সিরিয়া থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে নেদারল্যান্ডসে এলেও ‘নিরাপদ' দেশে ওমর নিরাপদ নয়৷ অশ্লীল গালিগালাজ থেকে শুরু করে হত্যার হুমকি পর্যন্ত সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে৷ মানসিক নির্যাতন ও হত্যার হুমকি যাঁরা দিচ্ছেন তাঁরাও তার মতো শরণার্থী৷
বিজ্ঞাপন
সিরিয়ার অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান ওমর আগে থেকেই স্বপ্ন দেখতো একদিন সুযোগ পেলে নেদারল্যান্ডসে যাবেন৷ বিশ্বের সব দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডসই সবার আগে সমকামীদের বিয়েকে স্বীকৃতি দিয়েছিল৷ ওমর জানেন, ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডস প্রথম দেশ হিসেবে একটি ‘ট্যাবু' ভাঙার পর বেশ কিছু দেশই তা অনুসরণ করেছে৷ তবে অ্যামস্টারডামের ‘গে প্যারেড' এখনো বিশ্বসেরা৷ ওমর অবশেষে নকল পাসপোর্ট কাজে লাগিয়ে সেই অ্যামস্টারডামে এসে পৌঁছেছে৷
তবে সেই স্বপ্নের শহরে পৌঁছানোর কয়েকদিনের মধ্যেই স্বপ্নভঙ্গও হয়েছে তাঁর৷ ওমর নিজেও সমকামী৷ এ কারণে সিরিয়ায় জীবন কখনো সহজ, স্বাভাবিক হয়নি৷ অ্যামস্টারডামেও অবস্থার উন্নতি হয়নি৷ বরং শরণার্থীরা যখন তাঁকে চেঁচিয়ে বলে, ‘‘তুই শরণার্থীদের কলঙ্ক'', যখন তাঁকে ধাক্কা মারে তখন মনে হয়, ‘‘এ আমি কোথায় এলাম!''
২০১৫ সালে ৫৪ হাজার শরণার্থী এসেছে নেদারল্যান্ডসে৷ ওমর তাঁদের একজন৷ তিনি ভেবে পান না, যে শরণার্থীরা তাঁর মতোই অনেক দূরের এক দেশ থেকে, এত কষ্টের পথ পাড়ি দিয়ে নেদারল্যান্ডসে এসেও তাঁকে এবং তাঁর মতো সমকামীদের অপমান, নির্যাতন করতে পারেন কী করে!
বার্তাসংস্থা এএফপিকে অবশ্য স্বস্তি নিয়েই ওমর বলছিলেন, ‘‘ওরা যে আমাকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেনি, সেটাই আমার সৌভাগ্য৷'' তবে শরণার্থী শিবিরে থাকলে এতদিনে সেই দুর্ভাগ্যও হয়তো হয়ে যেত৷ সম্প্রতি ডাচ সমকামী নিজের ঘরের একটি কক্ষে থাকতে দিয়েছেন ওমরকে৷ সেই থেকে ঘরের ভেতরে অন্তত নিরাপদে থাকতে পারেছেন সিরীয় এই তরুণ৷
যেসব দেশে সমকামী বিয়ে বৈধ
এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২৩টি দেশে সমকামী বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৪টি দেশ ইউরোপের৷ তালিকায় এশিয়ার কোনো দেশ নেই৷
ছবি: Reuters/C. Tilley
নেদারল্যান্ডস
২০০১ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নেদারল্যান্ডসে সমকামী বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়৷ ছবিতে সমকামী দম্পতিকে বিয়ের পর কেক কাটতে দেখা যাচ্ছে৷ ২০১১ সালে দেশটিতে সমকামী বিয়ে বৈধ হওয়ার ১০ বছর পূর্তিতে তাঁরা বিয়ে করেন৷
ছবি: Evert Elzinga/AFP/Getty Images
ইংল্যান্ড
২০১৩ সালের জুলাইতে সমকামী বিয়ে বৈধ করে আইন পাস হয়৷ এরপর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এলটন জন তাঁর সঙ্গীকে বিয়ে করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/L. Pitarakis
ফ্রান্স
দেখছেন দেশটির প্রথম সমকামী জুটির বিয়ের ছবি৷ ২০১৩ সালের মে মাসে ফ্রান্সে এই বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়৷
ছবি: Reuters
লুক্সেমবুর্গ
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সমকামী বিয়েকে বৈধতা দেয়া হয়৷ এর চার মাস পর সঙ্গীকে বিয়ে করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাভিয়ের বেটেল (ডানে)৷
ছবি: Reuters/F. Lenoir
আয়ারল্যান্ড
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে আয়ারল্যান্ডে ২০১৫ সালের মে মাসে গণভোটের মাধ্যমে সমকামী বিয়ে বৈধ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Crawley
ইউরোপের অন্যান্য দেশ
২০০৩ সালে বেলজিয়াম, ২০০৫ সালে স্পেন, ২০০৯ সালে নরওয়ে, একই বছর সুইডেন, ২০১০ সালে পর্তুগাল, একই সময়ে আইসল্যান্ড, ২০১২ সালে ডেনমার্ক, ২০১৪ সালে ফিনল্যান্ড এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে গ্রিসে সমকামী বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Blackwood
