তুরস্কের কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো এক আবেদনে স্বাক্ষর করে শিক্ষাবিদরা চাকরি হারিয়েছেন৷ মামলাও হয়েছে৷ সন্ত্রাসের পক্ষে প্রচার চালানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে৷
বিজ্ঞাপন
এ অভিযোগ তোলা হয়েছে ১৫০ জন শিক্ষাবিদের বিরুদ্ধে৷ বামপন্থিদের ‘ইয়েনিয়ল' জার্নালের সম্পাদক উরাজ আয়দিন-ও তাঁদের একজন৷ কয়েক দিন আগে ইস্তাম্বুলের এক ক্যাফেতে ডয়চে ভেলের প্রতিবেদকের কথা হয় ৪১ বছর বয়সি উরাজের সঙ্গে৷ উরাজ জানান, প্রায় এক বছর আগে তুরস্কের কুর্দি অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানানোর পর থেকে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাঁর ওপর দিয়ে৷ জানালেন, মার্মারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অনুষদে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি, কিন্তু ওই আবেদনে স্বাক্ষর করার কারণে চাকরিটা হারিয়েছেন৷
বামপন্থি ভাবাদর্শের হওয়ায় এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পদোন্নতি হয়নি৷ গত বছর প্রভাষক পদে নিয়োগ প্রাপ্তির আশায় আবেদন করেছিলেন উরাজ৷ কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিল, চাকরিটা হবে৷ কিন্তু পরের দিনই কুর্দি অঞ্চলে শান্তির দাবিতে স্বাক্ষরকারীদের নামের তালিকা পাঠানো হয় কর্তৃপক্ষের কাছে৷ মার্মারা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে সেই সেখানেই রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে যোগদান করা উরাজ জানালেন, তালিকা পাঠানোর খবর শুনেই বুঝতে পেরেছিলেন বড় রকমের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে৷
তুরস্কের শিল্পীদের আঁকা ব্যঙ্গচিত্র
যে দেশে সংবাদপত্রের স্বধীনতার মুখ চেপে ধরা হয়েছে, সে দেশে কার্টুনিস্টরা কতদূর যেতে সাহস করেন? জার্মানির কাসেল শহরের কারিকাটুরা গ্যালারিতে তুর্কি ব্যঙ্গচিত্রের কিছু নমুনা প্রদর্শিত হচ্ছে৷
ছবি: Caricatura/Ramize Erer
‘আমি কোথায়?’ ভাবছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল
২০১৫ সালে তুরস্কের ‘লেমান’ ব্যঙ্গপত্রিকার প্রচ্ছদে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে দেখানো হয় ‘সুলতান’ এর্দোয়ানের পাশে বসা অবস্থায়৷ ‘এ আমি কোথায় এসে পড়লাম?’ ভাবছেন ম্যার্কেল; তাঁর পরনেও মধ্যযুগীয় অভিজাত জার্মান মহিলাদের বাস৷ ইস্তানবুলের তিনটি নেতৃস্থানীয় ব্যঙ্গপত্রিকার মধ্যে ‘লেমান’ অন্যতম৷ তুর্কি প্রধানমন্ত্রী দাভুতোগলু একবার পত্রিকাটিকে ‘‘নীতিবিগর্হিত’’ বলে অভিহিত করেছিলেন৷
ছবি: LeMan/Caricatura
বুদ্ধিমানেরা সবাই জেলে
২০১৬ সালের জুলাই মাসের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে দেড় লাখ মানুষকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে ও ৪০ হাজার মানুষকে জেলে পোরা হয়েছে – তাদের মধ্যে বহু সাংবাদিক, লেখক ও আন্দোলনকারী৷ ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে আঁকা এই কার্টুনটিতে ৬৬ বছর বয়সি কার্টুনিস্ট ইজেল রোজেনটাল দেখাচ্ছেন, বন্দিরা কীভাবে একটি অশোভন মুদ্রা প্রদর্শন করছে আর প্রহরীরা বলছে, তারা এই ‘বেজন্মা’ বুদ্ধিজীবীদের কি পরিমাণ ঘৃণা করে৷
ছবি: Rozental/Caricatura
গুলেন সর্বত্র
