শিশুরাই দেশ, সমাজ, জাতির ভবিষ্যত, ভবিষ্যতের কর্ণধার৷ বাবা-মার কাছে সন্তানের চেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারে না৷ তাদের ঘিরেই তো সমস্ত পরিকল্পনা, সব স্বপ্ন৷ কিন্তু সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা যে চাট্টিখানি কথা নয়!
বিজ্ঞাপন
এই ‘মানুষ' করতে গিয়েই সমস্যার শুরু৷ শুরু বকাবকির, শুরু চর-থাপ্পর, খুন্তির খোঁচা, স্কেলের বাড়ি – এমন হাজারো রকম শাস্তির৷ আমাদের সমাজে হাজারো কাজের চাপ, টাকা-পয়সার টানাটানি, আবার অনেক সময় নেহায়েত অভ্যাসের বশেও বাবা-মা ছেলে-মেয়ের ওপর এমন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন৷ আমি, আপনি বা আমাদের চেনাশোনা অনেকের জীবনেই এমন ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে এখনো৷
প্রশ্ন হলো, এমন শাস্তি কি সত্যিই কাজে দেয়? বাচ্চাকে গায়ের জোরে কি সত্যিই কিছু শেখানো যায়? জোর করে খাওয়ানো, পড়তে বসানো, খেলতে বারণ করা – এ সব আদতে কোনো কাজে আসে কিনা, সে কথা কখনও ভেবে দেখেছেন? আমার তো মনে হয়, এতে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে, বাড়ে উভয়পক্ষের মানসিক যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব, এমনকি অনেক সময় বিপথগামীও হয়ে যায় ছেলে বা মেয়েটি৷
শিশুকে মারলে সে অংকে খারাপ করে
ইউনিসেফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে শিশুকে মারধর করলে কিংবা তাকে মানসিকভাবে শাস্তি দিলে পরবর্তীতে সেটা তার লেখাপড়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷
ছবি: picture alliance/dpa
শারীরিক শাস্তি
ইউনিসেফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২ থেকে ১৪ বছর বয়সি প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ছয়জনকে নিয়মিতভাবে শারীরিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়৷ শিশুদের যাঁরা দেখাশোনা করেন তাঁরাই এই শাস্তি দিয়ে থাকেন৷ শারীরিক শাস্তি বলতে ইউনিসেফ বুঝিয়েছে এমন শাস্তি যেটা দিলে শিশু শরীরে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি অনুভব করে৷ এমন শাস্তির মধ্যে রয়েছে শিশুর হাত, পা, মুখ, মাথা, কান কিংবা নিতম্ব ধরে ঝাঁকানো বা মার দেয়া৷
ছবি: Fotolia/Firma V
মানসিক শাস্তি
কোনো অপরাধের প্রেক্ষিতে শিশুর সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলা, তার কাছ থেকে কোনো সুযোগ কেড়ে নেয়া যেন শিশুটি মানসিকভাবে কষ্ট পায় ইত্যাদিকে মানসিক শাস্তি হিসেবে মনে করে ইউনিসেফ৷ তাদের গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ শিশুকে বোঝানো হয়েছে যে, তারা (শিশু) যেটা করেছে সেটা ঠিক নয়৷ ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে চিৎকার করে সেটা করা হয়েছে৷ এছাড়া ৪৮ শতাংশের ক্ষেত্রে শিশুদের কিছু সুবিধা কেড়ে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
সবচেয়ে বেশি ইয়েমেনে
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে অভাগা বলতে হবে এই দেশের শিশুদের৷ কেননা সেখাকার প্রায় ৯৫ জন শিশুকেই তাদের অপরাধের জন্য শারীরিক ও মানসিক শাস্তি পেতে হয়৷ অভাগাদের তালিকায় এরপর ক্রমান্বয়ে আছে ঘানা, টিউনিশিয়া, টোগো, ক্যামেরুন ও ফিলিস্তিনের শিশুরা৷ এই গবেষণা সম্পর্কে আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাংলাদেশ বিষয়ক তথ্য
ইউনিসেফ-এর সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশকে মারধর করেন মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা৷ আর ৭৪.৪ শতাংশ শিশুকে মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো হয়৷ শৃঙ্খলা বলতে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগী করাসহ অভিভাবকদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজকে বোঝানো হয়েছে৷ এছাড়া প্রতি তিনজন মায়ের মধ্যে একজন বিশ্বাস করেন, নিয়মকানুন শেখাতে সন্তানদের শাস্তি দেয়া প্রয়োজন৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
অংক স্কোর কম করে!
শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রভাব নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেছে ইউনিসেফ৷ তাতে দেখা গেছে, ৮ বছর বয়সে যেসব শিশু এ ধরণের শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে তারা ১২ বছর বয়সে গিয়ে স্কুলে অংকে খারাপ স্কোর করেছে৷ শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাদের অনীহা দেখা গেছে৷ শিশুকে শাস্তি দেয়ার এটি একটি নেতিবাচক প্রভাব বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture alliance/dpa
ইউনিসেফ-এর উদ্যোগ
শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করতে জাতিসংঘের এই সংস্থাটির ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অফ দ্য চাইল্ড’ রয়েছে৷ এখন পর্যন্ত ১৪০টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে৷ তবে এর মাধ্যমে বিশ্বের মাত্র ৮ শতাংশ শিশুকে শারীরিক শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করা গেছে বলে জানিয়েছেন ইউনিসেফ এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেল রুটস্টাইন৷ ১৯৮৯ সালে গৃহীত এই কনভেনশনে ১৯৯০ সালে সই করে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
6 ছবি1 | 6
বাচ্চাদের যত্ন প্রয়োজন৷ তাদের আদর করে, নিয়ম করে হাঁটতে-দৌড়াতে-খেতে-পড়াশোনা করতে শেখাতে হয়৷ বন্ধুর মতো কাছে বসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো তুলে ধরতে হয় সামনে৷ আসলে প্রকৃত শিক্ষা বলতে যা বোঝায় সেটা তো শুধু স্কুল-কলেজের লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ চারিত্রিক ও আত্মিক উন্নয়নের বিষয়গুলোও যে এ শিক্ষার সঙ্গে জড়িত! আর সেই শিক্ষা বোধ হয় শুরু হয় জন্মের পরপরই৷
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন – সকলকেই প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চার সঙ্গে, এমনকি শিশুর বয়স তিন-চার-পাঁচ-ছায়-সাত বছর পর্যন্তও, ‘ওলে বাবালে', ‘আমার সোনটা মনা' – এ সব আদুরে অর্থহীন ভাষায় কথা বলতে৷ এভাবে কথা বলা মানেই কি ভালোবাসা প্রকাশ? না, কক্ষনো না৷ আমার তো মনে হয়, এতে শিশুরা ঠিকমতো কথা বলতে শেখে না, শেখে না নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে৷
আবার দু-তিন বছরের বহু শিশুকেই দেখা যায় খেলনা, জিনিসপত্র নষ্ট করতে, যা খাচ্ছে তার অর্ধেক ফেলে দিতে, খাওয়ার বা অন্য কোনো কাজের সময় অহেতুক লাফালাফি করতে৷ আচ্ছা, এর জন্যও আমরা, মানে অভিভাবকরাই কি দায়ী নই? আমরা কি বলি না – ‘ও তো বাচ্চা, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে' অথবা ‘আমার ছেলে/মেয়েটি ভীষণ দুরন্ত, কী করি বলুন তো?' আর তারপর বাচ্চা আরো একটু বড় হয়ে যখন ঐ একই কাজ করে, আমরা কি তখন তার পিঠে এক ঘা অথবা কান ম'লে দেই না?
