শর্মিলা পানোলির গ্রেপ্তার নিয়ে বিতর্ক কেন?
২ জুন ২০২৫
সামাজিক মাধ্যমের এই ইনফ্লুয়েন্সারকে দিল্লির লাগোয়া হরিয়ানার গুরুগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
শর্মিষ্ঠা কলকাতার আনন্দপুর এলাকার বাসিন্দা। তিনি পুনেতে আইন নিয়ে পড়াশুনো করেন। পহেলগাম কাণ্ডের পর তিনি সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কিত পোস্ট করেন বলে অভিযোগ। তারপর গার্ডেনরিচ থানায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ আনা হয়।
কলকাতা পুলিশ সেই অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। কলকাতা পুলিশের পোর্ট ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার হরিকৃষ্ণ পাই বলেছেন, "একটি অভিযোগ করা হয়েছে, তদন্ত চলছে। আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
যে ভিডিও নিয়ে এই বিতর্ক, সেটা শর্মিষ্ঠা ডিলিট করে দেন। তিনি এই ভিডিও পোস্ট করার জন্য ক্ষমা চান। তিনি দাবি করেছেন, তার পোস্টগুলি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল।
কলকাতা পুলিশের বক্তব্য
এই ঘটনার পর কলকাতা পুলিশকেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ও রাজ্যসভা সাংসদ মননকুমার মিশ্র একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ''শর্মিষ্ঠাকে গ্রেপ্তার করাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। মতপ্রকাশের অধিকারের উপর আক্রমণ। পোস্ট ডিলিট করার পর, ক্ষমা চাওয়ার পর এই ঘটনা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের উপর আঘাত।'' বিভিন্ন জায়গা থেকেও এই ধরনের সমালোচনা এসেছে।
এরপর কলকাতা পুলিশ এক্স হ্যান্ডেলে বলেছে, ''কিছু সামাজিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে, পুলিশ পাকিস্তানের বিরোধিতা করার জন্য বেআইনিভাবে একজন আইন পড়ুয়াকে গ্রেপ্তার করেছে। এই ন্যারেটিভ বিভ্রান্তিকর ও ক্ষতিকর। জাতীয় গর্ব ও দেশপ্রেমের প্রকাশ সব নাগরিক ও সংগঠন করে, কলকাতা পুলিশও দেশের মানুষের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।''
কলকাতা পুলিশ জানিয়েছে, ''এই ঘটনার ক্ষেত্রে গার্ডেনরিচ থানায় অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করা হয়। অভিযোগ ছিল, ভিডিওতে এক শ্রেণির ভারতীয় নাগরিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমান করা হয়েছে। ঘৃণা ছড়ানো ও বিরোধের উদ্দেশ্য নিয়ে এটা করা হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার উপযুক্ত ধারা অনুসারে মামলা দায়ের করা হয়, অভিযোগের তদন্ত করা হয়, আইনি পদ্ধতি মেনে অনেকবার তাকে নোটিশ দেয়ার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু প্রতিবারই দেখা যায়, তিনি পলাতক। তারপর আদালত অবমাননার অভিযোগে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়। তারপর তাকে আইনসঙ্গতভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে নিয়ে কলকাতা আসার অনুমতি দেন। পরে আদালত তাকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে পাঠিয়েছে।''
পুলিশ বলেছে, ''ভারতীয় ন্যায়সংহিতা অনুসারে হেট স্পিচ দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কোনোরকম অসদাচরণ করা যায় না। যে সময়ে দেশের সাহসী নাগরিকরা সীমান্তে লড়াই করছিলেন, সারা দেশ তাদের সমর্থন করছিল, তখন সামাজিক মাধ্যমে ক্ষতিকর ও অপমানকর কনটেন্ট পোস্ট করা অপরাধ। এটা আমাদের শত্রুকেই সাহায্য করে। কলকাতা পুলিশ আইন মেনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। দেশপ্রেম দেখানো বা তার ব্যক্তিগত ভাবনা প্রকাশের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অপরাধমূলক কনটেন্ট , ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।''
কঙ্গনা রানাওয়াতের বক্তব্য
বার্তাসংস্থা এএনআই জানিয়েছে, বিজেপি সাংসদ ও অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত বলেছেন, ''আইন-শৃঙ্খলার নামে কাউকে হয়রানি করা ঠিক নয়। যখন একজন পোস্ট ডিলিট করে ক্ষমা চেয়েছেন, তখন তাকে জেলে ভরা, নির্যাতন করা, তার কেরিয়ার শেষ করে দেওয়া, তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা অন্য়ায়। কোনো মেয়ের সঙ্গে এটা হওয়া উচিত নয়।''
কঙ্গনা বলেছেন, ''আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, রাজ্যটাকে উত্তর কোরিয়া বানিয়ে দেবেন না। সকলের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। মেয়েটি খিব সাধারণভাবে এবং এখনকার যুবরা যে ভাষায় কথা বলে, তা ব্যবহার করে পোস্ট করেছিল। মেয়েটির সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। তাকে এখনই জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হোক।''
আইন প্রয়োগের মাপদণ্ড কী হবে?
লেখক ও হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণারত মিলন দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বাক স্বাধীনতার বিষয়টি তো একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকমভাবে নির্ধারিত হচ্ছে। রাজ্য়ের পুরমন্ত্রী ও কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম একাধিকবার বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, তার বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রী ক্যাপ্টেন সোফিয়া কুরেশিকে সন্ত্রাসবাদীদের বোন বলেন, তাকে তো ইস্তফা দিতে বলা হয় না বা তাকে গ্রেপ্তার করা হয় না।''
ফিরহাদ হাকিম গত ডিসেম্বরে বলেছিলেন, ''আমরা এমন একটা সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ শতাংশ থাকলেও সারা ভারতে মাত্র ১৭ শতাংশ আছে। তাই আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলা হয়। কিন্তু আমরা আমাদের সংখ্যালঘু বলে ভাবি না। আমরা একদিন সংখ্যাগুরুর থেকেও সংখ্যাগুরু হতে পারি। আমাদের সামর্থ্যকে এমন জায়গায় রাখতে হবে যে, আপনি নিজেই ন্যায় দিতে পারবেন। ন্যায় চাওয়ার দরকার হবে না।''
মিলন বলেছেন, ''আমাদের দেশে কে বলছেন সেটা দেখা হয়, আইন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়। তাই কে বলছেন, তার উপর সবকিছু নির্ভর করে। আদালত যখন হস্তক্ষেপ করে, তখন বিষয়টা বদলায়। সম্প্রতি অশোকা বিশ্ববিদ্য়ালয়ের অধ্যাপকের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।''
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। সেই সঙ্গে দায়িত্বের কথাটাও সংবিধানে বলে দেয়া হয়েছে। কারও বিশ্বাসে আঘাত করে কথা বলা যায় না। আবার এটাও বলে দেওয়া হয়েছে, আইনের কাছে সবাই সমান। কেউ আইনের উপরে নয়। একটা কাজ আইনত করা না গেলে, তা কেউ করতে পারবেন না। করলে শাস্তি পেতে হবে। বেছে বেছে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না।''