জাতিসংঘকে চিঠি দিয়ে টিগ্রে যোদ্ধারা জানিয়েছে, ইথিওপিয়ার সমস্ত এলাকা থেকে তারা যোদ্ধাদের টিগ্রেতে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
গত ১৩ মাস ধরে ইথিওপিয়ার সরকারের সঙ্গে তীব্র লড়াই হয়েছে টিগ্রে যোদ্ধাদের। ইথিওপিয়ার সেনা টিগ্রে পুনর্দখল করার চেষ্টা করলেও তা টিগ্রে যোদ্ধা বা টিগ্রে পিপলস লিবারেশন ফোর্সের (টিপিএলএফ) হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি। উল্টে টিপিএলএফ ইথিওপিয়ার রাজধানীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। দেশের একাধিক জায়গা তারা দখল করে বসেছিল।
সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত ইথিওপিয়ার আমহারা
আমহারার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, বাস্তুচ্যুতি এবং দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে৷ টিগ্রের বিদ্রোহী যোদ্ধা, ইথিওপিয়ান সরকারি বাহিনী এবং স্থানীয় আমহারা বাহিনী এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
পাহাড়ে লড়াই
ডিসেম্বরের শুরুতে আমহারা অঞ্চলের মেজেজোর আশেপাশের পাহাড়ের যুদ্ধে টিগ্রেয়ান যোদ্ধারা পরাজিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। তারা ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পাঁচ দিন ধরে লড়াই চলে। ব্যাপক যুদ্ধের মধ্যে মানুষজন গোলার শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ঘরের ভিতরেই অবস্থান করছিলেন। এলাকাটিতে রাস্তার পাশে, মাঠে-ঘাটে পচনধরা মরদেহ পড়ে রয়েছে৷
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
মেজেজোতে ধ্বংসযজ্ঞ
নভেম্বরের শেষে আদ্দিস আবাবার উত্তর-পূর্বে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে আয়ু বেরহানের গ্রাম মেজেজো দখল করে টিগ্রেয়ান যোদ্ধারা৷ তখন নয় দিনের জন্য একটি জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। ফিরে আসার পর ৫৫ বছর বয়সি এই নারী দেখেন তার বাড়িটি গোলায় পুরো ধ্বংস হয়েছে। তিনি বলেন, "[বনে] আমরা ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত ছিলাম। সেখানে শিশুও ছিল। আমরা সবকিছু হারিয়েছি৷ যখন আমরা ফিরে আসি, তখন আমাদের থাকার জায়গাও ছিল না৷।’’
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে জীবন
টিগ্রেয়ান যোদ্ধাদের সংগঠন টিপিএলএফ পিছু হঠার আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে কম্বোলচা এবং ডেসির কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকা শহরগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিল। সেই শহরগুলোতে জীবন ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে৷ তবে খাদ্য সামগ্রী, জ্বালানী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ এখনো শুরু হয়নি।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
বিধ্বস্ত হাসপাতাল
হাসপাতালটিতে প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা হতো। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইথিওপিয়ান সেনাবাহিনী এবং টিগ্রেয়ান যোদ্ধারা এটিকে সামরিক হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহার করে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টিগ্রেয়ানরা যাওয়ার আগে লুটপাট চালায়৷ মেলাকু সেটে বলেন, "ওরা যে ওষুধ নেয়নি, সেগুলোকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে গেছে৷ তিনি এখন ডেসি হাসপাতালে ধ্বংসপ্রাপ্ত অক্সিজেন কেন্দ্র চালান৷ অঞ্চলটিতে অক্সিজেনের ঘাটতি রয়েছে।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
ওলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত
ডেসিতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, লুটপাট চালানো হয়েছে৷ ক্যাম্পাসটির পরিচালক মেনাগেশা আয়েলে বলেন, "এটা খুবই দুঃখজনক৷" এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য তিনি টিগ্রেয়ান বাহিনীকে দায়ী করেছেন। "আমি এটা আশা করিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা তাদের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের জন্য অধ্যয়ন করতো।" প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সৈন্যরাই বিভিন্ন সময় ক্যাম্পাসটিকে ব্যবহার করেছে।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
ত্রাণের গুদাম লুট
কম্বোলচায় আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় ত্রাণ সহায়তা সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বেশকিছু গুদামেও ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়েছে। স্থানীয় কর্মকর্তারা এর পেছনে টিগ্রেয়ান যোদ্ধাদের দায়ী করেছেন৷ তবে ত্রাণ কাজে জড়িত সূত্রগুলো জানিয়েছে, স্থানীয় জনগোষ্ঠীই খাদ্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্র লুটে বড় ভূমিকা পালন করেছে। পরে অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীও এই লুটপাটে অংশ নেয়৷
