ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার শরিয়ত বয়াতিকে কেন জামিন দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাই কোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষকে এর জবাব দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
শরিয়ত বয়াতির করা জামিন আবেদনের শুনানি শেষে বুধবার বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীর বেঞ্চ এ রুল দেয়। বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেছেন আইনজীবী মনিরা হক মনি৷ রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল গিয়াস উদ্দিন আহমেদ৷
শরিয়তের আইনজীবী মনিরা হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ''শরিয়ত বয়াতির যে ভিডিওকে কেন্দ্র করে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, ৫১ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের সেই ভিডিওর অনুলিখন আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা বলেছি, শরিয়ত বয়াতির ভিডিওটি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে মামলা করা হয়েছিল।''
তিনি বলেন, "সেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মত কিছু নাই। তাছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮/২ ধারা তার জন্য প্রয়োজ্য নয়। ফলে তার বিরুদ্ধে এ মামলাই চলে না। এসব যুক্তি উপস্থাপন করে আমরা জামিন চেয়েছিলাম। আদালত রুল জারি করেছে।”
মামলার নথিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার ধামরাই উপজেলার রৌহাট্টেক এলাকায় পীর হযরত হেলাল শাহ্ পীরের ১০ম বার্ষিক পালাগানের অনুষ্ঠানে শরিয়ত বয়াতি গানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন এখনো পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলে
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন তৈরি হয়েছে, এবং এখনো বলবৎ আছে, তাতে কী বলা হয়েছে৷ ছবিঘরে জেনে নিন কিছু আশ্চর্য আইনের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার কয়েকটি কিছুটা সংশোধিত আকারে আজও রয়ে গেছে৷ যেমন: ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩৷ এ আইন অনুযায়ী, যে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের আগে জেলার ডেপুটি কমিশনারের লিখিত অনুমোদন লাগবে৷ এটি ১৮২৩ সালে ভারতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গর্ভনর জেনারেল জন অ্যাডামের অধ্যাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দণ্ডবিধি ১৮৬০
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ‘১২৪ ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে, তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এটি একেবারেই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন৷ একই আইনের ‘৫০৫ খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো প্রতিবেদন বা বিবৃতি যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাকে ৭ বছর কারাভোগ করতে হবে৷ একইভাবে মানহানির জন্য ৪৯৯ এবং ৫০১ অনুচ্ছেদে শাস্তির বিধান রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪
বাংলাদেশের অবাধ তথ্যের প্রবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন বা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪৷ প্রথমটিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা যেতে পারে এমন কোনো বিষয় কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় আইনে রাষ্ট্রের চোখে অনিষ্টকর কোনো তথ্য গণমাধ্যমে কেউ প্রকাশ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে৷ অথচ ৩৯(২)-এ এই স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই’ নিশ্চিত হবে বলা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে অথবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে এই বাধা-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Jaspersen
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা
২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে কোনো ব্যক্তি যদি ইন্টারনেটে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা কারো মানহানি ঘটে, কিংবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, বা এ ধরনের তথ্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে দেয়া হয়, তাহলে এটি অপরাধ এবং সেই অপরাধে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: Schlierner - Fotolia.com
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা
এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ৷
ছবি: Badruddoza Babu
৩২ ধারায় শাস্তি
এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে৷ কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে৷
ছবি: Imago/IPON
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯
এই আইনটি বাক স্বাধীনতার পক্ষে৷ বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’’ আরো বলা হয়েছে, ‘‘তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Dinodia Photo Library
8 ছবি1 | 8
পরবর্তীতে তার গান ও বক্তব্য ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে কোরান ও মহানবী হযরত মোহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়৷ গানের মধ্যে বক্তব্যের মধ্যে এক পর্যায়ে শরীয়ত সরকার বলেন, কোরানে কোথাও গান-বাজনা নিষিদ্ধ করা হয়নি৷ এমনকি কেউ তা প্রমাণ করতে পারলে তাকে ৫০ লাখ টাকা দেয়ার চ্যালেঞ্জও জানান বয়াতি৷
টাঙ্গাইলের মাওলানা ফরিদুল ইসলাম মীর্জাপুর থানায় ডিসেম্বরেই এ মামলা করেন৷
বিতর্কিতআইন
২০১৮ সালে পাস হওয়ার আগে থেকেই এই আইনের নানা দিক ও এর অপব্যবহারের শঙ্কায় বিরোধীতা হয়েছে নানা পক্ষ থেকে৷ বিশেয করে এ আইনকে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে বলে ব্যবহার করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়৷ কিন্তু সরকার বরাবরই এসব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে৷
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার' এর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' এর জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে এই আইনে৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে গত বছর অন্তত ২৯ জনকে আটক করা হয়েছে এই আইনের আওতায়৷ একই ধরনের অভিযোগে গত বছরের মে মাসে বরিশালে নিজ বাসা থেকে আটক করা হয়েছিল কবি হেনরি স্বপনকে৷
এডিকে/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, এএফপি, আল জাজিরা)