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
নিজেকে একবার জিজ্ঞাসা করুন তো...৷ আপনি কি আপনার সন্তানকে নিয়ম করে একটি জায়গায় বসিয়ে খাইয়েছেন? হাতে মোবাইল ফোন, আইপ্যাড অথবা টেলিভিশন ছেড়ে নয়, বসিয়ে প্রতিদিন গল্পের বই পড়ে শুনিয়েছেন? আপনি নিজে কি সময়মতো খান? বই পড়েন? বা সব জিনিস গুছিয়ে রাখেন? ভুলেও আপনি কখনও তাদের সামনেই ঝগড়াঝাটি করেন না তো? দেন না তো গালাগাল?
বাচ্চারা কিন্তু ছ'মাস বয়স থেকেই শিখতে শুরু করে৷ তখন থেকেই তারা যেমন আদর বোঝে, বোঝে ধমকও৷ বয়স দুই পেরোতে না পেরোতেই বাচ্চাদের নিয়ম-শৃঙ্খলা, সৌন্দর্যবোধ, গুছিয়ে রাখা, নষ্ট না করা, কোনটা করা উচিত এবং উচিত নয় – সেসব বোঝার ক্ষমতা আসে৷ এরপর ছয় বছরের মধ্যে তাদের মস্কিষ্ক পূর্ণতা পায়৷ এই বয়সের মধ্যে সে যা কিছু দেখে, শোনে এবং বোঝে, পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে৷ স্বার্থপরতা অথবা উদারতা, মায়া-মমতা – এগুলো কিন্তু সে আমাদের দেখেই শেখে, অথবা শেখে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছ থেকে৷
ধরুন, আপনার বাচ্চাটা প্রতিদিন টিফিন ফেরত আনে৷ আপনি তখন তাকে যদি বলেন, ‘তুমি টিফিন খাও না কেন? তোমার বন্ধুরা খায় কেন? তুমি বোকা, না গাধা? আজ থেকে তোমার টিফিন বন্ধুরা যেন না খায়৷' এমনটা বলে তাকে কি আপনি আত্মকেন্দ্রিকতাই শেখালেন না? কেন বললেন না মিলেমিশে খাওয়ার কথা? আবার আপনার বাচ্চাটি খারাপ রেজাল্ট করার পর তাকে আপনি হয়ত বললেন, ‘তোমার খালাতো ভাই কত বুদ্ধিমান! খেলাধুলাতেও ভালো৷' অথবা ‘রানা কত ভালো রেজাল্ট করেছে দেখেছো? তুমি তো কিছুই পারো না৷' আচ্ছা, এতে করে আপনি আপনার সন্তানটিকে উৎসাহিত না নিরুৎসাহিত করলেন?
এখানেই শেষ না৷ ঘরে যদি ছেলে থাকে, মেয়েও থাকে, তাহলে অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় বাবা-মা ছেলেটিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে৷ তার পাতে বড় মাছটা, দুধের গ্লাসটা তুলে দিচ্ছি৷ ছেলেটিকে খেলতে পাঠাচ্ছি আনায়াসে, অথচ মেয়েটিকে, সে যদি ছেলেটির চেয়ে বয়সে ছোটও হয়, তাকে বলছি ঘরের কাজে হাত লাগাতে৷ কেন? এটা কি বৈষম্য নয়? এতে করে আপনার ছেলেটি কি কোনোদিন মেয়েদের সম্মান দিতে শিখবে? বড় হয়ে ওরাই কি মেয়েদের উত্যক্ত করবে না, বলুন?
