অনেক মানুষ শরীরে উলকি বা ট্যাটু আঁকান৷ সেই উলকি সাধারণত স্থায়ীভাবে ত্বকের উপর থেকে যায়৷ বিজ্ঞানীরা এবার উলকির কালির ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছেন৷ এমনকি যকৃতের মধ্যেও তার চিহ্ন পাওয়া গেছে৷
বিজ্ঞাপন
মিশায়েল তাঁর বহুদিনের এক স্বপ্ন পূরণ করতে চান৷ ট্যাটু শিল্পী রিচি তাঁকে সেই কাজে সাহায্য করতে পারেন৷ রঙিন, বাস্তবধর্মী ও দীর্ঘস্থায়ী ট্যাটু বা উলকি আঁকাই তাঁর বিশেষত্ব৷
শরীরের সংযোজক তন্তুর মধ্যে পাকাপাকিভাবে থেকে যায় বলে বহুকাল ধরে বিজ্ঞানীদের ধারণা৷ বাস্তবে কিন্তু তা ঘটে না৷ সেগুলি আসলে ম্যাক্রোফেজ বা স্ক্যাভেঞ্জার কোষে জমা হয়৷
উলকি কেন দীর্ঘস্থায়ী?
মার্সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ উলকির দীর্ঘ আয়ুর রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছেন৷ সেই লক্ষ্যে তাঁরা বিশেষ প্রজনন প্রক্রিয়ায় এক ‘সুপার মাউস' সৃষ্টি করেছিলেন৷ এই ইঁদুরের বিশেষত্ব হলো, গবেষকরা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের মাধ্যমে সেটির ত্বকের স্ক্যাভেঞ্জার কোষ মেরে ফেলতে পারেন৷ কিন্তু চরম জীবাণুমুক্ত পরিবেশেই সেটা করা সম্ভব৷ কারণ এই কোষ শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷
ইমিউন বায়োলজিস্ট সঁদ্রিন অঁরি ও তাঁর টিম এই ধরনের একদল ইঁদুরের লেজে উলকি এঁকেছিলেন৷ ট্যাটুর রং যদি সত্যি পাকাপাকিভাবে ম্যাক্রোফেজে জমা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে স্ক্যাভেঞ্জার কোষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে উলকিরও উধাও হয়ে যাওয়া উচিত৷ কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটলো না৷
উলকি ছাড়া আবার ফুটবলার কিসের?
হাল আমলের কোনো নামি-দামি ফুটবলারকে উলকি ছাড়া দেখতে পাবেন না৷ উলকি যত বড় আর যত বেশি হবে, ততই ভালো৷ এক কথায়, ব়্যাপ গায়কদের কাছে ‘ব্লিং-ব্লিং’ যা, ফুটবলারদের কাছে উলকিও তাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Valat
টোনি ক্রোস
বাবা হবার আগে জার্মানির জাতীয় দলের মিডফিল্ডার টোনি ক্রোসের হাত দু’টো ‘খালিই’ ছিল৷ লেয়ন আর আমেলির জন্মের পর তা বদলে গেছে: টোনির বাঁ হাতে উলকি করা রয়েছে ছেলে লেয়নের মুখ আর সেই সঙ্গে তার নাম ও জন্মের তারিখ; ডান হাতে উলকি করা রয়েছে মেয়ে আমেলির নাম আর জন্মের তারিখ৷ কাজেই টোনির ছেলে-মেয়েদের জন্মদিন ভুলে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Thissen
ডেভিড বেকহ্যাম
ইংল্যান্ড, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও লস এঞ্জেলেস গ্যালাক্সির সাবেক তারকা ডেভিড বেকহ্যাম নিজের গায়ে তাঁর সব ক’টি ছেলে-মেয়ের নাম ও স্ত্রী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি উলকি করিয়ে রেখেছেন৷ এছাড়া রয়েছেন যিশুখ্রিষ্ট ও একাধিক দেবদূত, সেই সঙ্গে বাইবেল থেকে একটি উদ্ধৃতি: ‘‘আমি আমার প্রিয়তমার ও আমার প্রিয়তমা আমার৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Globe-ZUMA
স্লাটান ইব্রাহিমোভিচ
তিন বছর আগে পিএসজি-র তারকা স্লাটান ইব্রাহিমোভিচ তাঁর অন্যান্য উলকির সঙ্গে ৫০ জন অনশনপীড়িত মানুষের নাম যোগ করেন৷ সারা বিশ্বে যে ৮০ কোটির বেশি মানুষ না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে রয়েছেন, তাদের প্রতীক হিসেবে ইব্রাহিমোভিচের এই পদক্ষেপ৷ কিন্তু গোল করার পরে স্লাটান যখন তাঁর জার্সি খুলে ফেলেন, তখন রেফারি তাঁকে যথারীতি হলুদ কার্ড দেখান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Valat
জেরোম বোয়াটেং
বায়ার্ন মিউনিখের ফুলব্যাক জেরোম বোয়াটেং-এর উলকির মধ্যে নানা ধরনের লেখা ছাড়াও ফুটবলের বিশ্বের একাধিক প্রতীক পাওয়া যাবে৷ তাঁর ডান কনুইতে চ্যাম্পিয়নস লিগের সরকারি বলটি উলকি করা রয়েছে; আবার ২০১৪ সালে জার্মানি বিশ্বকাপ জেতার পর বোয়াটেং তাঁর পায়ের ডিমে সেই কাপের একটি উলকি করান৷ তবে ২০১৮ সালের জন্য এখনও জায়গা আছে...৷
ছবি: Twitter/Jerome Boateng
লিওনেল মেসি
ফুটবলের জগতে লিওনেল মেসির নাম কারো অজানা নয়৷ কিন্তু তাঁর কোমরের নীচে যে দু’টি লাল ঠোঁট উলকি করা আছে, সেটা কি জানতেন?