দক্ষিণ আফ্রিকা
আফ্রিকার প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৬ সালে থেকে সমকামী বিয়ে বৈধ৷ একই সময় থেকেই তাঁরা সন্তানেরও অভিভাবক হওয়ার অনুমতি পায়৷
ছবি: dapd
আর্জেন্টিনা
ল্যাটিন অ্যামেরিকার প্রথম দেশ হিসেবে ২০১০ সালে এরকম বিয়ের বৈধতা দেয় আর্জেন্টিনা৷ এরপর ঐ মহাদেশের ব্রাজিল, উরুগুয়ে ও কলম্বিয়ায় সমকামী বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্রাজিল
ল্যাটিন অ্যামেরিকার তৃতীয় দেশ হিসেবে ২০১৩ সাল থেকে ব্রাজিলে সমকামী বিয়ে বৈধ৷ ছবিটি ঐ বছরের ৮ ডিসেম্বর তোলা৷ সেদিন প্রায় ১৩০ সমকামী জুটি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ এক অনুষ্ঠানে এতজন সমকামীর বিয়ে করার ওটিই ছিল তখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ৷
ছবি: Getty Images
যুক্তরাষ্ট্র
দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সমকামী বিয়ে বৈধ ঘোষণা করে৷ উত্তর অ্যামেরিকার ক্যানাডা ও মেক্সিকোর পাঁচটি রাজ্যেও এখন এই বিয়ে বৈধ৷
ছবি: Reuters/C. Tilley
নিউজিল্যান্ড
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের একমাত্র দেশ যেখানে ২০১৩ সালের এপ্রিলে সমকামী বিয়ে বৈধ করা হয়৷ ছবিতে নিউজিল্যান্ডের কুইন্সটাউন থেকে অকল্যান্ডগামী একটি ফ্লাইটে এমন একটি বিয়ে পড়ানোর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
11 ছবি1 | 11
অনেক সমকামীর সেই সৌভাগ্য হচ্ছে না৷ শরণার্থী শিবিরে মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এ পর্যন্ত দু'জন সমকামী আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছেন৷ একজন প্রচণ্ড শীতের রাতে শিবির থেকে বেরিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাশের এক গহীন বনে৷ এক সপ্তাহ সেখানেই ছিলেন৷ তারপর এক ডাচ পরিবার দয়াপরাবশ হয়ে ঘরে আশ্রয় দেয়ায় প্রাণে বেঁচেছেন তিনি৷
কিছু ডাচ নাগরিকও অবশ্য সমকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল নন৷ একজন তাই টুইটারে লিখেছেন, ‘‘শরণার্থীরা যতক্ষণ না নিজেদের ধর্ম চর্চা শুরু করছে, ততক্ষণ ঠিক আছে৷ আমি কিন্তু একজন খ্রিষ্টান সমকামীকেও এখানে ঠিক আশা করি না৷''
এসিবি/ডিজি (এএফপি, এপি)
শুধু সমকামী বলে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হবে? এ ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? জানান নীচের ঘরে৷
আপনার পছন্দের তারকাদের মধ্যে যাঁরা সমকামী
একটা সময় ছিল যখন কেউ নিজের সমকামিতার বিষয়টি প্রকাশ করতে ইতস্তত করতো৷ কিন্তু সময় বদলেছে৷ একে একে অনেক তারকাই এখন পর্যন্ত নিজেকে সমকামী বলে ঘোষণা করেছেন৷
ছবি: Reuters/L. Jackson
এল্টন জন
২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে সমকামী বিয়ে বৈধ হওয়ার পর ঐ বছরের ডিসেম্বরে নিজের ‘সিভিল পার্টনার’ চলচ্চিত্র নির্মাতা ডেভিড ফার্নিশকে বিয়ে করেন ‘ক্যান্ডেল ইন দ্য উইন্ড’ খ্যাত স্যার এল্টন জন৷ ১৯৭৬ সালে নিজেকে উভকামী (বাইসেক্সুয়াল) হিসেবে ঘোষণা করেন তিনি৷ এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে সমকামী হিসেবে জীবনযাপন করছেন৷ সমলিঙ্গ বিয়ে ও এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে বেশ সোচ্চার এল্টন জন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জোডি ফস্টার
১৯৭৬ সালে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবিতে শিশু পতিতা চরিত্রে অভিনয় করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী জোডি ফস্টার৷ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে এক তরুণের তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টার কথাও অনেকেই জানেন৷ সেই ফস্টার ২০১৩ সালের গোল্ডেন গ্লোব অনুষ্ঠানে তাঁর সমকামী হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেন৷
ছবি: Reuters
জর্জ মাইকেল
