জার্মানি আর ইটালি আবার উৎসবের অপেক্ষায়৷ ক্রিস্টমাসের পর এবার আসছে কার্নিভাল৷ কার্নিভালে ভালো ব্যবসা করতে ‘শরণার্থী পোশাক' নিয়ে এসেছিল অ্যামাজন৷ অবশ্য সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে সেই পোশাক প্রত্যাহার করেছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সিরিয়া ও ইরাক এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরেই আসছে আলোচনায়৷ তবে এবারে যে বিষয়টি তাদের আলোচনায় এনেছে তার সঙ্গে জার্মান এবং ইটালিয়ানদের অতীতেরও একটা সম্পর্ক আছে৷ দু'টি দেশেরই আছে বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা৷ দেশ দুটিতে বিশ্বযুদ্ধের প্রজন্মের অনেক মানুষ এখনো সেই সময়ের অভিজ্ঞতার গল্প নতুন প্রজন্মকে শোনান৷ নতুন প্রজন্মের বড় একটা অংশ তাই গত এক-দেড় বছরে ইউরোপে আসা শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল৷
জুতা যতদূর নিয়ে যায়
শরণার্থীরা জার্মানির কোলন-বন বিমানবন্দরে পৌঁছালে একজোড়া করে নতুন জুতা পান৷ কয়েক’শ কিলোমিটার যাত্রার পর পুরানো জুতার অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে৷ সেই জুতার দিকে তাকালে তার মালিকের করুণ কাহিনি স্পষ্ট হয়ে উঠে৷
ছবি: Tanja Schmieder
জয়নাব, ৩৭, বাগদাদের বাসিন্দা
এই জুতাজোড়া ৪,৬০০ কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করেছে৷ এই জুতা পরে ইরাক থেকে রওয়ানা হয়ে জয়নাব প্রায় ১৮ দিন ধরে যাত্রা করেছেন৷ আদম ব্যবসায়ীদের কুখ্যাত নৌকাতেও চড়তে হয়েছে তাঁকে৷ তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে দুর্ঘটনা সত্ত্বেও সপরিবারে জীবিত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছেন তিনি৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত
জয়নাব (বামে) ও তাঁর ভাবী হায়াতের মুখে প্রায় তিন সপ্তাহের কঠিন যাত্রার ফলে ক্লান্তির ছাপ দেখা যাচ্ছে৷ তাঁরা দু’জনেই নীরব রয়েছেন৷ জয়নাবের স্বামী সালিম দাবি করছেন, যে অস্ট্রিয়া-জার্মানির সীমান্তে তাঁদের মারধোর করা হয়েছে৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
মোরতাজার, ৫, হেলমন্দ, আফগানিস্তান
যুদ্ধ ও সন্ত্রাস থেকে পালাবার সময় পছন্দ-অপছন্দের কোনো অবকাশ থাকে না৷ যেমন এই বালককে মেয়েদের জুতা পরেই ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে৷ যাত্রাপথেই কোথাও এই জুতা কুড়িয়ে পায় ছেলেটি৷ ২১ দিন ধরে সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটারেও বেশি পথ অতিক্রম করেছে মোরতাজার৷ তার মধ্যে প্রায় ১২ ঘণ্টা বরফ-ঢাকা পথ দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
হতবাক
মোরতাজারকে কোনো প্রশ্ন করলে সে ফিসফিস করে তার জবাব দেয়৷ ছেলেটির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না৷ কিন্তু তার চোখের দিকে তাকালে গভীর বেদনা ও ক্লান্তি অনুভূতি দেখা যায়৷ পাঁচ বছরের এই বালক তার বড় বোনের সঙ্গে জার্মানিতে এসেছে৷ তালেবান তাদের বাবাকে হত্যা করেছে৷ বয়সের কারণে মা এই যাত্রায় সঙ্গী হতে পারেননি৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
হাসান ইউসেফ বারাকাত, সিনজার, ইরাক
কালো, সুন্দর এই জুতোজোড়া দেখলে মনে হবে কোনো স্যুট-টাই পরা মানুষ এর মালিক৷ কিন্তু ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের হাসান ইউসেফ অতি সাধারণ জামাকাপড় পরে ইরাকের উত্তরে সিনজার থেকে রওয়ানা দিয়ে ৪,৩০০ কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করেছেন৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
নিশ্চিন্ত...
