ইউরোপমুখী শরণার্থীদের ঢল নিয়ন্ত্রণ করতে ফ্রান্সের উদ্যোগে সোমবার মিলিত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলির শীর্ষ নেতারা৷ এই সংকট কিছুটা স্তিমিত হলেও এর মোকাবিলায় বেশ কিছু সার্বিক উদ্যোগ নিতে চান তাঁরা৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপে শরণার্থীদের ঢল আর নাটকীয় মাত্রায় না থাকলেও এই সংকটের সমাধান এখনো দূর অস্ত৷ জাতিসংঘের সূত্র অনুযায়ী, চলতি বছরে এখনো পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার শরণার্থী নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপের ভূখণ্ডে পা রেখেছে৷ আনুমানিক ২,৪০০ মানুষের পথেই মৃত্যু হয়েছে৷
ফলে জার্মানিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের একাধিক দেশে বিষয়টি রাজনৈতিক সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অনেক বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার পর এক সার্বিক সমাধানসূত্রের লক্ষ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ সোমবার প্যারিসে আফ্রিকা ও ইইউ-র কয়েকটি দেশের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন৷ আফ্রিকার দেশ নাইজার, চাড ও লিবিয়ার জাতীয় ঐক্য সরকার ছাড়াও উপস্থিত থাকছেন জার্মানি, স্পেন ও ইটালির শীর্য নেতারা৷ ইইউ-র পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনিও এই সম্মেলনে যোগ দেবেন৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নে শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে শুধু সীমান্তে কড়াকড়ি যে যথেষ্ট নয়, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ যেসব দেশ থেকে শরণার্থীরা রওয়ানা হচ্ছে, তাদের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ৷ তাছাড়া যে কারণে শরণার্থীরা আদৌ ভিটেমাটি ছেড়ে উন্নত জীবনযাত্রার আশায় ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে, সেই সমস্যার উৎস অন্তত কিছুটা হলেও দূর করতে হবে বলে মনে করছেন ইউরোপের কিছু নেতা৷ তাই প্যারিস সম্মেলনে আফ্রিকার দেশগুলিকে আরও উন্নয়ন সাহায্যের অঙ্গীকার করতে চায় ইইউ নেতৃত্ব৷ এভাবে কর্মসংস্থান বাড়িয়ে মানুষের মনে আশা জাগানোই এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য৷ এর বদলে সেইসব দেশগুলিকে ইউরোপমুখী শরণার্থীদের ঢল নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে৷ নাইজারের সরকার এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু সফল পদক্ষেপ নিয়েছে৷
ফ্রান্স একক উদ্যোগে আফ্রিকায় কিছু ‘হটস্পট' গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে৷ শরণার্থীরা সেই সব কেন্দ্রে গিয়ে আইনি পথে ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন জানাতে পারবেন৷ সে ক্ষেত্রে আদম ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের বিপজ্জনক পথে ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে না – এমন এক সুযোগ সৃষ্টি করতে চান ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মাক্রোঁ৷ ইউরোপের যেসব এনজিও সমুদ্রে শরণার্থীদের সহায়তা করে, ইটালি তাদের জন্য এক আচরণবিধি স্থির করেছে৷
এরই মধ্যে আফ্রিকার কয়েকটি দেশের উদ্যোগের ফলে শরণার্থীদের সংখ্যা অনেকটা কমে এসেছে৷ বিশেষ করে লিবিয়ার উপকূলরক্ষী বাহিনী ভূমধ্যসাগরে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠায় বেআইনি পথে শরণার্থীরা ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারছে না৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল লিবিয়ার এই বাহিনীকে আরও সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন৷ তবে তিনি বলেন, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করলে রেহাই পাবে না৷ ২০১৫ সালে তিনি যেভাবে জার্মানির দ্বার শরণার্থীদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্তে আজও অটল তিনি৷ একই রকম পরিস্থিতি দেখা দিলে তিনি আবার সেই সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি৷
এসবি/ডিজি (এএফপি, ডিপিএ)
ইউরোপে শরণার্থী সংকট কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সহিংসতা বৃদ্ধি থেকে ইউরোপের অসংলগ্ন শরণার্থী নীতি অবধি ইউরোপে শরণার্থী সংকটে কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যতা থেকে পালানো
২০১৪ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দেয়ার প্রাক্কালে এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলে তথাকথিত ‘ইসলামিট স্টেট’-এর বিস্তার ঘটার পর সিরীয়দের দেশত্যাগের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়৷ একইসময়ে সহিংসতা এবং দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, নিগার এবং কসভোর অনেক মানুষ ইউরোপমুখী হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সীমান্তের ওপারে আশ্রয় খোঁজা
সিরীয় শরণার্থীদের অধিকাংশই ২০১১ সাল থেকে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডানে আশ্রয় নিতে শুরু করেন৷ কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ সেসব দেশের শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানকার বাসিন্দারা সন্তানদের শিক্ষা দিতে না পারায় এবং কাজ না পাওয়ায় এক পর্যায়ে আরো দূরে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পায়ে হেঁটে লম্বা পথ পাড়ি
২০১৫ সালে ১৫ লাখের মতো শরণার্থী ‘বলকান রুট’ ধরে পায়ে হেঁটে গ্রিস থেকে পশ্চিম ইউরোপে চলে আসেন৷ সেসময় ইউরোপের শেঙেন চুক্তি, যার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই চলাচাল সম্ভব, নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ কেননা শরণার্থীরা গ্রিস থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোর দিকে আগাতে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardy
সমুদ্র পাড়ির উন্মত্ত চেষ্টা
সেসময় হাজার হাজার শরণার্থী ‘ওভারক্রাউডেড’ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে শুরু করেন৷ লিবিয়া থেকে ইটালি অভিমুখী বিপজ্জনক সেই যাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সাগরে ডুবে যায় অন্তত আটশ’ মানুষ৷ আর বছর শেষে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার৷
ছবি: Reuters/D. Zammit Lupi
সীমান্তে চাপ
ইউরোপের বহির্সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কয়েকটি রাষ্ট্র চাপে পড়ে যায়৷ হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া এবং অস্ট্রিয়া এক পর্যায়ে সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, সেসময় শরণার্থী আইন কঠোর করা হয় এবং শেঙেনভুক্ত কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/B. Mohai
বন্ধ দরজা খুলে দেয়া
জার্মান চ্যান্সেল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর ‘ওপেন-ডোর’ শরণার্থী নীতির কারণে বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে অনেক শরণার্থীই ইউরোপে আসতে উৎসাহ পেয়েছেন৷ এক পর্যায়ে অবশ্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত পথ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে জার্মানিও৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি
২০১৬ সালের শুরুতে ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ এই চুক্তির আওতায় গ্রিসে আসা শরণার্থীদের আবারো তুরস্কে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করে৷ নভেম্বর মাসে অবশ্য তুরস্কের ইইউ-তে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর, সেই চুক্তি আবারো নড়বড়ে হয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Altan
পরিস্থিতি বদলের কোনো লক্ষণ নেই
ইউরোপজুড়ে অভিবাসীবিরোধী মানসিকতা বাড়তে থাকলেও সরকারগুলো সম্মিলিতভাবে শরণার্থী সংকট মোকাবিলার কোনো সঠিক পন্থা এখনো খুঁজে পাননি৷ কোটা করে শরণার্থীদের ইইউ-ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতার ইতি ঘটার কোনো লক্ষণও নেই৷ ওদিকে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে শরণার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে৷