পরিবেশবান্ধব শহর সম্ভব করতে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা উচিত নয়৷ হামবুর্গের এক গ্রাফিক ডিজাইনার অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সম্ভাব্য সমাধানসূত্র তুলে ধরছেন৷ নেদারল্যান্ডসের সাইকেলবান্ধব অবকাঠামো তাকে প্রেরণা দিচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
হামবুর্গের হোলস্টেনপ্লাৎস এলাকায় ভবিষ্যতে হয়ত কোনো গাড়িঘোড়া চলবে না৷ চারিদিকে সবুজের সমারোহ থাকবে৷ পথচারী ও সাইকেল-চালকদের জন্য সেটা হবে এক স্বর্গীয় অনুভূতি৷
কিন্তু বাস্তবে অবস্থা এখনো বদলায়নি৷ শহরের গ্রাফিক ডিজাইনার ইয়ান কামেনস্কির সেটা মোটেই পছন্দ নয়৷ তিনি রাজপথে মৌলিক পরিবর্তন চান৷ সেই তাগিদ থেকে তিনি অ্যানিমেশনের মাধ্যমে কাল্পনিক জগত সৃষ্টি করেন৷ ইয়ান জানালেন, ‘‘করোনা সংকটের শুরুতে এই প্রকল্প শুরু হয়েছিল৷ চারিদিকে নজর দিয়ে ভেবেছিলাম, আমি আর অত্যন্ত জরুরি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করবো না, বরং নিজেই একটা অবদান রাখবো৷ ভিসুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে শহরে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে মনোযোগ দিলাম৷''
ইয়ান গোটা বিশ্বে ধূসর সড়ক ও বিষাদময় চত্বরে পরিবর্তন আনতে চান৷ কমপক্ষে্ অ্যানিমেশনের মাধ্যমে সেই সম্ভাবনা তুলে ধরতে চান তিনি৷ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহর, বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস অথবা জার্মানির রাজধানী বার্লিন৷
একাধিক সামাজিক মাধ্যমে তিনি ‘ইউটোপিয়া ফর বাইসাইক্লিস্টস' নামের চ্যানেলও চালু করেছেন৷ ইয়ান কামেনস্কি ‘‘সাইকেলের জন্য আরও জায়গা এবং আরও সাইকেলের প্রয়োজন, যাতে সাইকেলের মাহাত্ম পুরোপুরি স্পষ্ট হয়৷ সাইকেল কার্বন নির্গমন ঘটায় না, অন্যান্য যানের তুলনায় কম জায়গা নেয় এবং নানাভাবে এটি কাজে লাগানো যায়৷''
জার্মানির প্রতিবেশী দেশ নেদারল্যান্ডসে ইয়ান কামেনস্কির স্বপ্ন আংশিকভাবে বাস্তব হয়ে উঠেছে৷ যেমন সে দেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহর উটরেখটে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার, অর্থাৎ জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ সাইকেল চালান৷ খারাপ আবহওয়াও তাদের দমিয়ে রাখতে পারে না৷
ক্রিস ব্রুন্টলেট সে কারণে অত্যন্ত খুশি৷ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি ‘ডাচ সাইক্লিং এম্ব্যাসি' নামের এক নেটওয়ার্ক চালান৷ সেটি আরও বেশি সাইকেলের জন্য আন্দোলন করছে৷ নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে ব্যস্ত সাইকেল সড়ক ‘ফ্রেডেনবুর্গ'-এ তিনি সাইকেল চালাতে খুব ভালোবাসেন৷ দিনে প্রায় ৩৩,০০০ মানুষ সেই সড়ক ব্যবহার করেন৷ অতীতে সেখানে গাড়ির আধিপত্য ছিল৷ ক্রিস বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত অনেক শহরে সাইক্লিং শুধু শক্তপোক্ত, সাহসি ও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ৷ তারা মোটরগাড়ির সঙ্গে টক্কর দিতে পারেন৷ তবে শহরে এমন মানুষ মোটেই সংখ্যাগুরু নয়৷ তারা সচল থাকতে চায়, যাত্রা উপভোগ করতে চায়৷ সাইক্লিংয়ের জন্য নিরাপদ ও পৃথক জায়গা দিলে মানুষ আরও ঘনঘন সাইকেল চালাবে৷ আরও বেশি নারী, শিশু, বয়স্ক মানুষ, এমনকি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অনেকে এই যান বেছে নেবেন৷''
