সিরীয় শরণার্থীদের জন্য ২০১৫ সালে জার্মান সীমান্ত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পক্ষে আবারো নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন জার্মান চ্যান্সেলর৷ ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোকেও শরণার্থীদের প্রতি সদয় হওয়ার আহ্বান জানান তিনি৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ম্যার্কেল জানিয়েছেন, দু'বছর আগে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে বাঁচতে ইউরোপে আসা সিরীয় এবং অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের জার্মানিতে আশ্রয় দেয়ার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন তা সঠিক ছিল৷ ভবিষ্যতে একইরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তিনি ২০১৫ সালে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোর পুনরাবৃত্তি করবেন বলেও জানিয়েছেন ম্যার্কেল৷
তবে তিনি এটাও স্বীকার করেছেন যে সেসময়কার ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইন তখনকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপযুক্ত ছিল না৷ তথাকথিত ‘‘ডাবলিন রেগুলেশনের'' সমালোচনা করেছেন তিনি৷ এই আইন অনুযায়ী, একজন শরণার্থী প্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেছেন সেদেশে তাঁর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক ছিল৷
ইটালির যে গ্রামের প্রাণ ফিরিয়েছেন শরণার্থীরা
দক্ষিণ ইটালির এসপ্রোমন্টে পর্বতমালার পাদদেশের এক গ্রাম ক্রমশ যেন নির্জীব হয়ে যাচ্ছিল৷ তবে এখন শরণার্থীদের পদচারণায় অনেকটাই সজীবতা ফিরেছে সেখানে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
শরণার্থী এবং স্থানীয়দের সুবিধা
দক্ষিণ ইটালির এসপ্রোমন্টের ছোট্ট সেন্ট’আলেসিও গ্রামের বাসিন্দারা গত তিন বছর ধরে পরিবার এবং অভিবাসীদের স্বাগত জানাচ্ছেন৷ এক প্রকল্পের আওতায় এটা করা হচ্ছে, যা শুধু মানবিক সহায়তাও নয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুযোগ সুবিধাও দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
প্রায় মরুতে পরিনত হওয়া গ্রাম
শরণার্থীরা আসার আগের বছরগুলোতে সেন্ট’আলেসিও’র বাসিন্দার সংখ্যা ক্রমশ কমছিল৷ সেখানে ছিল মাত্র ৩৩০ জন বাসিন্দা, যাদের অধিকাংশই বৃদ্ধ৷ গ্রামের রাস্তাঘাটগুলো হয়ে যাচ্ছিল মরুভূমির মতো, ঘরবাড়ির জানালাও থাকতো অধিকাংশ সময় বন্ধ৷ আসলে ভালো কাজের আশায় গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দা পাড়ি দেন টুরিন, মিলান এমনকি অস্ট্রেলিয়া অবধি৷ ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
অভিবাসীদের জন্য ইটালীয় রান্নার প্রশিক্ষণ
গ্রামের পরিস্থিতি বদলের জন্য স্থানীয় কাউন্সিল অভিবাসীদের জায়গা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এবং শরণার্থীদের নেটওয়ার্ক এসপিআরএআর’এর সহায়তায় ৩৫ অভিবাসীকে গ্রামের আটটি খালি ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া হয়৷ ছবিতে অভিবাসীরা রান্নার ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
‘একটু নড়াচড়া ভালো’
গ্রামের একমাত্র বারে স্থানীয় এবং অভিবাসীরা একত্রে সময় কাটান৷ বারটির মালিক ক্যালেস্টিনা বোরেলো, যার ছেলে ভালো কাজের আশায় গ্রাম ছেড়ে বেলজিয়ামে চলে গেছেন কয়েকবছর আগে৷ ক্যালেস্টিনা জানান, গ্রামটি ক্রমশ জনশূণ্য হয়ে যাচ্ছিল, তবে এখন যে অল্পবিস্তর ‘নড়াচড়া’ সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই ভালো৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
অভিবাসীদের দেয়া হচ্ছে সব সুযোগ
গ্রামটিতে বর্তমানে ইরাকি কুর্দিদের এক পরিবার, ঘানা, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল এবং গাম্বিয়ার কয়েকজন অল্পবয়সি অভিবাসী বসবাস করছেন৷ তাদের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে৷ বিশেষ করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে কাজের সুযোগ, ভাষা শেখার ব্যবস্থা, আইনি সহায়তা, এমনকি প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে৷ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও স্থানীয়দের সঙ্গে অভিবাসীদের যুক্ত করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
আশাবাদী মেয়র
গ্রামের মেয়র স্টেফেনো কালাবোরো মনে করেন, অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়ার প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধাও নিশ্চিত হচ্ছে৷ এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬ জনের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে, যারা পার্টটাইম বা ফুলটাইম কাজ করছেন৷ ষোল জনের মধ্যে সাতজন স্থানীয় বাসিন্দা৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
খেলার মাঠে সখ্যতা বাড়ানো
স্থানীয় এবং অভিবাসীদের মধ্যে সখ্য বাড়ানোর এক উপায় এই ফুটবল খেলার মাঠ৷ পাশাপাশি গ্রামের অধিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার বার, সুপারমার্কেট, চিকিৎসকের চেম্বার, যেগুলো কিনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সবই এখন চালু রাখা যাবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
7 ছবি1 | 7
