পৌঁছবে৷ অন্তত তেমনই আশঙ্কা হু’য়ের৷
পিছিয়ে নেই কলকাতা, চেন্নাই
২০১৭ সালের মে মাসে সংসদের রাজ্যসভায় পরিবেশ মন্ত্রক একটি রিপোর্ট পেশ করে৷ তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী অনিল মাধব ডেভ রিপোর্টটি পড়েও শোনান৷ যেখানে বলা হয়েছে, ভারতের সাতটি মেট্রোপলিটান শহরে একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল সরকারের তরফ থেকে৷ যার মধ্যে ছিল, মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ এবং লখনউ৷ কেন্দ্র এবং রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রক এবং দফতর একত্রে সেই সমীক্ষা চালায়৷ প্রতিটি শহরে শব্দমাত্রা মাপার জন্য ৭০টি করে যন্ত্র বসানো হয়েছিল৷ দেখা গেছে, প্রতিটি শহরেই শব্দমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি৷ যার কারণ হিসেবে পরিবেশ মন্ত্রক জানিয়েছিল, অত্যধিক গাড়ির হর্ন, মাইকের ব্যবহার এবং বাজি শব্দদূষণের অন্যতম কারণ৷ অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না৷ ভারতীয় আইনে স্পষ্ট করেই শব্দের মাত্রা উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে৷ সেখানে গাড়ির হর্ন থেকে শুরু করে বাজির ব্যবহার কিংবা এয়ারকন্ডিশনারের আওয়াজ, সবকিছুরই উল্লেখ আছে৷
একনজরে আইন
১৯৮৬ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, গাড়ির হর্ন, জেনারেটর সেট, এয়ারকন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর এবং বেশকিছু কনস্ট্রাকশন যন্ত্র নির্দিষ্ট শব্দমাত্রার বেশি হতে পারবে না৷ শব্দ বেশি হলে সেগুলি বাজারে বিক্রি হওয়ার ছাড়পত্র পাবে না৷ কেউ তা ব্যবহার করলেও জরিমানা দিতে হবে৷
শব্দদূষণ স্বাস্থ্যের যেসব ক্ষতি করে
শব্দদূষণ দেশ, কাল, স্থান ভেদে অন্য সমস্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সমস্যাটিও বড় করে তুলছে৷ যেমন একটানা গাড়ির শব্দ কিংবা উচ্চ শব্দের গান হৃদরোগের ঝুঁকি, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপ বাড়ানো ছাড়াও নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Chromorange
গানের শব্দ
প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তেমনি তার কাছে শব্দের মাত্রার গ্রহণযোগ্যতাও ভিন্ন৷ উচ্চ শব্দের গান কারো কারো জন্য ভীষণ বিরক্তিকর৷ অন্যদিকে সেই গান খুব জোরে বাজালেও যথেষ্ট জোরে নয় বলেও কেউ কেউ মনে করেন৷ আসলে শব্দের মাত্রার ব্যাপারটি অনেকটাই ব্যক্তিগত পছন্দ বা ভালোলাগার ব্যাপার৷
ছবি: Colourbox/P. van Dam
যানবাহনের শব্দ
যানবাহনের শব্দও কারো কাছে কষ্টের বা বিরক্তিকর, আবার কারো কারো হয়ত তেমন খারাপ লাগে না৷ যদিও জার্মানিতে গাড়ি চলার মৃদু শব্দ হলেও হর্ণ শোনা যায় না বললেই চলে৷ তারপরও নাকি জার্মানিতে প্রতি তিন জনের দু’জনই এ দেশের ৪০ মিলিয়ন গাড়ির শব্দে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত৷ এই তথ্য জানা গেছে জার্মানির পরিবেশ বিষয়ক এজেন্সির করা এক জরিপ থেকে৷
ছবি: Getty Images/S. Gallup
শব্দের মাত্রা
জার্মানির খুব ব্যস্ত রাস্তার শব্দ মাত্রার স্তর ৭০ থেকে ৮০ ডেসিবেল, আর ট্রাক চললে তা হয় গড়ে ৯০ ডেসিবেল৷ আর বিমান যাত্রা শুরু করার সময় শব্দের মাত্রা হয় সাধারণত ১২০ থেকে ১৩০ ডেসিবেল৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, শব্দের এই মাত্রা মানুষের সহ্য ক্ষমতার মধ্যে৷
ছবি: picture-alliance/epa/Bombardier
কানের ক্ষতি
শব্দের মাত্রা ১২০ ডেসিবেলের বেশি হলেই নাকি মানসিকভাবে অস্থির হতে পারে যে কেউ৷ কানের ক্ষতি বা শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে ৷ তাছাড়া কানের দু’ পাশের চুলের কোষগুলো নষ্ট হয়ে কানে কম শোনার ঝুঁকি বাড়ায়৷ আর ধীরে ধীরে শব্দ খুব ভালো করে বোঝার শক্তি কমিয়ে দেয়৷ তবে নিয়মিত হেডফোন ব্যবহারেও এমনটা হতে পারে কিন্তু !