আমস্টারডামের সাইকেল ‘‘খোয়াড়’’
নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি৷ অবস্থা এমন যে, সাইকেলের কারণে রাস্তাঘাটে চলাই দায়৷ ফলে শহর কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে পার্ক করা সাইকেলগুলো তুলে নিয়ে রেখে দেয় এক বিশেষ জায়গায়৷
ছবি: DW/C. Nasman
সাইকেল অনেক, জায়গা কম
আমস্টারডাম শহরে মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি৷ নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর জনসংখ্যা সাত লাখের মতো৷ আর সাইকেলের সংখ্যা আনুমানিক দশ লাখ৷ সাইকেল পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গা আছে শহরে৷ কিন্তু সেগুলো ভরা থাকে অধিকাংশ সময়৷ তাই অনেকে রাস্তার পাশে অবৈধভাবে রাখেন সাইকেল৷ সেখানে সাইকেল চুরিও এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার৷
ছবি: DW/C. Nasman
সাইকেল যখন মাথাব্যাথার কারণ!
আমস্টারডামে সাইকেল পার্ক করা এক জটিল ব্যাপার৷ রাস্তাগুলো সরু আর সাইকেল পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গাও কম৷ এই সাইকেল আরোহী আমস্টারডাম ট্রেন স্টেশনের বাইরে সাইকেলটি রাখার জায়গা খুঁজছেন৷
ছবি: DW/C. Nasman
আগে আসলে, আগে পাবেন
আমস্টারডাম ট্রেন স্টেশনের বাইরে একটি খালের উপর গড়ে তোলা সাইকেল রাখার জায়গার ছবি এটি৷ তিন তলা এই পার্কিংয়ে আড়াই হাজারের বেশি সাইকেল বিনা খরচায় রাখা যায়৷ তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাইকেল সরিয়ে নিতে হয়৷ আগে আসলে, আগে পাবেন ভিত্তিতে সাইকেল রাখার জায়গা পাওয়া যায় এখানে৷
ছবি: DW/C. Nasman
সাইকেল বন্যার ঝুঁকি
পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গার বাইরে রাখা সাইকেলগুলো শহর কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়ে যায়৷ এরপর সেগুলোকে রাখা হয় সাইকেলের খোয়াড়ে, নেদারল্যান্ডসের ভাষার যাকে বলে ‘‘ফিয়েটসডিপো৷’’ আমস্টারডামের সাইকেলের খোয়াড়ের ম্যানেজার পিটার বের্কহ্যুট এই বিষয়ে বলেন, ‘‘সাইকেলগুলো না সরানো হলে গোটা শহর সাইকেলে ঢেকে যাবে৷ তখন হাঁটাচলা অসম্ভব হয়ে যাবে৷’’ ২০১২ সালে খোয়াড়ে জমা হয়েছিল ৬৫,০০০ সাইকেল৷
ছবি: DW/C. Nasman
নতুন আগত
আমস্টারডাম ট্রেন স্টেশনের কাছ থেকে তুলে আনা সাইকেলগুলো গাড়ি থেকে নামাচ্ছেন খোয়াড় কর্মীরা৷ হঠাৎ একদিন শহর কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে পার্ক করা সাইকেলের সন্ধানে বের হন৷ এরপর সেসব সাইকেলের লক কেটে গাড়িতে তুলে খোয়াড়ে নিয়ে আসেন৷ সেখানে একসঙ্গে ১২ থেকে ১৭ হাজার সাইকেল রাখা যায়৷
ছবি: DW/C. Nasman
রেকর্ড রাখা
এই সাইকেলগুলোকে খোয়াড়ে জমা করার জন্য রাখা হয়েছে৷ একটু লক্ষ্য করে দেখা যাবে প্রতিটি সাইকেলে কমলা রংয়ের ট্যাগ জুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ এভাবে সাইকেলের রং, নকশা, সিরিয়াল নম্বর, তুলে নেয়ার স্থানসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে রাখা হয়৷ কোনো সাইকেল আগে চুরি হয়েছিল কিনা সেটাও পরীক্ষা করে দেখা যায় এই পদ্ধতিতে৷
ছবি: DW/C. Nasman
হ্যালো, পুরনো বন্ধু!
