নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় একের পর এক ‘সাপ’ বেড়িয়ে আসছে৷ এবার দৃশ্যপটে এসেছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান৷ অভিযোগ উঠেছে, তিনি হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নূর হোসেনকে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত জনকে অপহরণ এবং হত্যার ঘটনায় ব়্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতারের পর এখন দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে৷ তবে তদন্তকারীরা বলছেন, প্রধান আসামি নূর হোসেনকে গ্রেফতার করতে না পারায় অনেক তথ্যেরই সত্যতা যাচাই করা যাচ্ছে না৷ আর এটা এখন স্পষ্ট হয়ে গেছে যে নূর হোসেন দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
আগে অবশ্য অভিযোগ উঠেছিল, ঘটনা ধামাচাপ দিতে ব়্যাব সদস্যরাই নূর হোসেনকে দেশের বাইরে পালাতে সহায়তা করেছে৷ তবে এবার অভিযোগ উঠেছে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে শাসক দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে৷ অপহরণ এবং হত্যাকাণ্ডের পর শামীম ওসমানের সঙ্গে নূর হোসেনের ফোনালাপ সংবাদ মাধ্যমেও প্রকাশ হয়েছে৷ শামীম ওসমান ফোনালাপের বিষয়টি স্বীকার করে দাবি করেছেন, তাঁর ফোনালাপের খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করা হয়েছে৷ তিনি নূর হোসেনকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়েছিলেন৷
এদিকে নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শামীম ওসমানকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন আছে৷ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নূর হোসেনেরে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে৷''
তবে তিনি দাবি করেন, ‘‘নূর হোসেনকে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে ব়্যাবই সহায়তা করেছে৷ তাকে ব়্যাবের নামে এখনো হুমকি দেয়া হচ্ছে৷''
তিনি প্রশ্ন করেন, ‘‘সরকারের কোন গোয়েন্দা সংস্থা ফোনালাপ রেকর্ড করেছে৷ আর তখন তারা নূর হোসেনের অবস্থান জানতেন৷ তাহলে তখন তাকে কেন গ্রেফতার করা হয়নি?''
শহিদুল বলেন, ‘‘আমি এখনই শামীম ওসমানের গ্রেফতার দাবি করছি না৷ তবে জিজ্ঞাসাবাদে তাঁর সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হলে তাকেও আইনের আওতায় আনা হোক৷''
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘নূর হোসেন যদি দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে অবৈধভাবে গিয়েছে৷ আমরা নিশ্চিত যে সে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দেশের বাইরে যায়নি৷''
শামীম ওসমানকে গ্রেফতার বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কী না - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তদন্তের প্রয়োজনে যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷ কারো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতারের বাইরে রাখা হবে না৷''
এদিকে নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাস বিরোধী ‘ত্বকী মঞ্চ' এক বিবৃতিতে শামীম ওসমানকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে৷ মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি এবং সদস্য সচিব হালিম আজাদ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘সংবাদ মাধ্যমে শামীম ওসমান এবং নূর হোসেনের ফোনালাপ প্রকাশ হওয়ার পর এটা স্পষ্ট যে নারায়ণগঞ্জের সাতজনকে অপহরণ এবং হত্যার ঘটনায় শামীম ওসমানের হাত আছে৷ তাঁকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে মূল ঘটনা জানা যাবে৷''
তারা বলেন, ‘‘সাতখুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন শামীম ওসমানেরই সৃষ্টি৷ অথচ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তাঁর ব্যাপারে নিরব আছে যা দুঃখজনক৷''