শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে বেড়ে চলা যৌন হয়রানির অভিযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ৷ এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে জাতিসংঘ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ বাড়ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক৷''
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নিপীড়নের অভিযোগ উঠলে দ্রুত তদন্ত এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স' দেখানোর কথা বললেও কার্যত স্বাভাবিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও নেয়নি জাতিসংঘ৷ গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের উপসংহারে এমন কথাই বলা হয়েছে৷
এর আগে শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নারী ও শিশু নিপীড়নের অভিযোগ জাতিসংঘকে বিব্রত করলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী করতে পারেনি৷
শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আগেও উঠেছে৷ ২০১৩ সালে ছিল ৬৬টি অভিযোগ, ২০১৪ সালে তা কমে ৫২ হয়েছিল, তবে ২০১৫ সালে অভিযোগের সংখ্যা আবার বেড়েছে৷ মোট ৬৯টি অভিযোগ উঠেছে ২০১৫ সালে৷
২১টি দেশের সেনা এবং পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে উঠেছে যৌন হয়রানির অভিযোগ৷ সবচেয়ে বেশি সাতটি অভিযোগ উঠেছে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মরক্কো আর দক্ষিণ আফ্রিকার শান্তিরক্ষীরা৷ তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে চারটি করে অভিযোগ৷
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন, কঙ্গো, তানজানিয়া, বেনিন, বুরকিনা ফ্রাসো, বুরুন্ডি, গ্যাবন, নাইজার, নাইজেরিয়া আর টোগোর শান্তিরক্ষীরাই বেশি যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িয়েছে৷ রুয়ান্ডা, ঘানা, মাদাগাস্কার আর সেনেগালের পুলিশের বিরুদ্ধেও আছে এমন অভিযোগ৷ এছাড়া ক্যানাডা, জার্মানি, মলদোভা আর স্লোভাকিয়ার গুটিকয় শান্তিরক্ষীও সংকটাপন্ন দেশে শান্তি ফেরানোর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারী ও শিশুদের যৌন লালসার শিকার করেছেন৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
অথচ জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নজরে পড়ার মতো ব্যবস্থা নেয়নি৷ ২০১৫ সালের একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধেও ফৌজদারি মামলা হয়নি৷ শুধু হাইতিতে ক্যানাডার এক পুলিশ কর্মকর্তাকে নয় দিনের জন্য বরখাস্ত করা হয়৷
কঠোর ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য অবশ্য শান্তিরক্ষীদের দেশগুলোকেই দায়ী মনে করে জাতিসংঘ৷ জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, শান্তিমিশনে কর্মরত শান্তিরক্ষীরা কোনো অন্যায় করলে তাদের দেশকেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে৷
২০১৫ সালে ৬৯টি যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রকাশ পেলেও অভিযোগের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি বলেই ধারণা করা হচ্ছে৷ জানা গেছে ৬৯টি যৌন হয়রানির ঘটনার মধ্যে ২২টি ঘটেছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে আর ১৬টি ঘটেছে কঙ্গোতে৷
জাতিসংঘ শান্তি মিশনের শান্তিরক্ষীদের নারী ও শিশু নিপীড়ন সম্পর্কে আরো বিস্তারিত তথ্য শুক্রবারই প্রকাশ করছে জাতিসংঘ৷ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবেন৷