বাস্তুচ্যুত মানুষদের পক্ষে নতুন জায়গায় কাজ পাওয়া এক কঠিন চ্যালেঞ্জ৷ খোদ জার্মানিতে পাঁচ লাখের মতো শরণার্থী এখন চাকুরি খুঁজছেন, কিন্তু যুতসই কাজ পাচ্ছেন না৷ তাঁদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে মিউনিখভিত্তিক এক স্টার্টআপ৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির এক অর্গ্যানিক সুপারমার্কেটে কাজ করেন মাসুদ সুতানজাদে৷ ২৪ বছর বয়সি এই আফগানির কাজ হচ্ছে, দোকানের বিভিন্ন তাকে শাকসবজি সাজিয়ে রাখা৷ অধিকাংশ শাকসবজির জার্মান নাম জানেন না তিনি৷ তবে খদ্দেরদের সঙ্গে জার্মান ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেন৷ উদ্দেশ্য, কাজের ফাঁকে জার্মান ভাষাটাও রপ্ত করে নেয়া৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার লক্ষ্য একটাই– আমি একটি সাধারণ জীবন চাই৷ আর এজন্য যে বিষয়টি আমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, নিরাপদ পরিবেশ৷''
শরণার্থী সংকটের কিছু আইকনিক ছবি
ইউরোপে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশের ছবি গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং মানুষের মতামত সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে৷ অভিবাসন এবং অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তির এত ছবি আগে দেখেনি বিশ্ব৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
লক্ষ্য: টিকে থাকা
অনিশ্চিত যাত্রার ধকল সামলাতে হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে৷ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক তুরস্ক হয়ে গ্রিসে জড়ো হয়েছেন৷ সে দেশের তিনটি দ্বীপে এখনো দশ হাজারের মতো শরণার্থী বসবাস করছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ছয় হাজার নতুন শরণার্থী এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Messinis
পায়ে হেঁটে ইউরোপে
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গ্রিস ও তুরস্ক থেকে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছে৷ ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অর্থাৎ বলকান রুট ব্যবহার করে তাদের এই যাত্রার অধিকাংশই ছিল পায়ে হেঁটে৷ অভিবাসীদের এই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়, যখন রুটটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কয়েকটি দেশ সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷
ছবি: Getty Images/J. Mitchell
বৈশ্বিক আতঙ্ক
এই ছবিটি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ তিন বছর বয়সি সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ তুরস্কে সমুদ্রতটে ভেসে ওঠে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে৷ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরণার্থী সংকটের প্রতীকে পরিণত হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/DHA
বিশৃঙ্খলা এবং হতাশা
শেষ সময়ের ভিড়৷ ইউরোপে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে ক্রোয়েশিয়াতে এভাবে ট্রেনে এবং বাসে উঠতে দেখা যায় অসংখ্য শরণার্থীকে৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে হাঙ্গেরি সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং শরণার্থীদের জন্য কন্টেইনার ক্যাম্প তৈরি করে৷
ছবি: Getty Images/J. J. Mitchell
বিবেকবর্জিত সাংবাদিকতা
হাঙ্গেরির এক সাংবাদিক এক শরণার্থীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার ভিডিও নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ সার্বিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন হাঙ্গেরির একটি এলাকার সেই ঘটনায় আলোচিত সাংবাদিকের চাকুরি চলে যায়৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
উন্মুক্ত সীমান্ত নয়
২০১৬ সালের মার্চে বলকান রুট আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়ার পর সীমান্তগুলোতে আরো আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ হাজার হাজার শরণার্থী বিভিন্ন সীমান্তে আটকা পড়ে এবং তাদের সঙ্গে বর্বর আচরণের খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থান থেকে৷ অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে৷