এবং উত্তেজিত হাসান ইউসেফ৷ বিমানবন্দরের তাঁবুতে ঢুকে শান্তি পেয়েছেন তিনি৷ এক সাহায্যকারীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন চেয়ে নিয়ে নিজের ভাগ্নেকে পৌঁছ সংবাদ দিলেন তিনি৷ স্ত্রীকে নিয়ে প্রায় ১৫ দিন যাত্রার পর অবশেষে জার্মানিতে পৌঁছেছেন তিনি৷ স্মৃতিশক্তিও ঠিকমতো কাজ করছে না৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
সিয়াওয়ার, হাজারাজাত, আফগানিস্তান
এই তরুণ মা বড়ই লাজুক৷ বেশি কিছু বলতে চান না৷ শুধু জানা গেছে, যে তিনি সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ৷ তালেবানের নিপীড়নে তাদের টেকাই দায়৷ ৬,৮০০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে তিনি জার্মানিতে পৌঁছেছেন৷ পায়ের আঙুল অক্ষত রাখতে মোটা মোজার উপর পাতলা স্নিকার্স পরেছেন৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
মনে ভীতি
ফটো তোলার সময়েও সাহারনাজ তাঁর মা সিয়াওয়ারকে চোখে চোখে রেখেছিল৷ বয়স মাত্র দেড় বছর৷ জার্মানিতে এসে স্ট্রলার পেয়েছে তারা৷ তার আগে মেয়েকে বেশিরভাগ সময়ে কোলে নিয়ে থাকতে হতো৷ কেন তাদের ভিটেমাটি ছাড়তে হয়েছে, ক্লান্ত ছোট্ট মেয়েটি সেটা বুঝতে পারছে না৷
ছবি: DW/N. Shtrauchler
8 ছবি1 | 8
অ্যামাজন-এর ‘শরণার্থী পোশাক' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের এবং বর্তমানের সব শরণার্থী ও তাঁদের উত্তরসূরিদেরও কষ্ট দিয়েছে, অপমান করেছে৷ এমন অনুভূতির কথা অ্যামাজনকে লিখে জানিয়েছেনও অনেকে৷ অবশেষে ‘ভুল' বুঝতে পেরে ওয়েবসাইট থেকে বিতর্কিত পোশাকগুলোর ক্যাটালগ সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন৷
জার্মানিতে ফেব্রুয়ারি মাসে আবার দেখা যাবে জমজমাট কার্নিভাল উৎসব৷ পোশাক কেনার হিড়িক শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই৷ ওদিকে ইটালিতে গত রোববার থেকে শুরু হয়েছে ভেনিস কার্নিভাল৷ এই দুই দেশের উৎসবপ্রেমীদের জন্য অভিনব এক পোশাক বাজারে ছেড়েছিল অ্যামাজন৷ বাচ্চাদের পোশাক৷ পোশাকের নাম ‘রিফিউজি কস্টিউম'৷ মডেল ছেলে-মেয়ে দু'টির হাতের স্যুটকেস দুটো দেখেই বোঝা যায়, অ্যামাজন শুধু সাম্প্রতিক সময়ের শরণার্থীদের কথা মাথায় রেখে এ সব পোশাকের ডিজাইন করেনি, ডিজাইন করার সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শরণার্থীদের কথাও মনে ছিল৷
জার্মানরাও বিষয়টি লক্ষ্য করেছে৷ তাই জলদস্যু, নভোচারি, রাজকন্যা, সুপারহিরোর মতো অতিচেনা কার্নিভাল পোশাকের সঙ্গে এবার ‘রিফিউজি পোশাক'-ও যোগ হওয়ার বিষয়টিকে তাঁরা মোটেই ভালো চোখে দেখেননি৷
তবে জার্মানি, ইটালি এবং বাইরের অনেকেও অ্যামাজন-এর পোশাকটিকে বুঝে বা না বুঝে ‘লাইক'-ও দিয়েছেন৷ তাঁদের কটাক্ষ করে কয়েকদিন আগে টুইটারে একজন লিখেছিলেন, ‘যুদ্ধকালীন শরণার্থীদের শিশুদের পোশাকের আদলে তৈরি পোশাকগুলো অ্যামাজন-এ এখনো বিক্রি হচ্ছে, বেশ কিছু নির্বোধ আবার এই উদ্যোগকে পাঁচ তারকা দিয়ে সমর্থনও জানাচ্ছে!'
অ্যামাজন অবশেষে ওয়েবসাইট থেকে পোশাকগুলোর ক্যাটালগ সরিয়ে নেয়ায় পাঁচ তারকা দিয়ে তাদের উদ্যোগকে সমর্থন জানানো কিছু মানুষ হয়ত তাঁদের ‘ভুল', ‘নির্বুদ্ধিতা' কিংবা ‘অমানবিকতার' বিষয়টি এখন বুঝতে পারছেন৷
জার্মানিতে উদ্বাস্তুদের থাকার ব্যবস্থা
২০১৫ সালে তিন লাখ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী জার্মানিতে আসবেন, বলে ধরে নিয়েছিল ফেডারাল অভিবাসন দপ্তর৷ এখন সে সংখ্যা সাড়ে চার লাখ হবার সম্ভাবনা৷ সেক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের থাকার ব্যবস্থা কোথায় হবে, তাই নিয়েই চিন্তা...