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Frantisek
টিনিটাস
নিয়মিত কানে জোরে জোরে শব্দ গেলে ‘টিনিটাস’ বা কানে ভো ভো শব্দ হয় এ রকম অসুখও হতে পারে৷ যাঁরা নিয়মিত প্লেনে লম্বা ভ্রমণ করে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/McPhotos
হৃৎপিণ্ড
তীব্র শব্দ শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে দূর্বল করে দেয়৷ আর সেকারণেই হৃদরোগ, মাথা ঘোরার মতো অসুখের ঝুঁকিও বাড়ে৷ এবং রাতে যদি শব্দ ৫৫ ডেসিবেলের বেশি হয়, তাহলে ঘুমের সমস্যা হয়৷ আর নিয়মিত এমনটা হলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়৷
ছবি: Colourbox/Monkey Business Images
ডাক্তারের পরামর্শ
যাঁদের বড় রাস্তার পাশে বাড়ি, তাঁরা যদি শব্দের কারণে রাতে ঘুমাতে না পারেন, তাঁদেরকে কানে তুলো বা শব্দ না শোনার জন্য বিশেষ ধরনের ইয়ার প্লাগ পাওয়া যায়, সেটা লাগিয়ে রাখার পরামর্শ নাক, কান গলার রোগ বিশেষজ্ঞ পেটার রেনারের৷
ছবি: picture-alliance/OKAPIA KG Germany/Jeffrey Telner
কানের জন্য ‘অ্যাপ’
কান কতটা খারাপ বা কান সম্পূর্ণ সুস্থ কিনা তা জানতে চাইলে যে কেউ স্মার্ট ফোনের ‘মিমি’ অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন৷ অ্যাপটি যে কেউ ডাউনলোড করে নিতে পারেন বিনা মূল্যে৷ স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাপটি তৈরিতে সহায়তা করেছে জার্মানির স্বাস্থ্য বীমা কোম্পানী বার্মার জিইকে৷
ছবি: picture-alliance/PhotoAlto/F. Cirou
জার্মানিতে যখন-তখন শব্দ করা যায় না
বাড়ির ভেতরে ড্রিল মেশিন বা বাগানে ঘাস কাটার যন্ত্র বা জোরে শব্দ হয় এমন কোনো মেশিন জার্মানিতে রবিবার বা ছুটির দিনে নিজের বাড়িতেও ব্যবহার করা নিষেধ৷ তাছাড়া প্রতিদিন দুপুর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আবাসিক এলাকায় জোরে শব্দ করা যায় না৷ রাত দশটার পরে তো একেবারেই শব্দ করা যাবে না৷ যদি কেউ করে, তাহলে অন্য প্রতিবেশীদেরও পুলিশকে ডাকার অধিকার রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Goldmann
সকলে মিলে আনন্দ
তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন বা সেরকম কোনো পার্টির আয়োজন করা হলে, অনেক সতর্ক জার্মান আগে থেকে প্রতিবেশীদের সেকথা জানিয়ে রাখেন৷ অনেকে আবার এরকম পরিস্থিতিতে পুলিশের ঝামেলা এড়াতে প্রতিবেশীদেরও দাওয়াত দেন৷
ছবি: Fotolia/pressmaster
10 ছবি1 | 10
১৯৮৯ সালের কেন্দ্রীয় মোটরভেহিক্যাল আইনেও স্পষ্ট বলা হয়েছে, অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ব্রিগেড এবং পুলিশের গাড়ি ছাড়া প্রেশার হর্ন বা এয়ার হর্ন ব্যবহার করা যাবে না৷ করলে বিপুল পরিমাণ জরিমানা দিতে হবে৷ বাজি ফাটানোর ক্ষেত্রেও ১৯৮৬ সালের আইনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, বাজি ফাটানো এবং মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ডেসিবল রক্ষা করতে হবে৷ রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে কোনো কিছুই ব্যবহার করা যাবে না৷ আইনভঙ্গ করলে জরিমানা তো হবেই, জেলও হতে পারে৷ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, কলকাতা হাইকোর্ট বহুকাল আগে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ ডেসিবল বেঁধে দিয়েছিল৷ ভারত সরকারের সর্বোচ্চ ডেসিবল থেকেও যা সামান্য কম৷