ছবি: Twitter/FC Barcelona
লিওনেল মেসি (২)
লাল ঠোঁটের আগেই মেসি তাঁর বাঁ পায়ের উলকিগুলোকে পুরোপুরি কালো উলকি দিয়ে ঢেকে দেবার সিদ্ধান্ত নেন৷ পুরনো উলকিগুলো বোধহয় আর পছন্দ হচ্ছিল না, তাই সেগুলোকে ‘কালো মোজার’ অন্তরালে অদৃশ্য করে দেওয়া হলো৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D.Magno
টিমো হর্ন
কোলোনের গোলকিপার টিমো হর্নের পিঠের উলকিটিতে তাঁর ব্যাপটিজমের সময়কার বাইবেলের লাইন ক’টি ছাড়াও একটি সিনেমার পোস্টারের কায়দায় আঁকা ছবি রয়েছে৷ উলকিটি করেছেন উলকি জগতের নামকরা শিল্পী অস্কার ‘‘দা ভিঞ্চি’’ বোগে, অনেক বড় বড় ফুটবলার যার বাঁধা খদ্দের৷
ছবি: Privat
ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো
বিশ্বের যে সেরা ফুটবলারের কথায় কথায় জামা খুলে ফেলে ‘সিক্সপ্যাক’ দেখানোর প্রবণতা আছে, তাঁর গায়ে কিন্তু একটিও উলকি নেই!
ছবি: picture-alliance/SvenSimon/F. Hoermann
8 ছবি1 | 8
গোটা প্রক্রিয়া ভালোভাবে বুঝতে সঁদ্রিন অঁরি মাইক্রোস্কোপের নীচে ট্যাটু আঁকা ইঁদুরের স্ক্যাভেঞ্জার কোষ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন৷ সঁদ্রিন বলেন, ‘‘আমরা লক্ষ্য করলাম, যে ম্যাক্রোফেজের মৃত্যুর সময় তা কালি ছেড়ে দিচ্ছে৷ ত্বকের মধ্যে সব কালি মুক্ত হয়ে গেছে৷ আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে দেখা যাচ্ছে, যে নতুন করে আসা ম্যাক্রোফেজ সেই কালি দখল করছে৷ ফলে কালি আবার ম্যাক্রোফেজে প্রবেশ করছে৷''
রং যে সত্যি একটি ম্যাক্রোফেজ থেকে আরেকটিতে চলে যায়, একেবারে নতুন এই জ্ঞান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে তাঁরা ভুলত্রুটির সব সম্ভাবনা দূর করতে চেয়েছিলেন৷ তাই তাঁরা উলকি আঁকা ইঁদুরের ত্বক তুলে নিয়ে অন্য একটি ইঁদুরের শরীরে বসিয়েছিলেন৷ রং কি সত্যি একটি প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীর শরীরে চলে যাতে পারে? বাস্তবে সত্যি তা ঘটলো৷ সঁদ্রিন অঁরি বলেন, ‘‘এই সব পরীক্ষা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, যে আসলে ট্যাটু অত্যন্ত গতিশীল এক প্রক্রিয়া৷ কোষ সবসময়ে নতুন কালি গ্রহণ করে, তারপর ছেড়ে দেয় এবং নতুন করে তা গ্রহণ করে৷''
উলকি কেন ফ্যাকাশে?
