রোগ আর প্রাকৃতিক দুযোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের মানুষ৷ ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে৷ আর বন্যার কারণে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ৷
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ অবশ্য ততোটা আশঙ্কা দেখছেন না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘ম্যানেজমেন্ট ভালো৷ তবে মানুষ ডেঙ্গু আতঙ্কের কারণে হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছে৷ আর ডায়রিয়া মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে৷''
প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে৷ এতো দিন নগরবাসীর মনে ধারণা ছিলো, প্রাদুর্ভাব কিছুটা কমে আসবে৷ তবে সে আশায় পানি ঢেলে দিয়েছে আরেক খবর৷ দুই সিটি কর্পোরেশন মশা মারার যে ওষুধ ঢাক ঢোল পিটিয়ে ছিটাচ্ছে তাতে মরছে না মশা৷ এডিস মশার বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে৷ ওষুধ নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে৷ তাতে কী? মশা মারার ওষুধ কবে আসবে তা কেউ জানাতে পারছেন না৷ তাই এখন এডিস মশার কামড় খেয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছেন না নগরবাসী৷
‘ডেঙ্গু আতঙ্কের কারণে মানুষ হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছে’
বৃহস্পতিবার পাওয়া সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে৷ সরকারি ও বেসরকারি হাসপতালে জানুয়ারি থেকে আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৪৬ জন৷ মারা গেছে ১২ জন৷ বৃহস্পতিবার ভর্তি হয়েছেন ২০১ জন৷
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক বলেন,‘‘ডেঙ্গু আতঙ্ক তৈরি হয়েছে৷ ফলে যত রোগী ভর্তি হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে৷ হাসপাতাল ও হাসপাতালের বাইরে ডেঙ্গু রোগী বিবেচনায় নিয়ে যদি মৃত্যু হার শতকরা ১ ভাগের কম হয় তাহলে বলতে হবে এই রোগ খুব এফিশিয়েন্টলি হ্যান্ডেল হচ্ছে৷''
তিনি আরো জানান, দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হার এক শতাংশের নিচে৷ তাই ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ভালোই চলছে বলে অভিমত তাঁর৷ তিনি বলেন, ‘‘যদিও আমাদের ওপর চাপ পড়ছে৷ তারপরও আমরা এটা ম্যানেজ করতে পারব৷''
ভয়াবহ সব মশাবাহিত রোগ
ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, জিকা আমাদের কাছে খুব পরিচিত৷ কিন্তু এমন অনেক রোগ রয়েছে, যার নামও হয়ত আমরা জানি না৷ মশাবাহিত নানা ধরনের রোগ নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: CC/somaskanda
লাইশম্যানিয়াসিস
গর্ভবতী নারী মশাদের কামড়ে এই রোগ ছড়ায়৷ ৩০ ধরনের ভিন্ন প্রজাতির লাইশম্যানিয়াসিস জীবাণু রয়েছে৷ এর মধ্যে ১০টি মানবদেহে রোগ ছড়ায়৷ প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর ও মাথা ব্যাথা দেখা দেয়৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্কিন আলসার হয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়৷ তবে দ্রুত ডাক্তার না দেখালে যকৃত, বৃক্কসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ অঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে লাইশম্যানিয়াসিস৷
ছবি: WHO/C.Black
সিন্ডবিস
কুলেক্স নামের নিশাচর মশা এই রোগের ভাইরাস বহন করে৷ মূলত আফ্রিকায় পাওয়া গেলেও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে মানবশরীরে এই জীবাণুর অস্তিত্ব পেয়েছেন৷ এই মশার কামড়ে তীব্র জ্বর ও মস্তিষ্কে প্রদাহ দেখা দেয়৷ আরো ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন হাড়ের সংযোগেও প্রদাহের সৃষ্টি হয়৷ কয়েক সপ্তাহ পর এ রোগ এমনিতেই সেরে যায়৷ এর কোনো ওষুধ নেই৷
ছবি: Imago
ইয়েলো ফিভার
টাইগার মশা এবং এডিস প্রজাতির আরো কিছু মশার মাধ্যমে ইয়েলো ফিভার ছড়ায়৷ সাধারণভাবে একে ফ্লাভিবাইরাসও বলা হয়ে থাকে৷ আফ্রিকার ৩৪টি এবং দক্ষিণ ও মধ্য অ্যামেরিকার ১৩টি দেশে ইয়েলো ফিভারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি৷ শুরুতে জ্বর এলেও পরে তা বমি, এবং একসময় মেনিনজাইটিসে রূপ নেয়৷ গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হওয়া, এমনকিসম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/P. Whitaker