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনরত ফেতুল্লাহ গুলেন ও তাঁর সমর্থকরা জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী, বলে এর্দোয়ানের অভিযোগ এবং বহু তুর্কি নাগরিক সত্যিই তা বিশ্বাস করেন৷ কার্টুনিস্ট ইগিট ওয়েজগুর-র ব্যঙ্গচিত্রে এক তুর্কি বলছেন: ‘‘৯০ শতাংশ তরমুজ নাকি গুলেনের শিষ্য৷’’ সঙ্গের তুর্কিটি বলছেন: ‘‘হতেই পারে৷’’
ছবি: Özgür/Caricatura
এর্দোয়ানের বিপক্ষে গেলেই বিপদ
গত এপ্রিল মাসের গণভোটে ৫১ দশমিক তিন শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোটে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ও প্রেসিডেন্টের প্রভূত ক্ষমতা বাড়ে৷ ভোটের আগে মিডিয়াকে বিরোধীদের হয়ে ‘হায়ির’ বা ‘না’ ভোটের সপক্ষে আন্দোলনের খবর খোলাখুলিভাবে প্রচার করতে দেওয়া হয়নি৷ তাই মার্চ মাসে ইপেক ওয়েজসুসলু এই কার্টুনটি আঁকেন: জলের মিস্ত্রির পশ্চাদ্দেশে ‘হায়ির’ উল্কিটা বেরিয়ে পড়েছে৷
ছবি: Özsüslu/Caricatura
ট্রাম্পও বাদ যাননি
এর্দোয়ানই তুর্কি ব্যঙ্গচিত্রশিল্পীদের একমাত্র লক্ষ্য নন৷ বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্র যাত্রার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কার্টুনিস্টদের বিরাগভাজন হয়েছেন৷ ছবির কার্টুনটিতে বন্দুকধারী মার্কিন সৈন্যের পিছনে একটি ছেলে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘ওদের আমরা শেষমেষ কবে তাড়াব, বাবা?’ বাবা বলছেন, ‘আমাদের তেল ফুরোলে৷’
ছবি: Karabulat/Caricatura
সেক্স যেখানে টাবু
তুরস্কে যৌনতা নিয়ে প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনা চলে না – বিশেষ করে মহিলাদের যৌনতা নিয়ে তো নয়ই৷ মহিলা কার্টুনিস্ট রামিজে এরার-এর মোটাসোটা ‘ব্যাড গার্ল’ রক্ষণশীল সমাজের ধার ধারে না৷ ছবিতে সেই ব্যাড গার্ল পরপুরুষের সঙ্গে রাত কাটানোর পর সেল্ফি তুলছে; প্রেমিক বেচারা ভয়ে জড়োসড়ো: তার গিন্নি যদি ঐ ছবি ফেসবুকে দেখে ফেলেন?
ছবি: Caricatura/Ramize Erer
দুনিয়াদারি
কার্টুনিস্ট মেহমেত চাগচাগ-এর দৃষ্টিতে দুনিয়ার অবস্থা আজ একটি ছবি দিয়েই বোঝানো যায়: বাগদাদ থেকে এথেন্স, বার্লিন থেকে প্যারিস অবধি এক পর্যায় ঘড়ি, আবহাওয়া অফিসে, পত্রিকার নিউজরুমে, হোটেল অথবা এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে যেরকম থাকে – প্রতিটি ঘড়ি আসলে একটি টাইম বোমা, প্রত্যেকটির পিছনে ডায়নামাইট বাঁধা রয়েছে৷ শুধু কোনটা যে কখন ফাটবে, সেটা জানা নেই৷
ছবি: Cagcag/Caricatura
7 ছবি1 | 7
অনুমান মিথ্যে হয়নি৷ কয়েকদিনের মধ্যে চাকরিচ্যুত করা হয় তাঁকে৷ গত ফেব্রুয়ারিতে ওই চাকরিচ্যুতিকে সমর্থন করে এমন আইনও পাশ করা হয়৷ ফলে চাকরিতে ফেরার পথ মোটামুটি বন্ধ৷
চাকরিচ্যুত করার পরই সন্ত্রাসের পক্ষে প্রচার চালানোর পক্ষে মামলা করা হয় উরাজ আয়দিনসহ ১৫০ জন শিক্ষাবিদের বিরুদ্ধে৷ কুর্দিস্তান কমিউনিটিজ ইউনিয়ন (কেসিকে)-র কো-চেয়ারম্যান বেজে হোজাতের ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের এক বিবৃতিকে প্রমাণ হিসেবে উত্থাপন করে সরকার পক্ষের কৌঁসুলিরা দাবি করেন, কুর্দিস্তানে শান্তি স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে শিক্ষাবিদরা আসলে সন্ত্রাসের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন৷ অভিযুক্তরা এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে উরাজ আয়দিন বললেন, ‘‘আমি এবং আমার বন্ধুরা নিজেদের প্রশ্ন করেছি – আমাদের ওই স্বাক্ষরগুলোর জন্যই কি দেশের আজ এই অবস্থা?''
