চলতি সপ্তাহে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের আগে ইউরোপের বহির্সীমানা আরও মজবুত করে আফ্রিকায় শরণার্থী কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ চলছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর ম্যার্কেল মঙ্গলবার জোটসঙ্গীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছেন৷
বিজ্ঞাপন
শরণার্থী সংকট নিজেদের ঘাড় থেকে নামাতে তৎপর হয়ে উঠেছে ইউরোপের কয়েকটি দেশ৷ ইউরোপের ভূখণ্ডের বাইরে শরণার্থী কেন্দ্র গড়ে তুলে সম্ভাব্য রাজনৈতিক আশ্রয়প্রত্যাশীদের সেখানেই আটকে রাখার একাধিক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে৷ ইটালির নতুন পপুলিস্ট জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাটেও সালভিনি সোমবার লিবিয়া সফরে গিয়ে আফ্রিকার লিবিয়া, নাইজার, মালি, চাড ও সুদানে এমন শরণার্থী কেন্দ্র গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন৷ সালভিনি শরণার্থীদের ঢল নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে লিবিয়ার স্বীকৃত সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করলেও সে দেশ নিজস্ব ভূখণ্ডে শরণার্থী শিবির গড়ে তোলার বিরোধী৷ ইউরোপের বাইরে এমন শিবিরের আইনি বৈধতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় কমিশন৷
ইটালির সরকার এর মধ্যেই শরণার্থী বোঝাই জাহাজ আর নোঙর করতে দিচ্ছে না৷ উল্লেখ্য, বিভিন্ন এনজিও সমুদ্রে শরণার্থীদের উদ্ধার করে ইউরোপে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছে৷ ফলে এই মুহূর্তে প্রায় ৩৪০ জন শরণার্থী বোঝাই দুটি জাহাজ ভূমধ্যসাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ মানবাধিকার সংগঠনসহ অন্য কিছু দেশ এই কড়া নীতির সমালোচনা করছে৷ বিশেষ করে চলতি বছর শরণার্থীদের ঢল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে যাবার পর এমন ‘অমানবিক' নীতির পক্ষে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না বলে অনেকে ইঙ্গিত দিয়েছেন৷
এমনই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতি ও শুক্রবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ সেখানে আরও কড়া শরণার্থী নীতি নিয়ে আলোচনা হবে৷ ইউরোপের বহির্সীমানায় শরণার্থীদের আটকে দেওয়ার বিষয়ে মোটামুটি ঐকমত্য দেখা গেলেও যেসব শরণার্থী ইউরোপে পৌঁছাচ্ছে, তাদের দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে সদস্য দেশগুলির মধ্যে জোরালো মতপার্থক্য রয়েছে৷ বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশ আদৌ কোনো শরণার্থী নিতে প্রস্তুত নয়৷ ফলে বর্তমান সংকটের সার্বিক ইউরোপীয় সমাধানসূত্র নিয়ে সংশয় দেখা দিচ্ছে৷ দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে জার্মানির মতো দেশ৷ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হবার পর শরণার্থীদের প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়াও তরান্বিত করতে চায় ইইউ৷
জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও ইটালির মতো দেশে পপুলিস্ট ও দক্ষিণপন্থি শক্তিগুলি প্রয়োজনে একক পদক্ষেপ নিতে চাইছে৷ জার্মানির বাভেরিয়া রাজ্যের সিএসইউ দল অন্য দেশে নথিভুক্ত শরণার্থীদের জার্মান সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেবার পক্ষে৷ কিন্তু অস্ট্রিয়া ও ইটালিও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করায় বাস্তবে সীমান্ত থেকে শরণার্থী ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে উঠবে৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাই ইউরোপের অন্তত কয়েকটি দেশের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে চাইছেন৷ এ কাজে তাঁর সাফল্যের উপর জোট সরকার ও রক্ষণশীল শিবিরের অস্তিত্ব নির্ভর করছে৷ মঙ্গলবারই ম্যার্কেল জোটসঙ্গীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন৷
চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করলেও তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে সরকার ও ইউনিয়ন শিবিরে ভাঙন ধরানোর ঝুঁকি নিতে চাইছে না বাভেরিয়ার সিএসইউ দল৷ দলের নেতা ও জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সেহোফার তাই আগের তুলনায় তাঁর অবস্থান অনেক নরম করবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
প্রতি দু’সেকেন্ডে একজন ঘরছাড়া
আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস৷ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, ২০১৭ সালে প্রতি দু'সেকেন্ডে একজন বাস্তুচ্যূত হয়েছেন৷ মিয়ানমার, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, সিরিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে অনেক মানুষ বাসভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Omic
গৃহহীন যারা
সহিংসতা, যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে বিশ্বে এখন ৬৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন, অর্থাৎ ৬ কোটি ৮৫ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন৷ মঙ্গলবার জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইইএনএইচসিআর এ কথা জানিয়েছে৷ জাতিসংঘের হিসেব মতে, ২০১৬ সালে সারা বিশ্বে ৬ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিল৷ সেবছর মূলত মিয়ানমার থেকেই বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল৷ .