কয়েক বছর পর উলকি কেন একটু অস্পষ্ট ও ফ্যাকাশে হয়ে পড়ে, এর ফলে তা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল৷ কারণ নতুন স্ক্যাভেঞ্জার কোষ সব ক্ষেত্রে অন্য কোষের ছেড়ে দেওয়া কালি হুবহু গ্রহণ করতে পারে না৷
অবশিষ্ট রংয়ের কী দশা হয়, জার্মানির রেগেন্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত পদার্থবিদ ভল্ফগাং বয়েমলার তা নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তিনি মৃত প্রাণীর উলকির লসিকাগ্রন্থি কেটে জানতে পেরেছেন, যে রঙের কিছু অংশ সেখানে জমা হয়৷ উলকির রং অনুযায়ী সবুজ অথবা লাল রং সেখানে দেখা যায়৷ বয়েমলার বলেন, ‘‘আনুমানিক প্রায় ৩০ শতাংশ রং ত্বকে থেকে যায়৷ রংয়ের তীব্রতা অত্যন্ত বেশি হওয়ায় উলকিধারী তা টেরও পান না৷ বাকি বড় অংশ শরীরের মধ্যে পাচার হয়ে যায়৷ তার একটা অংশ লসিকাগ্রন্থির মধ্যে জমা হয়৷ কিছুটা যকৃতেও চলে যায়৷ সামান্য কিছু অংশ শরীর ত্যাগ করে৷ তবে যারাই ট্যাটু বসাতে চায়, তাদের মনে রাখতে হবে যে রংয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ও তার মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ কখনো কখনো আজীবন শরীরে থেকে যায়৷''
তাই মিশায়েল যে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে ট্যাটু আঁকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এমনটাই করা উচিত৷ তিনি সচেতন, যে সারা জীবন এই উলকি বয়ে বেড়াতে হবে৷ ট্যাটুর রং সত্যি সারা জীবন তাঁর শরীরে থেকে যাবে৷
সাবিনে ফ্র্যুবুস/এসবি
গায়ে আঁকা উলকি থেকে ক্যানসার হতে পারে
নিজেকে সুন্দর দেখাতে কে না চায়? কিন্তু তাই বলে ক্যানসারের মতো অসুখ হবার আশঙ্কাকে গায়ে না মেখে বরং গায়ে নিত্য নতুন ছবি বা উলকি এঁকে ক্যানসারকে আহ্বান জানানো কি উচিত?
ছবি: Martin Magunia
সৌন্দর্য বাড়াতে গায়ে উলকি আঁকা
সবাই চায় নিজেকে সুন্দর দেখাক, তার দিকে তাকিয়ে থাকুক অন্যরা৷ কিন্তু তাই বলে ক্যানসারের মতো মারণব্যাধিকে উপেক্ষা করে? হ্যাঁ, তাই করছে জার্মানিসহ বিশ্বের নানা দেশে এই প্রজন্মের অনেক ছেলে-মেয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ঝুঁকিপূর্ণ সৌন্দর্য
জার্মানিতে বর্তমানে ৩৪ বছরের নীচে প্রতি চার জনের একজন গায়ে ছোট-বড় নানা ধরনের উলকি আঁকা রয়েছে৷ এই ‘ট্রেন্ড’ বা প্রবণতা চলতে থাকলে আগামীতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা৷ কারণ গায়ে উলকি আঁকতে যে রং ব্যবহার করা হয়, সে রংয়ের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ঢুকে যায় শরীরের অনেক গভীরে – যা ঝুঁকিপূর্ণ৷ এ কথা বলেন জার্মানির ঝুঁকি গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তা অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস লুক৷
ছবি: Frank Zeller/AFP/Getty Images
মতপার্থক্য
তিনি আরো বলেন, যন্ত্রের সাহায্যে সূচ ঢুকিয়ে যে সুন্দর-সুন্দর ছবি আঁকা হয় গায়ে তা দেখতে অনেকের কাছে ভালো লাগতে পারে৷ লুক আরো বলেন , রং ব্যবহারের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে৷ এই রংগুলো থেকে ক্যানসার হতে পারে, বিশেষ করে কালো রং, যদিও এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও মতপার্থক্য রয়েছে৷ছবিতে জার্মানির উলকি শিল্পী হ্যারবার্ট হফমান৷
ছবি: AP
অ্যালার্জি
রেগেন্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিষয়ক পদার্থবিদ প্রোফেসার ভল্ফগাং বয়েমলার বলেন, উলকি আঁকার রং থেকে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে৷ তাছাড়া উলকি আঁকার সময় সবকিছু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে সেখান থেকে ইনফেকশনও হতে পারে৷ বিশেষ করে নিকেল থেকে অনেকেরই অ্যালার্জি হয়ে থাকে৷
ছবি: Fraunhofer IWU
প্রথম উলকি আঁকার দোকান
১৯৫৯ সালে হামবুর্গ শহরের এই দোকানটিতেই জার্মানিতে প্রথম উলকি আঁকা শুরু হয়৷ আর এখন প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই রয়েছে এ ধরনের দোকান, যেগুলোতে বেশ ভিড় হয়৷
ছবি: ullstein
বিজ্ঞাপনে উলকি
মাঝে মধ্যে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনেও উলকি ব্যবহার করা হয়৷ এই ছবিতে দেখুন, একটি মোটর সাইকেলের বিজ্ঞাপনে উলকি ব্যবহার করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa
ছোট বড় নানা ধরনের উলকি
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উলকি আঁকা হয়৷ কারো পুরো হাতে আবার কারো বা পুরো শরীরে ৷ দেখে মনে হয় যেন কাপড়ের ডিজাইনটাই ওরকম৷