ছবি: Picture-Alliance/dpa/P. Kneffel
প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্রে প্রথম তিন মাস
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের প্রাথমিকভাবে রাখার জন্য এই ‘রিসেপশান সেন্টারগুলি’ আছে – যেমন রাইনল্যান্ড প্যালেটিনেট রাজ্যের ট্রিয়ার শহরে৷ উদ্বাস্তুরা জার্মানিতে পৌঁছনোর পর তাঁদের সাধারণত এ ধরনের প্রাথমিক অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রাখা হয়৷ সেখানে তিন মাস থাকার পর তাঁদের কোনো শহর কি জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Tittel
টাউন হলে ক্যাম্পবেড
প্রাথমিক রিসেপশান সেন্টারগুলো পুরোপুরি ভর্তি, কাজেই সাময়িক বাসস্থান হিসেবে অন্যান্য ভবন কাজে লাগানো হচ্ছে৷ নর্থ রাইন ওয়েস্ট ফালিয়া রাজ্যের হাম শহরের টাউন হলে ৫০০ উদ্বাস্তুর থাকার আয়োজন করা হয়েছে৷ ৭০০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের হলটিতে বেড়া দিয়ে দিয়ে আলাদা আলাদা ‘ঘরের’ ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ প্রত্যেকটি ‘ঘরে’ ১৪টি ক্যাম্পবেড রাখা চলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Fassbender
ক্লাশরুমে রাত্রিবাস
উদ্বাস্তুর স্রোতে শহরগুলি নাজেহাল! আখেন শহরকে গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে ৩০০ উদ্বাস্তুকে রাখার ভার নিতে হয়৷ একমাত্র সমাধান: উদ্বাস্তুদের শোয়ার জন্য ইন্ডা গিমনাজিয়ুম নামের একটি স্কুলের ক্লাশরুমে ম্যাট্রেস পাতা৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/R. Roeger
তাঁবুতে বাস
বর্তমানে জার্মানিতে ক্রমেই আরো বেশি সাময়িক উদ্বাস্তু শিবির সৃষ্টি করা হচ্ছে – তাঁবু গেড়ে৷ স্যাক্সনি আনহাল্ট রাজ্যের হালব্যারস্টাট শহরে এ ধরনের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প সৃষ্টি করে আরো অনেক বেশি উদ্বাস্তুদের রাখা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/J. Wolf
ড্রেসডেনের টেন্ট ক্যাম্প
উদ্বাস্তুদের জন্য একটি সুবিশাল টেন্ট ক্যাম্প বা ‘তাঁবু শিবির’ সৃষ্টি করা হয়েছে স্যাক্সনি রাজ্যের রাজধানী ড্রেসডেন শহরে৷ শৌচাগারের সামনে লম্বা লাইন পড়ে, খাবারের জন্যও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়৷ এখানে আপাতত ১৫টি দেশ থেকে আগত মোট এক হাজার মানুষের বাস৷ আগামীতে আরো শ’খানেক মানুষ এখানে থাকতে বাধ্য হবেন৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/A. Burgi
কনটেইনারে বাস
তাঁবুর বদলে উদ্বাস্তুদের কনটেইনারে থাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে কোথাও কোথাও৷ ট্রিয়ারে ২০১৪ সাল থেকেই এই পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে৷ আজ সেখানে এক হাজারের বেশি উদ্বাস্তু বাস করেন৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/H. Tittel
উদ্বাস্তু আবাসের উপর আক্রমণ
বাডেন ভুর্টেনব্যার্গ রাজ্যের রেমকিঙ্গেন শহরে গত জুলাই মাসের ১৮ তারিখে একটি অগ্নিকাণ্ড ঘটে৷ অজ্ঞাত আততায়ীরা যে বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়, সেখানে উদ্বাস্তুদের রাখার কথা ছিল৷ উদ্বাস্তুদের প্রতি এ ধরনের বিরূপ মনোভাব এখন অন্যত্রও পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিশেষ করে জার্মানির পূর্ব এবং দক্ষিণাঞ্চলে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/SDMG/Dettenmeyer
নতুন আবাসন গড়ার কাজ চলেছে
উদ্বাস্তুদের বসবাসের জন্য একাধিক পৌর এলাকায় নতুন বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে, যেমন বাভেরিয়ার একেনটাল শহরে৷ এখানে মোট ৬০ জন মানুষ বাস করতে পারবেন৷ আগামী বছরের সূচনাতে এখানে প্রথম উদ্বাস্তুরা বসবাস করতে পারবেন, বলে আশা করা হচ্ছে৷