‘ভেল্ট আম সোনটাগ' পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ম্যার্কেল শরণার্থী ইস্যুতে গ্রিস এবং ইটালির উপর বাড়তি চাপের কথাও স্বীকার করেন৷ শরণার্থীরা সাধারণত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে এই দেশ দু'টোতে প্রথমে প্রবেশ করেন এবং ‘‘ডাবলিন রেগুলেশন'' অনুযায়ী তাদের সেখানেই নিবন্ধন করতে হয়৷ ম্যার্কেল এই বিষয় বলেন, ‘‘এটা অগ্রহণযোগ্য যে গ্রিস এবং ইটালিকে এই বাড়তি চাপ সহ্য করতে হবে শুধুমাত্র এই কারণে যে ভৌগলিক অবস্থান অনুযায়ী সেখানে শরণার্থীরা প্রথমে পা রাখছেন৷''
বরং শরণার্থীদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুষম বণ্টন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
বলা বাহুল্য, অতীতে কোটা পদ্ধতিতে শরণার্থীদের বন্টনের চেষ্টা করা হলে তা বিপুল বাধার মুখে পড়ে৷ পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এই বিষয়ে বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে৷
এদিকে, কোনো কোনো শরণার্থী রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণের পর নিজ দেশে ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন৷ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ম্যার্কেল এমন শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনি যে দেশে নির্মমতার শিকার হয়েছেন সেদেশে ছুটি কাটাতে যাওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়৷'' এ রকম পরিস্থিতিতে অনুমোদিত রাজনৈতিক আবেদন পুর্নমূল্যায়ন করা যেতে পারে বলেও মত দিয়েছেন টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা এই জার্মান চ্যান্সেলর৷
এআই/ডিজি (কেএনএ, ডিপিএ)
ইউরোপে শরণার্থী সংকট কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সহিংসতা বৃদ্ধি থেকে ইউরোপের অসংলগ্ন শরণার্থী নীতি অবধি ইউরোপে শরণার্থী সংকটে কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যতা থেকে পালানো
২০১৪ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দেয়ার প্রাক্কালে এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলে তথাকথিত ‘ইসলামিট স্টেট’-এর বিস্তার ঘটার পর সিরীয়দের দেশত্যাগের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়৷ একইসময়ে সহিংসতা এবং দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, নিগার এবং কসভোর অনেক মানুষ ইউরোপমুখী হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সীমান্তের ওপারে আশ্রয় খোঁজা
সিরীয় শরণার্থীদের অধিকাংশই ২০১১ সাল থেকে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডানে আশ্রয় নিতে শুরু করেন৷ কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ সেসব দেশের শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানকার বাসিন্দারা সন্তানদের শিক্ষা দিতে না পারায় এবং কাজ না পাওয়ায় এক পর্যায়ে আরো দূরে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পায়ে হেঁটে লম্বা পথ পাড়ি
২০১৫ সালে ১৫ লাখের মতো শরণার্থী ‘বলকান রুট’ ধরে পায়ে হেঁটে গ্রিস থেকে পশ্চিম ইউরোপে চলে আসেন৷ সেসময় ইউরোপের শেঙেন চুক্তি, যার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই চলাচাল সম্ভব, নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ কেননা শরণার্থীরা গ্রিস থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোর দিকে আগাতে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardy
সমুদ্র পাড়ির উন্মত্ত চেষ্টা
সেসময় হাজার হাজার শরণার্থী ‘ওভারক্রাউডেড’ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে শুরু করেন৷ লিবিয়া থেকে ইটালি অভিমুখী বিপজ্জনক সেই যাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সাগরে ডুবে যায় অন্তত আটশ’ মানুষ৷ আর বছর শেষে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার৷
ছবি: Reuters/D. Zammit Lupi
সীমান্তে চাপ
ইউরোপের বহির্সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কয়েকটি রাষ্ট্র চাপে পড়ে যায়৷ হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া এবং অস্ট্রিয়া এক পর্যায়ে সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, সেসময় শরণার্থী আইন কঠোর করা হয় এবং শেঙেনভুক্ত কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/B. Mohai
বন্ধ দরজা খুলে দেয়া
জার্মান চ্যান্সেল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর ‘ওপেন-ডোর’ শরণার্থী নীতির কারণে বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে অনেক শরণার্থীই ইউরোপে আসতে উৎসাহ পেয়েছেন৷ এক পর্যায়ে অবশ্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত পথ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে জার্মানিও৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি
২০১৬ সালের শুরুতে ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ এই চুক্তির আওতায় গ্রিসে আসা শরণার্থীদের আবারো তুরস্কে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করে৷ নভেম্বর মাসে অবশ্য তুরস্কের ইইউ-তে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর, সেই চুক্তি আবারো নড়বড়ে হয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Altan
পরিস্থিতি বদলের কোনো লক্ষণ নেই
ইউরোপজুড়ে অভিবাসীবিরোধী মানসিকতা বাড়তে থাকলেও সরকারগুলো সম্মিলিতভাবে শরণার্থী সংকট মোকাবিলার কোনো সঠিক পন্থা এখনো খুঁজে পাননি৷ কোটা করে শরণার্থীদের ইইউ-ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতার ইতি ঘটার কোনো লক্ষণও নেই৷ ওদিকে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে শরণার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে৷