সম্প্রতি এক জরিপে অংশ নেয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জার্মান জানিয়েছেন, বিশ্বের উপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির বিপজ্জনক প্রভাব নিয়ে তাঁরা খুবই উদ্বিগ্ন৷ এরপর তাঁরা উদ্বিগ্ন শরণার্থীদের নিয়ে৷
বিজ্ঞাপন
বিমা প্রতিষ্ঠান ‘আর + ভি ফ্যায়াজিসারুঙেন’-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আর + ভি ইনফোসেন্টার’ প্রতিবছর জার্মানদের ভয় নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে৷
চলতি বছরের জরিপে প্রায় ২,৪০০ জার্মান অংশ নিয়েছেন৷ জুন মাসের ৮ তারিখ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে৷
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৯ শতাংশ ট্রাম্পের নীতি নিয়ে তাঁদের ভয়ের কথা জানিয়েছেন৷ জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থার উপদেষ্টা ও হাইডেলব্যার্গের রুপ্রেশট-কার্লস-ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মানফ্রেড শ্মিড্ট বলছেন, ‘‘ট্রাম্পের নিষ্ঠুর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতি, আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতি তাঁর আগ্রাসী মনোভাব এবং মিত্র দেশসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সমপরিমাণ আগ্রাসী আচরণ নিয়ে অধিকাংশ জার্মান শঙ্কিত৷’’
ম্যার্কেল ও জার্মানি সম্পর্কে ট্রাম্পের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁর মন্তব্যের জন্য আলোচিত, সমালোচিত৷ জার্মান চ্যান্সেলর ও জার্মানি সম্পর্কেও তিনি বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য রেখেছেন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/C. May
‘সম্ভবত সবচেয়ে মহান নেতা’
২০১৫ সালে মার্কিন ম্যাগাজিন টাইমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের প্রশংসা করেছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘জার্মানি নীরবে পেছনে বসে থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে, আর সম্ভবত বর্তমানকালের সবচেয়ে মহান নেতা ম্যার্কেলকে সঙ্গে নিয়ে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷’’
ছবি: Picture alliance/AP Photo/M. Schreiber
‘খুব খারাপ’
ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘‘জার্মানরা খারাপ, খুব খারাপ... তারা যে যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ গাড়ি বিক্রি করে, সেদিকে তাকান৷ ভয়াবহ৷ আমরা এগুলো বন্ধ করবো৷’’ ন্যাটোর বৈঠকে উপস্থিত থাকা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ট্রাম্পের এই মন্তব্য প্রকাশ করেছিল জার্মান ম্যাগাজিন ‘ডেয়ার স্পিগেল’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP/E. Vucci
‘কিছু মিল’
বারাক ওবামা প্রশাসন তাঁর ফোনে আড়ি পেতেছিল বলে অভিযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্পের৷ যদিও বিষয়টি প্রমাণিত নয়৷ ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা ম্যার্কেলের ফোনে আড়ি পেতেছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল৷ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ম্যার্কেলের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘‘আড়ি পাতার ক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, আপনি জানেন (ওবামা) প্রশাসনের কারণে, সম্ভবত আমাদের মধ্যে অন্তত কিছুটা মিল আছে৷’’
ছবি: Picture alliance/R. Sachs/CNP
‘অবৈধ’
ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জার্মান দৈনিক ‘বিল্ড’ ও ব্রিটেনের ‘দ্য টাইমস’কে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘‘আমার মনে হয়, তিনি (ম্যার্কেল) অনেক বড় ভুল করেছেন এবং সেটা হচ্ছে, যে কোনো জায়গা থেকে আসা অবৈধ (ট্রাম্প এই শব্দটিই উল্লেখ করেছেন) মানুষদের গ্রহণ করা৷’’
ছবি: Getty Images/S. Gallup
‘জার্মানি অনেক ঋণী’
২০১৭ সালে ম্যার্কেলের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প দুটি টুইট করেছিলেন৷ তিনি লিখেছিলেন, ‘‘ভুয়া খবর থেকে আপনারা যা-ই শুনে থাকুন না কেন, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সঙ্গে আমার বৈঠকটি দারুণ হয়েছে৷ তবে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জার্মানির অনেক ঋণ আছে৷ এরা জার্মানিকে যে ব্যয়বহুল নিরাপত্তা দেয়, তার মূল্য অবশ্যই চোকাতে হবে৷’’
ছবি: Picture alliance/dpa/L. Mirgeler
‘সমর্থন ফিরিয়ে নিচ্ছে’
গত বছর জার্মানিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর সরকার গঠন হতে অনেক সময় লেগে যায়৷ জোট গঠনের আলোচনায় অভিবাসন একটি বড় ইস্যু ছিল৷ সেই সময় ট্রাম্প এভাবে টুইট করেছিলেন, ‘‘জার্মানির মানুষরা তাঁদের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন উঠিয়ে নিচ্ছেন, কারণ, অভিবাসন বিষয়টি ইতিমধ্যে দূর্বল হয়ে পড়া জোট আলোচনায় ঝড় তুলছে৷’’ এরপর তিনি ভুল তথ্য দিয়ে টুইট করেন, ‘‘জার্মানিতে অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে৷’’
ছবি: AFP/Getty Images/L. Marin
6 ছবি1 | 6
১৯৯২ সাল থেকে জার্মানদের ভয় নিয়ে জরিপ প্রকাশ করা হচ্ছে৷
জরিপে অংশ নেয়া ৬৩ শতাংশ জার্মান মনে করেন, জার্মান কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানগুলো শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সামলাতে অক্ষম৷
এছাড়া একই সংখ্যক জার্মান মনে করেন, অভিবাসন বেড়ে গেলে জার্মান ও শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বে৷
২০১৭ সালের জরিপে যতজন অংশগ্রহণকারী জার্মান শরণার্থী ও অভিবাসন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, এবারের জরিপে তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে৷
৬০ শতাংশের বেশি জার্মানের বিশ্বাস, তাঁদের রাজনীতিবিদরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না৷ প্রায় অর্ধেক উত্তরদাতা রাজনীতিবিদদের ‘ব্যর্থ’ বা তার চেয়ে একটু ভালো বলে মনে করছেন৷ আর মাত্র ছয় শতাংশ তাঁদের কাজকে ‘ভালো’ বা ‘খুব ভালো’ বলেছেন৷
জার্মানিতে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা কমে এলেও এখনো প্রায় ৫৮ শতাংশ জার্মানের মনে সেই ভয়টি আছে৷
প্রায় একই সংখ্যক জার্মান ইউরোপের ঋণ সংকট নিয়েও তাঁদের ভয়ের কথা জানিয়েছেন৷ তাঁদের আশঙ্কা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশ খেলাপি হয়ে গেলে তাদের সহায়তা করতে জার্মানদেরই বেশি কর দিতে হবে৷
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়েও শঙ্কিত ৪৮ শতাংশ জার্মান৷ পরিবেশের উপর এর নাটকীয় প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাঁদের৷ এছাড়া অর্ধেকের বেশি অংশগ্রহণকারী মনে করেন, ভবিষ্যতে আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটবে৷
নিকোল গোয়েবেল/জেডএইচ
গতবছর মার্চের এই ছবিঘরটি দেখুন...
ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্টদের রসায়ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তি যথেষ্ট মজবুত হলেও শীর্ষ নেতাদের সম্পর্কের রসায়নের উপর তার বিবর্তন অনেকটাই নির্ভর করে৷ আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাঁর ক্ষমতাকালে চারজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেখা পেলেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
প্রথম সাক্ষাৎ
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন৷ সে সময়ে জার্মান চ্যান্সেলর ছিলেন গেয়ারহার্ড শ্র্যোডার৷
ছবি: AP
চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট
২০০৮ সালের জুন মাসে বার্লিনের কাছে মেসেব্যার্গ-এ জার্মান সরকারের অতিথি নিবাসে মিলিত হয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ৷ বুশ দুই দিনের সফরে জার্মানি এসেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Bergmann
পারিবারিক পরিবেশে বুশ-ম্যার্কেল
২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় জর্জ ডাব্লিউ বুশ ম্যার্কেলকে নিজের খামারবাড়িতে স্বাগত জানান৷ স্ত্রী লরা ও ম্যার্কেলের স্বামী ড. ইওয়াখিম সাউয়ারকে সঙ্গে নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়েছিলেন বুশ৷
ছবি: AP
উষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ
২০০৮ সালেই রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে জি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে জর্জ ডাব্লিউ বুশ আচমকা ম্যার্কেল-এর কাঁধ মালিশ করে বসেন৷ তাঁর এই স্বতঃস্ফূর্ত উষ্ণতার প্রকাশে ম্যার্কেল অবশ্য কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷
নতুন সম্পর্ক
২০০৯ সালে জার্মানির বাডেন বাডেন শহরে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ ম্যার্কেল তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
ম্যার্কেল-ওবামা রসায়ন
একই বছর ওয়াশিংটন সফরে জান ম্যার্কেল৷ ধীরে ধীরে ওবামা ও ম্যার্কেলের ব্যক্তিগত উষ্ণতা গড়ে উঠতে শুরু করে৷
ছবি: AP
বিশেষ সম্মান
২০১১ সালে ওয়াশিংটন সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘মেডেল অফ ফ্রিডম’ হাতে পান আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷ কিন্তু তার ঠিক পরে এনএসএ কেলেঙ্কারির ফলে ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে ম্যার্কেলের সম্পর্ক কিছুটা শীতল হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন পরিস্থিতি
২০১৫ সালে বাভেরিয়ার মনোরম পরিবেশে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে আসেন ওবামা৷ ততদিনে ভ্লাদিমির পুটিনের সঙ্গে বেড়ে চলা সংঘাতের কারণে রাশিয়া একঘরে হয়ে পড়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Kappeler
আবেগঘন বিদায়
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যকালের শেষ পর্যায়ে বার্লিন সফরে আসেন বারাক ওবামা৷ পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে তিনি ম্যার্কেলের নাম উল্লেখ করেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
নতুন চ্যালেঞ্জ
২০১৭ সালটি অ্যামেরিকা ও জার্মানি – দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ জানুয়ারি মাসে ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ ম্যার্কেলও আবার ক্ষমতায় এলেন।
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kappeler/R. Sachs
বিরোধ
২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ট্রাম্পের আমলে অ্যামেরিকা ও জার্মানির মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়। ন্যাটো নিয়ে ট্রাম্প ও ম্যার্কেলের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। ট্রাম্পের অ্যামেরিকা ফার্স্ট নীতিও ম্যার্কেল মানতে পারেননি। জার্মানি থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করেছেন ট্রাম্প। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Vucci
বাইডেনের আমলে
২০২১ সালে জি৭ বৈঠকের ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে ম্যার্কেলের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়েছে। এবার ম্যার্কেল অ্যামেরিকা গেছেন। চ্যান্সেলার হিসাবে তার সম্ভবত এটাই শেষ সফর। বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকে করবেন তিনি। সেখানে কি সম্পর্কের বরফ গলবে?
ছবি: Adam Schultz/White House/Planet Pix/Zuma/picture alliance