কে শোনে কার কথা
আইন আছে আইনের মতো৷ তিনদশক আগের আইন এখনো পর্যন্ত পালিত হয়েছে, এমন অভিযোগ নেই৷ আই আছে আইনের মতো৷ প্রতি বছর গ্রিন ট্রাইবুনালে বিষয়গুলি নিয়ে মামলা হয়৷ কিন্তু কাজের কাজ হয় না৷ কারণ, আইন মান্য করার মানসিকতাই গড়ে ওঠেনি সাধারণ ভারতীয়দের মধ্যে৷ ফলে আইনের ফাঁক গলে লাগাতার শব্দদূষণের উৎসব আগেও চলেছে, এখনো চলছে৷ প্রশাসন কার্যত নীরব দর্শক৷
কান তো গেছেই, ফুসফুসও
শব্দ দেখা যায় না, চাক্ষুস করা যায় না তার ক্ষতি, তাই এযাবৎ শব্দদূষণ নিয়ে পরোয়া করেনি আম ভারতীয়৷ সমস্যা হল, বাতাস দূষিত হলে তা দেখা যায়৷ ইদানীং সেই দূষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত দিল্লিবাসীর৷ শীতের শুরুতে ধোঁয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে দিল্লির বায়ুমণ্ডল৷ যার জেরে স্কুল কলেজ ছুটি দিয়ে দিতে হচ্ছে৷ বিষাক্ত ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে৷ মাস্ক পরে ঘুরতে হচ্ছে সকলকে৷ তাই ঠেকে শিখে আইন মানতে হচ্ছে দিল্লিবাসীকে৷ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে, দেওয়ালির সময় বাজি ফাটানো যাবে না৷ যদিও এর সঙ্গে ধর্মীয় ঐতিহ্যের সম্পর্ক খুঁজে বার করে প্রতিবাদও করেছে কোনো কোনো গোষ্ঠী৷ রাজনৈতিক দলগুলিও কার্যত নিশ্চুপ থেকেছে৷ তবে ঠ্যাকায় পড়েই এবার দেওয়ালিতে আগের চেয়ে খানিক কম বাজি ফেটেছে দিল্লিতে৷ কলকাতাও খুব পিছিয়ে নেই৷ দিল্লির মতো অবস্থা না হলেও শীতের মুখে কলকাতাও ঢেকে যাচ্ছে ধোঁয়াশায়৷ পরিবেশকর্মীরা দাবি তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় কলকাতাতেও পালন করা হোক৷ কিন্তু কালীপুজোর সময় তার ছিটেফোটাও চোখে পড়েনি৷ পড়বে কী করে? সেখানকার মানুষদের যে এখনো দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না!
মূলত বায়ু দূষণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় হলেও তার জেরে বাজির শব্দতাণ্ডব খানিক কমেছে রাজধানী এবং সংলগ্ন অঞ্চলে৷ কয়েকটি এনজিও সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, গত পাঁচবছরের তুলনায় এবার দিওয়ালির সময় দিল্লির শব্দদূষণের পরিমাণ খানিকটা হলেও কমেছে৷ কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নেহাতই কম৷ পরিবেশকর্মী এবং এনজিও গুলির বক্তব্য, কড়া আইনের অনুশাসনে না আনলে শব্দদৈত্যের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না৷ ফলে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিক কেন্দ্র এবং রাজ্যসরকারগুলি৷ পশ্চিম যদি শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, পূব পারবে না কেন? এমনই স্লোগান তাদের৷
স্লোগান ফিকে হয়৷ পরিস্থিতির গোত্যন্তর হয় না৷ দূষণের ক্ষেত্রে ভারত প্রতিদিন তা প্রমাণ করে চলেছে৷