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
দু’ সেকেন্ডে একজন
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, গতবছরই ১ কোটি ৬২ লক্ষ মানুষ নতুন করে গৃহহীন হয়েছে৷ এদের মধ্যে যাঁরা প্রথমবার বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়েছেন, তাঁরাও যেমন আছেন, তেমনি আছেন যাঁরা আগে থেকেই উদ্বাস্তু, তাঁরাও৷ অর্থাৎ প্রতিদিন ৪৪,৪০০ মানুষ বিতাড়িত হচ্ছেন এবং প্রতি দু'সেকেন্ডে ১ জন করে গৃহহীন হচ্ছেন৷
যুদ্ধ, হিংসা এবং উৎপীড়নের জন্য ৬ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
দেশের মধ্যে
অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বা হিংসার জন্য দেশের ভেতরেই অনেক মানুষ বাস্তুভিটা ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়৷ তাঁদের বলা হয় আইডিপি (ইন্টারনালি ডিসপ্লেসড পিপল)৷ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিশ্বে প্রায় ৪কোটি আইডিপি ছিল৷ এই সংখ্যাটা আগের বছরের তুলনায় কমেছে৷ কলম্বিয়া, সিরিয়ায় এদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Omic
সিরিয়ার দুর্দশা
গত ৭ বছর ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার ওপর দিয়ে নানা ঝড় বয়েছে৷ ২০১৭ সালের শেষ অবধি প্রায় ৬৩ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল৷ এছাডা়ও সিরিয়াতে প্রায় ৬২ লাখ মানুষ দেশের ভেতরেই উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে৷
ছবি: DW/S. Derks
আফগানিস্তান
সিরিয়ার পরেই যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের স্থান৷ প্রচুর মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আফগানিস্তান থেকে পালাচ্ছেন৷ বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীনভাবে যুদ্ধ, সহিসংতা ও উৎখাতের কারণে প্রতিদিনই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরছে যুদ্ধবিধ্বস্ত এসব মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Paduano
দক্ষিণ সুদানের অবস্থা
দক্ষিণ সুদানে গৃহযুদ্ধ চলছে ২০১৩ সাল থেকে৷ গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে গত কয়েক বছরে দেশটির লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ জাতিসংঘের মতে, এই দেশ সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে৷
ছবি: Reuters/H. Kalis
তুরস্ক
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তুরস্কে প্রচুর শরণার্থী রয়েছে৷ ২০১৭ সালের শেষের দিক পর্যন্ত তুরস্কে প্রায় ৩৫ লক্ষ শরণার্থী ছিল৷ তার মধ্যে অধিকাংশই সিরিয়ার মানুষ৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Gouliamik
গরিব দেশেও
অ্যামেরিকা আর ইউরোপ যাঁরা পৌঁছচ্ছেন, তাঁরা ছাড়াও অনেক শরণার্থী কম আয় সম্পন্ন বা মধ্যম আয় সম্পন্ন দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছেন৷ জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশন (ইউএনএইচসিআর) বলছে, প্রায় ৮৫ শতাংশ শরণার্থী উন্নয়নশীল দেশে আশ্রয় নিচ্ছেন, যাঁরা খুবই দরিদ্র৷ এদের মধ্যে আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মিয়ানমার, সোমালিয়া, সুদান এবং কঙ্গো, উগান্ডার মানুষই বেশি৷