রাস্তায় সাইকেল পার্ক করার কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে যদি দেখেন সেটি হাওয়া হয়ে গেছে, তখন কেমন লাগবে? নিঃসন্দেহে কষ্ট পাবেন আপনি৷ ২৭ বছর বয়সি ইমকা লিগ্টহার্ট একবার এমন পরিস্থিতিতে পরেছিলেন৷ তবে তিনি দ্রুতই ফোন করেন সাইকেলের খোয়াড়ে৷ পরেরদিন খোয়াড়ে গিয়ে সাইকেলটিও খুঁজে পান৷ তবে সেটি ফেরত পেতে দশ ইউরো জরিমানা গুনতে হয়েছিল তাঁকে৷
ছবি: DW/C. Nasman
প্রমাণ করুন
ফিলিপ বঙ্কের (২৬) জন্য সেদিনটা এমনিতেই খারাপ যাচ্ছিল৷ তার উপর টের পেলেন সাইকেলটাও হাওয়া৷ তবে তিনি মনে করেন, অবৈধভাবে পার্ক করে রাখা সাইকেল তুলে নেয়া ভালো, কেননা এতে করে অন্যরা পার্কিংয়ের জায়গা পায়৷ খোয়াড় থেকে নিজের সাইকেল ফিরে পেতে অবশ্য পরীক্ষা দিতে হয়েছিল ফিলিপকে৷ সাইকেলের লকে ঠিকঠাক চাবি ঢুকিয়ে পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি৷
ছবি: DW/C. Nasman
ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা
‘‘আমরা এগুলো মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই৷ এটাই আমারদের মূল উদ্দেশ্য’’, বলেন খোয়াড়ের ম্যানেজার বের্কহ্যুট৷ মালিকদের ফিরিয়ে দিতে সাইকেলগুলো তিন মাসের মতো খোয়াড়ে রাখা হয়৷ এই সময়ের মধ্যে মালিকরা সাইকেল নিতে না আসলে সেগুলো নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়৷ বের্কহ্যুটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, অনেক মালিকই হারিয়ে যাওয়া সাইকেলের খোঁজে খোয়াড়ে আসেন না৷ তাঁরা মনে করেন সাইকেল চুরি হয়ে গেছে৷
ছবি: DW/C. Nasman
9 ছবি1 | 9
নেদারল্যান্ডস ইতোমধ্যে সাইকেলের জন্য বাস্তব সমাধানসূত্র কার্যকর করে সবার নজর কাড়ছে৷ এমন সাইকেল-বান্ধব দেশ খুব কমই আছে৷ শহরের বাসিন্দাদের মতে, শহরের মধ্যে সাইকেল চালানো অনেক সুবিধাজনক৷ আরও দ্রুত ও আনন্দের সঙ্গে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়৷
ইয়ান হামবুর্গেও এমন অবস্থার স্বপ্ন দেখেন৷ তিনি কমপক্ষে বিষয়টি নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু করতে চান৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে থেকেই বিষয়টি উত্থাপন করে আমি আলোচনা শুরু করতে চাই৷ অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে বিষয়টি নিয়ে সংঘাত উসকে দিচ্ছি৷''
ইয়ান কামেনস্কি তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত করতে চান৷ প্যারিসের মতো শহরও অদূর ভবিষ্যতে তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে সাইকেলবান্ধব শহরে পরিণত হবে, এটা জেনে তিনি নিজের শহর হামবুর্গেও এমন পরিবর্তনের আশা করছেন৷