‘শাজাহান খান থাকায় সুবিধা হবে'
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯শাজাহান খানের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের এই কমিটি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আর দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ প্রণয়ন করবে৷ শাজাহান খান একই সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি৷ তিনি যখন নৌমন্ত্রী ছিলেন তখনও সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি পদে বহাল ছিলেন৷
শাজাহান-নামা
শাজাহান খান সর্বশেষ তুমুল আলোচনায় আসেন গত বছরের ২৯ জুলাই দুপুরে ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহণের এক বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব নিহত হওয়ার ঘটনায় বিতর্কিত মন্তব্য করে৷
ওই দিনই বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা শাজাহান খানকে প্রশ্ন করলে তিনি পুরোটা সময় হাসতে হাসতে জবাব দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আপনারা লক্ষ্য করেছেন ভারতের মহারাষ্ট্রে গাড়ি দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছেন৷ এগুলো নিয়ে কি ওখানে কথা বলে? আমি মনে করি এ বিষয়ে যদি আপনারা আলোচনা করতে চান, এটা নিয়ে পরে আলোচনা হবে৷''
তাঁর এই হাসি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লে তিনি ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন৷ আর ওই ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে, যা এক সপ্তাহের জন্য ঢাকাসহ পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দেয়৷ সেই আন্দোলনে শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবি উঠলেও তিনি তখন নৌমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি৷
এরপর নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইন হলে তার বিরুদ্ধে মোটরযান শ্রমিকরা মাঠে নামেন৷ গত অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁরা তিনদিনের জন্য সারাদেশ অচল করে দেন৷ এর পেছনেও ছিলেন শাজাহান খান৷
২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে চালকদের পক্ষ নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন শাজাহান খান৷ চালকদের লাইসেন্সে কড়াকড়ি আর সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের দাবির জবাবে তখন তিনি বলেন, ‘‘দেশে চালকের সংকট আছে৷ আর এই বাস্তবতার ভিত্তিতে অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেয়া দরকার৷ কারণ, তারা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চেনে৷ সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেয়া যায়৷''
শাজাহান খান একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং শীর্ষ শ্রমিক নেতা হওয়ায় সব সময়ই বিতর্কের মধ্যে ছিলেন৷ ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট'এর প্রশ্ন তুলেও তাঁকে মন্ত্রীর পদ থেকে সরানো যায়নি৷ তবে এবার তিনি সংসদ সদস্য পদে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও মন্ত্রীত্ব আর জোটেনি৷ ধারণা করা হয় তাঁকে বিতর্কের কারণেই আর মন্ত্রীত্ব দেয়া হয়নি৷ এতে দেশের নাগরিকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেন৷
কমিটির প্রধান করায় প্রতিক্রিয়া
শাজাহান খানকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটির প্রধান করায় সমালোচনা শুরু হয়েছে৷ চিত্রনায়ক এবং নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রধান ইলিয়াস কাঞ্চনডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এরকম কমিটি অতীতে আরো অনেক হয়েছে৷ সেগুলোতেও আমাকে রাখা হয়েছিল৷ আমরা অনেক রকম সুপারিশ দিয়েছি৷ কিন্তু সেবসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি৷ এবারো আমি যেহেতু নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করি তাই আমাকে নিয়ম মেনে সদস্য রাখা হয়েছে৷ আমি আমার সুপারিশ দেব৷ বাস্তবায়ন হবে কিনা জানিনা৷''
শাজাহান খান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তাঁর সমালোচনা কারা করেন? সাধারণ মানুষ৷ তাঁর প্রতি কাদের আস্থা নেই? সাধারণ মানুষের৷ কিন্তু সরকারেরতো আস্থা আছে৷ তাঁকে মন্ত্রী না বানালেও এমপিতো হয়েছেন সরকারি দলের মনোনয়নে৷ আর শেষ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটির প্রধানও করা হয়েছে তাঁকে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘‘আমি যা বলি তা তিনি (শাজাহান খান) শোনেন না৷ আমি যা বলি তিনি তার বিরোধিতা করেন৷ তাই তার বিষয়তো আমার দেখার কিছু নেই৷ যা দেখার জনগণ দেখবে৷''
এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শাজাহান খান শ্রমিকদের নেতা হলেও তিনি পরিবহণ মালিক৷ তাঁর একাধিক পরিবহণ এবং লঞ্চ কোম্পানি আছে৷ এই মালিকরাই সড়কে নৈরাজ্যের জন্য দায়ী৷ তারাই শ্রমিক-চালকদের বেশি ট্রিপ এবং বেপরোয়া ড্রাইভিং-এ বাধ্য করে বেশি মুনাফার লোভে৷ এই ধরণের লোক যদি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কমিটির প্রধান হয় তা দু:খজনক৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কোনো আইন করতে গেলে এই শাজাহান খানরা বাধা দেয়৷ পরিবহণ ধর্মঘট ডেকে দেশের মানুষকে জিম্মি করে৷ গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুলের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর আমরা কেঁদেছি৷ তিনি অট্টহাসি দিয়েছেন৷ তিনি বিদেশের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দিয়ে এটা কিছুইনা বলে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন৷ তাঁর কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি!''
কিন্তু নতুন গঠিত এই কমিটির আরেকজন সদস্য এবং পরিবহণ মালিক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ মনে করেন, শাজাহান খান যেহেতু অনেক দিন ধরে পরিবহন সেক্টরে আছেন তাই তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চাইলে কিছু করতে পারেন৷
খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘কেউ কেউ তাঁর সমালোচনা করেন৷ কিন্তু আমার মনে হয় কোনো অসুবিধা হবেনা৷ মনে করি আরো সুবিধা হবে৷ কারণ তিনি অনেক দিন ধরে মালিক, শ্রমিক সবার সঙ্গে জড়িত৷ তাঁর একটা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে৷ সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ভালো কিছু হবে বলে মনে হয়৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এখানে শাজাহান খান ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের লোকজন আছে৷ পুলিশ কর্মকর্তারাও আছেন কমিটিতে৷ আর এই কমিটিতো সুপারিশ করবে৷ তারাতো বাস্তবায়ন করবেনা৷ তাই আশঙ্কার কিছু নেই৷''
এদিকে শাজাহান খানের সঙ্গে সোমবার বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি৷