ডেঙ্গু
এডিস ইজিপ্টাই নামের মশার কামড়ে আক্রান্ত হলে শরীরে ব্যাথা হয়, লাল গুটি দেখা দেয়, মাংসপেশী ও হাড়ের জোড়াতেও ব্যাথা হয়৷ চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে রক্তক্ষরণে মৃত্যুও হতে পারে৷ প্রথমবারের ধাক্কা সামলে উঠলেই যে মুক্তি তা কিন্তু নয়৷ ডেঙ্গু রোগে কেউ দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে তা প্রথমবারের চেয়েও মারাত্মক হতে পারে৷
ছবি: R. Richter
জিকা
এডিস ইজিপ্টাই, টাইগার মস্কিউটো এবং এডিস আলবোপিকটাস জিকা ভাইরাস ছড়ায়৷ ২০১৫ সালে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ৷ জিকার আক্রমণে ব্রাজিলে অসংখ্য শিশু মাইক্রোসিফেলি নামের ভয়াবহ প্রতিবন্ধিত্ব নিয়ে জন্মায়৷ এর ফলে শিশুদের মাথার আকৃতি বিকৃত হয়ে যায়৷ বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা জিকায় আক্রান্ত হলে শিশুদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে বেশি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Lacerda
ওয়েস্ট নাইল ফিভার
বয়স্ক লোক বা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মানুষের ক্ষেত্রে এই রোগ ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনতে পারে৷ এর ফলে মেনিনজাইটিস ও মায়োকার্ডিটিস হতে পারে৷ অন্যান্য মশাবাহী রোগের মতো কাঁপুনি, ঠান্ডা লাগা, জ্বর, মাথা ব্যাথা, ঝিমুনি এবং ব়্যাশ দেখা দিতে পারে৷ এর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Pleul
চিকুনগুনিয়া
চিকুনগুনিয়ার প্রভাবে জ্বর কাটিয়ে উঠতে তিন-চার দিন লাগে৷ কিন্তু এর পর হাড়ের জোড়ায় ভয়াবহ ব্যথা কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়ায় ক্ষত দেখা দিতে পারে৷ তবে আশার কথা, একবার চিকুনগুনিয়া হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারেই কমে যায়৷
ছবি: Imago
ম্যালেরিয়া
মশাবাহী রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে বেশি পরিচিত৷ অ্যানোফিলিস নামের মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়৷ এই রোগে আক্রান্ত হলে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হতে পারে৷ ম্যালেরিয়ার কার্যকর ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি৷ তবে আগে থেকে সতর্ক থাকলে এতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা কমানো যেতে পারে৷
ছবি: Cécilia Conan
8 ছবি1 | 8
বন্যা ও ডায়রিয়া:
বাংলাদেশের ২১ জেলার ১৫ লাখেরও বেশি মানুষ এখন বন্যা দুর্গত৷ আগামী ২৪ ঘন্টায় বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর ও মুন্সিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে৷
২০ জেলার ৭৩টি উপজেলায় ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী এসব উপজেলায় ১০ জুলাই থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১,০৮০ জন৷ এই হিসাব অবশ্য হাসপাতালে ভর্তির হিসাব৷ তবে এখন পর্যন্ত কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি৷ নেত্রকোনা, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বান্দরবান, কক্সবাজার, মৌলভীবাজারসহ আরো কয়েকটি জেলার ডায়রিয়া পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে ডায়রিয়ার চিকিৎসার জন্য ২০ জেলায় এক হাজার ৯৫৮টি মেডিকেল টিম কাজ করছে৷ আর এক হাজার ৩১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে৷
ডায়রিয়ায় কেউ মারা না গেলেও বন্যায় এ পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ যাদের অধিকাংশই পানিতে ডুবে মারা গেছেন৷ এদিকে পাহাড় ধসে এ পর্যন্ত মারা গেছেন আট জন৷ আহত হয়েছেন ১৪ জন৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘‘আমরা বন্যার পূর্বভাস পেয়েই ডায়রিয়া এবং বন্যার সময় অন্য যেসব রোগ হয় তার প্রস্তুতি নিয়েছি৷ আমাদের স্ট্যান্ডিং মেডিকেল টিম গঠন করা থাকে৷ ওষুধের মজুদ ২০ ভাগ বাড়িয়ে দিয়েছি৷ আর বাংলাদেশের মানুষ ডায়রিয়ার ব্যাপারে দক্ষ৷ এর বাইরে আমরা অন্যান্য রোগ ও বিপদের ব্যাপারে সচেতনতামূলক কর্মসূচিও পরিচালনা করছি৷''