ধুলা এবং রক্তে ঢাকা এক শিশু৷ পাঁচবছর বয়সি ওমরানের এই ছবিটি প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে৷ আয়লান কুর্দির ছবির মতো এই ছবিটিও গোটা বিশ্বকে আরেকবার নাড়িয়ে দেয়৷ সিরীয়ায় গৃহযুদ্ধ কতটা বিভৎস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং সিরীয়রা কতটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, তার এক প্রতীক হয়ে ওঠে ছবিটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Aleppo Media Center
অজানা নতুন ঠিকানা
গ্রিক-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্তের ইডোমিনিতে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাঁটছেন এক সিরীয় নাগরিক৷ ইউরোপে তাঁর পরিবার নিরাপদ থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁর৷ ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, একজন শরণার্থী প্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেন, সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে৷ ফলে যারা আরো ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Y. Behrakis
সহযোগিতার আশা
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রবেশের কারণে জার্মানি অভিবাসন নীতি আরো কড়া করে ফেললেও এখনো শরণার্থীদের প্রথম পছন্দ জার্মানি৷ ইউরোপের আর কোনো দেশ জার্মানির মতো এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী নেয়নি৷ ২০১৫ সালে সঙ্কট শুরুর পর থেকে দেশটি ১২ লক্ষ শরণার্থী নিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা
ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা চলতি বছর কমেছে, তবে থেমে যায়নি৷ বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে অনেকে৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর এখন অবধি সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে প্রায় দু’হাজার মানুষ৷ গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
10 ছবি1 | 10
আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনীর ইলেক্ট্রিয়ান হিসেবে কাজ করতেন সুতানজাদে, যা তাঁকে তালেবানের লক্ষ্যে পরিণত করে৷ ফলে ২০১৫ সালে সেদেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি এবং ইরান, তুরস্ক এবং বলকান পেরিয়ে জার্মানিতে পৌঁছান৷ এখানে পৌঁছানোর পরপরই ভাষা শিক্ষার কোর্সে ভর্তি হন উদ্যমী এই যুবক৷ তবে জার্মানির চাকুরির বাজার যে কতটা কঠিন, সেটা তিনি বছরখানেক পরে বিভিন্ন স্থানে চাকুরির আবেদন করতে শুরু করার পর বুঝতে পারেন৷
সুতানজাদে বলেন, ‘‘কখনো কখনো আমার চাকুরির আবেদন প্রত্যাখানের চিঠি পাই৷ তবে অধিকাংশ সময় কোনো জবাবই পাই না৷'' এখন অবশ্য একটি চাকুরি পেয়েছেন তিনি৷ ‘‘সোশ্যাল-বি আমাকে একটা সুযোগ দিয়েছে,'' বলেন এই আফগান৷
জার্মানির চাকুরি বাজারে শরণার্থীদের দুরবস্থা দেখে কিছু একটা করার তাগিদ থেকে সোশ্যাল-বি স্টার্টআপটি তৈরি করেন ম্যাক্সিমিলান ফেল্সনার এবং জারা ব্রুন৷ অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হচ্ছে শরণার্থীদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া এবং তাঁদের ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পাঠানো৷
ফেল্সনার বলেন, ‘‘আমরা শরণার্থী এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আমাদের জন্য কাজ করার সুযোগ দেই এবং পরবর্তীতে আমাদের বিভিন্ন পার্টনার প্রতিষ্ঠানে তাদের পাঠিয়ে দেই৷'' এভাবে সোশ্যাল-বি কার্যত শরণার্থীদের নিয়োগ দিতে একেকটি প্রতিষ্ঠানকে যে জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, সেই প্রক্রিয়া থেকে রেহাই দেয়৷ একইসঙ্গে শরণার্থীরাও একটি স্বস্তিকর কাজের সন্ধান পায়৷
জার্মানিতে আফগান জাতীয় দলের ক্রিকেটার
02:22
ইতোমধ্যে আলডি, ভ্যুর্থ, সেপেলিন এবং সিস মাইক্রোটেকের মতো বড় প্রতিষ্ঠান সোশ্যাল-বি'র সহায়তায় শরণার্থীদের কাজ দিতে শুরু করেছে৷ আর অলাভজনক হওয়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মী সরবরাহ করে স্টার্টআপটির যে মুনাফা হয়, সেটা পুনরায় স্টার্টআপটিতেই বিনিয়োগ করা হয়৷ তাছাড়া, বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা থেকে সহায়তাও পায় এটি৷
আপাতত মিউনিখে পঞ্চাশজনের কিছু বেশি শরণার্থীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে স্টার্টআপটি৷ এ বছরের শেষ নাগাদ সংখ্যাটিকে শতাধিক করার পাশাপাশি জার্মানির অন্যান্য শহরেও নিজেদের কর্মপরিধি বিস্তৃত করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি৷ সবকিছু ঠিক থাকলে অদূর ভবিষ্যতে অনেক শরণার্থীর নিরাপদ কর্মস্থলে পরিনত হবে সোশ্যাল-বি, এমন আশা করাই যায়৷