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
টেরাফে গণকবর
টেরাফ গ্রামে এই গণকবরে ২১ জন নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিক এবং চার জন যোদ্ধাকে কবর দেয়া হয়েছে। টেরাফ আমহারা এলাকার বিশেষ অঞ্চল ওরোমোতে অবস্থিত। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ওরোমো এবং টিগ্রেয়ান বিদ্রোহীরা এলাকাটির সংখ্যালঘু আমহারিক-ভাষী জনগণকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। নিহতদের মধ্যে আট ও ১২ বছর বয়সী শিশুও রয়েছে বলে জানা গেছে।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
সেনাদের গুলিতে আহত
১৭ বছর বয়সী আরাবি জানান, এক যোদ্ধা যখন তাদের বাড়িতে ঢুকে তাকে গুলি করে তখন তিনি তার মা এবং ভাইবোনদের সাথে ছিলেন৷ ডয়চে ভেলেকে আরাবি বলেন, "এই ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো৷ এটা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে৷ সেদিনই পাশের বাড়িতে তার চাচাতো ভাইকে (ফোনের ছবিতে) খুন করা হয়। আরবির মা ফাতিমা বলেন, তার সন্তানরা এখনো রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল ডেব্রে বেরহান
আদ্দিস আবাবা থেকে সড়কপথে তিন ঘণ্টার পথ ডেব্রে বেরহান৷ সেখানকার স্কুলগুলো এখন যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা কয়েক লাখ মানুষের আশ্রয়স্থল। আতায়ে থেকে আসা মামিতো বেলাচেউ বলেন, "সেখানে খাবার কিছু নেই। এখানে শিশুরাও আছে... মানুষ সহায়সম্বলহীন হয়ে বাড়ি ছেড়ে এসেছে।" তিনি বলেন, "আমাদেরকে বলা হয়েছে এখন সেখানে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ৷ কিন্তু আমরা ফেরত গেলে কিছুই পাবো না। বাড়িঘরও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।"
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
টহলে স্থানীয় মিলিশিয়া
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক মিলিশিয়ারা এখনও টিগ্রেয়ান যোদ্ধাদের সন্ধানে করছে। এই মিলিশিয়াদের প্রায় সকলেই স্বল্প সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক বা বেসামরিক কর্মচারী। শেওয়া রবিটের একটি মিলিশিয়া গোষ্ঠীতে যোগ দেয়া বাহেরে কেফেলে বলেন, "আমরা পাহাড়টিকে টিপিএলএফ মিলিশিয়াদের খুঁজে বেরতে ব্যবহার করি৷ তাদের খুঁজে পেলে আমরা গ্রেপ্তার করব।"
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
শেওয়া রবিটের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে
ডেসি থেকে আদ্দিস আবাবার মধ্যবর্তী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত শেওয়া রবিট৷ প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দার শহরটি বেশ কয়েক দিন ধরে টিগ্রেয়ান যোদ্ধাদের দখলে ছিল। তারা বেশ কয়েকটি ব্যাংক এবং হোটেল ধ্বংস করে, অর্থনীতিকে খোঁড়া করে দিয়েছে৷ স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন এই শহর ও অঞ্চলটির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।
ছবি: Maria Gerth-Niculescu/DW
11 ছবি1 | 11
সোমবার টিপিএলএফ প্রধান জাতিসংঘকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, টিগ্রে ছাড়া দেশের বাকি সমস্ত অঞ্চল থেকে তারা টিপিএলএফ যোদ্ধাদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এটাই তাদের শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।
বস্তুত, টিপিএলএফ যেভাবে এলাকা দখল করছিল, তাতে আরও ্শান্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সেনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে অস্ত্র হাতে রাস্তায় নামতে বলেছিলেন দেশের প্রধান অ্যাবে আহমেদ। চূড়ান্ত লড়াই শুরু হয়েছিল রাজধানীর খুব কাছে।
জাতিসংঘ, আফ্রিকার দেশগুলি এবং অ্যামেরিকা দ্রুত শান্তি ফেরানোর জন্য দুই পক্ষকেই অনুরোধ করছিল। মুখোমুখি বসে কথা বলে সমস্যা সমাধানের আবেদন করা হচ্ছিল। সেই আহ্বানে প্রথম সাড়া দিল টিপিএলএফ। টিপিএলএফ জানিয়েছে, দুই দিনের মধ্যে সমস্ত যোদ্ধাদের সরিয়ে নেওয়া হবে। বস্তুত, ঘোষণার পর একাধিক জায়গা থেকে যোদ্ধাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
তবে এর পাশাপাশি টিপিএলএফের দাবি, ইথিওপিয়ার সেনাও টিগ্রেতে তাদের উপর আর আঘাত হানবে না। টিগ্রে ঘিরে কার্যত যে অর্থনৈতিক বয়কট তৈরি করেছে, তাও তুলে দিতে হবে।
ইথিওপিয়ার কোনো প্রশাসক বা রাজনীতিক এখনো পর্যন্ত সরকারিভাবে এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। তবে তাদের উপরেও আন্তর্জাতিক চাপ আছে। ফলে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ পথে এগোচ্ছে বলেই মনে করছেন সকলে।