‘কেয়ারলেস হুইসপার’ – কে শোনেননি! ২০০৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে জর্জ মাইকেল বলেন, ‘‘আশির দশকে আমি অনেক মেয়ের সঙ্গে শুতাম, কিন্তু কখনও মনে হয়নি এটা কোনো সম্পর্কে গড়াতে পারে, কারণ আমি জানতাম, ইমোশনালি, আমি একজন সমকামী৷ আমি তাঁদের ‘কমিট’ করতে চাইতাম না, কিন্তু আমি তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম৷ তারপর আমার নিজের কাছেই নিজেকে লজ্জিত মনে হতে লাগলো, মনে হলো আমি মনে হয় তাঁদের ব্যবহার করছি৷’’
ছবি: Getty Images/Afp/Evert Elzinga
এলেন ডিজেনারেস
২০১৪ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে তোলা এই সেল্ফির কথা নিশ্চয় অনেকের মনে আছে৷ ছবিটি তুলেছিলেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা এলেন ডিজেনারেস (সাদা পোশাক পরিহিত)৷ ১৯৯৭ সালে নিজেকে সমকামী বলে ঘোষণা করেন জনপ্রিয় এই মার্কিন কমেডিয়ান, টেলিভিশন উপস্থাপিকা ও অভিনেত্রী৷ ২০০৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধ হওয়ার পর ঐ বছরই এলেন বিয়ে করেন তাঁর সঙ্গী অভিনেত্রী ও মডেল পোর্শিয়া ডি রোসিকে৷
ছবি: picture alliance/AP Images/E. DeGeneres
রিকি মার্টিন
২০১০ সালে নিজের ওয়েবসাইটে ‘‘লিভিন’ লা ভিডা লোকা’’ গায়ক রিকি মার্টিন জানান, ‘‘আমি এটা বলতে গর্ববোধ করছি যে, আমি একজন সৌভাগ্যবান সমকামী৷’’ অবশ্য তার ১০ বছর আগে তিনি তাঁর এই পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছিলেন৷ পরবর্তীতে ‘ল্যারি কিং লাইভ’ অনুষ্ঠানে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অস্বীকারের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমি যদি আগে জানতাম যে নিজের পরিচয় প্রকাশের পর কতটা ভালো লাগে, তাহলে সেটা আমি আরও আগেই করতাম৷’’
ছবি: Getty Images
সিন্থিয়া নিক্সন
‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ খ্যাত অভিনেত্রী সিন্থিয়া নিক্সন ২০১০ সালে তাঁর সমকামী হওয়ার কথাটি সবাইকে জানান৷ অবশ্য তিনি প্রথমে ‘গে বাই চয়েস’, অর্থাৎ ‘ইচ্ছে করে সমকামী’ কথাটি বলে বিতর্ক উসকে দিয়েছিলেন৷ পরে তিনি এর ব্যাখ্যা দেন এভাবে, ‘‘আমি বিশ্বাস করি উভকামিতা বিষয়টি বাস্তবতা, এখানে বাছাবাছির সুযোগ নেই৷ তবে আমি সমকামী হওয়ার বিষয়টি ‘বেছে’ নিয়েছি৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Foley
টিম কুক
জবসের পর এখন অ্যাপল সামলাচ্ছেন টিম কুক৷ ২০১৪ সালে লেখা এক প্রবন্ধে কুক সমকামী হওয়ার বিষয়টি ঘোষণা করেন৷ তিনি লিখেন, ‘‘সমকামী হয়ে আমি গর্বিত৷ আমি মনে করি, ঈশ্বর আমাকে যত সেরা উপহার দিয়েছেন তার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য একটি৷ আমার এই বক্তব্য (অ্যাপলের প্রধান একজন সমকামী) যদি অন্য কারও জন্য, যাঁরা সমকামী পরিচয় দিতে সাহস পাচ্ছেন না, অনুপ্রেরণার উৎস হয় তাহলে এই ব্যক্তিগত বিষয়টি প্রকাশ করাই যায়৷’’
ছবি: Getty Images/J. Sullivan
ইয়ান থর্প
অস্ট্রেলিয়ার হয়ে পাঁচবার অলিম্পিক সোনা জেতা সাঁতারু ইয়ান থর্প ২০১৪ সালে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে নিজের সমকামী হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার বয়স যখন ১৬ ছিল তখন থেকেই গণমাধ্যম আমাকে আমার লিঙ্গের বিষয়ে প্রশ্ন করা শুরু করে৷ তখন আমি তাদের সত্য কথাটি বলিনি৷ আজ (বয়স ৩১) আমি স্বস্তি নিয়ে বলছি যে, আমি সমকামী এবং আবার বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব সবাই বিষয়টি জানার পর আমাকে সমর্থন করেছেন৷’’
ছবি: AP
নিল প্যাট্রিক হ্যারিস
জনপ্রিয় টেলিভিশন কমেডি সিরিজ ‘হাও আই মেট ইওর মাদার’ এর স্টিনসন চরিত্রে অভিনয় করা নিল প্যাট্রিক হ্যারিস (ছবিতে ডানপাশে) ২০০৬ সালে বলেন, ‘‘আমি সমকামী, এই পরিচয় জানাতে পেরে গর্বিত৷’’ ২০১১ সালে নিউইয়র্কে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধ হওয়ার পর ২০১৪ সালে হ্যারিস তাঁ সঙ্গী বার্টকাকে (ছবিতে বামে) বিয়ে করেন৷