এসিবি/এপিবি (ডয়চে ভেলে)
রাষ্ট্র না হয়েও বিচ্ছিন্ন
ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলের ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোটার এক গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দিয়েছেন৷ অনেক বছর ধরেই অবশ্য এই অঞ্চল কার্যত স্বাধীনতা ভোগ করছে৷ গোটা অঞ্চলে এমন আরও কয়েকটি দৃষ্টান্তের দিকে নজর দেওয়া যাক৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/B. Feher
ইরাকি কুর্দিস্তান
১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ ও ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন হামলার ফলে বিপর্যস্ত সাদ্দাম হুসেনের প্রশাসন উত্তরে কুর্দি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ ধাপে ধাপে হারিয়ে ফেলে৷ কুর্দিরাও সেই সুযোগে নিজস্ব পতাকা, সরকার, সংসদ ও সেনাবাহিনী গড়ে তুলে এক রাষ্ট্রীয় কাঠামো সৃষ্টি করে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/B. Feher
দক্ষিণ সুদান
২০১১ সালের জুলাই মাসে বিশ্বের সবচেয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার আগে দক্ষিণ সুদানও বেশ কিছুকাল কার্যত স্বাধীনতা ভোগ করেছে৷ ২০০৫ সালের এক শান্তি চুক্তির আওতায় এক গণভোটে দক্ষিণের মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেন৷ ১৯৮৩ সালের গৃহযুদ্ধের সময়েই বিচ্ছিন্নতাবাদের এই বীজ বপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Messara
লিবিয়ার পূ্র্বাঞ্চল
২০১১ সালে মুয়াম্মার আল গদ্দাফির পতনের পরেই লিবিয়ায় অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে৷ ত্রিপোলি শহরে যে প্রশাসন গঠিত হয়, তার আনুগত্য মানতে নারাজ ছিল দেশের পূ্র্বাঞ্চলের উপজাতীয় নেতারা৷ মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের মদতে তোবরুক শহরে এক সমান্তরাল প্রশাসন উগ্র ইসলামপন্থিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে৷
ছবি: dapd
উত্তর ইয়েমেন
২০১৪ সালে সর্বশেষ গৃহযুদ্ধের ফলে আবারও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে গরিব দেশ ইয়েমেন৷ ইরানের মদতে রাজধানী সানা ও দেশের উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে শিয়া সম্প্রদায়ের বিদ্রোহীদের হাতে৷ ইয়েমেনের সরকারের অস্তিত্ব শুধু দেশের দক্ষিণাচলেই সীমিত রয়েছে৷ উল্লেখ্য, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ইয়েমেন স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল
দীর্ঘ ও জটিল গৃহযুদ্ধের জের ধরে সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দি সম্প্রদায় কার্যত এক স্বাধীন ছিটমহল গড়ে তুলেছে৷ পিওয়াইডি নামের সিরীয় কুর্দি গোষ্ঠী সেই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে৷ ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধের সময় থেকেই বাশার আল আসাদ প্রশাসনের সঙ্গে তাদের একটা বোঝাপড়া রয়েছে৷ মার্কিন বিমান হামলার সুযোগ নিয়ে পিওয়াইডি-র সামরিক বাহিনী ওয়াইপিজি আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে৷