অথচ আমি, আপনারা, আমরা যদি ছোট থেকে ছেলে-মেয়েকে এক চোখে দেখতাম, যদি সান্নিধ্য, সাহচর্য দিয়ে, তাদের সাথে প্রাণখুলে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতাম, গল্প করতাম, বয়ঃসন্ধিতে বন্ধু হতাম – তাহলে হয়ত তাদের প্রতি আমাদের কঠোর হতে হতো না৷ প্রয়োজন হতো না গায়ে হাত তোলার, বকাঝকা করার৷ আর আমাদের কারো কারো সন্তানও হয়ে উঠতো না নিষ্ঠুর, সহিংস এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতিভূ৷
আপনারা কি দেবারতি গুহর সঙ্গে একমত? না হলে, জানান আপনার নিজস্ব মতটি৷ লিখুন নীচের ঘরে৷
পারিবারিক সম্পর্ক সুন্দর রাখার ১০ উপায়
পেশাগত কাজের চাপই যে স্ট্রেসের প্রধান কারণ তা নয়৷ এই বিশ্বায়নের যুগে স্বামী-স্ত্রীর চাকরি, সন্তানদের যোগ্য মানুষ হওয়া নিয়ে নানা মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও সবার মাঝে মধুর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কিছু টিপস থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images
ঝগড়া এড়িয়ে শান্ত থাকুন
প্রায়ই কথায় কথায় এর সাথে ওর লেগে যায়, অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর কলহ বা সন্তানদের নিয়ে অথবা সন্তানদের মধ্যে৷ তা হতে পারে পেশাগত চাপ বা নিজেদের লাইফস্টাইল নিয়ে৷ কিংবা সংসারের নানা কাজ৷ তাই কিছুটা সচেতন হয়ে কথা বলুন, একজন উত্তেজিত হলে অন্যজন শান্ত থাকুন৷ সরাসরি বলতে গেলে, ঝগড়া এড়িয়ে চলুন৷
ছবি: drubig-photo - Fotolia
কাজের স্বীকৃতি দিন
দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজ থাকে, যা একজন হয়তো নিয়মিত করে চলেছে৷ কিন্তু সেকথা কখনো বলা হয়না বা স্বীকৃতি দেওয়া হয়না৷ যে যেটা নিয়মিত করছে তাকে মাঝে মধ্যে মুখে বলুন বা স্বীকৃতি দিন, কাজের সম্মান দেখান৷ স্বীকৃতি পেলে কে খুশি না হয়! তাছাড়া সংসারে সবাই সমান পারদর্শী নয়, তাই বলে কাউকে অবহেলা একেবারেই নয় !
ছবি: imago/imagebroker
কাজ ভাগাভাগি করে নিন
সংসারের প্রয়োজনীয় কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিন৷ কারো পেশাগত চাপ বা পড়াশোনার চাপ থাকলে সে সময়ে অন্য আরেকজন সে কাজটি করে ফেলুন৷ তবে এ নিয়ে অবশ্যই কথা বলুন রাতে খাবার টেবিলে অথবা সপ্তাহান্তে৷ সকালে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হবার আগে কখনো সিরিয়াস আলাপ নয় !
ছবি: DW/L.Heller
ব্যক্তিগত ইচ্ছে বা সখের মূল্য দিন
পরিবারের সদস্যদের সখ বা ইচ্ছের মূল্য দিন৷ অবসর সময়ে কে কী করতে চায় অর্থাৎ গান, বাজনা, বই পড়া, ছবি আঁকা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা বা অন্য যা কিছুই হোক না কেন, এতে আগ্রহ দেখান৷ একজনের যা ভালো লাগে, অন্যের তা পছন্দ নাও হতে পারে৷ তাই বলে অসম্মান নয়৷ তবে প্রয়োজনে ভালো-মন্দ বুঝিয়ে বলা যেতে পারে৷ সবাই মিলে আলোচনা করে একে অপরের আগ্রহের কথা জানতে পারলে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব৷
ছবি: Fotolia/ Gennadiy Poznyakov
স্বামী-স্ত্রীর কলহ
আধুনিক যুগের চাকরিজীবী স্বামী-স্ত্রীর কলহের ধরনও পালটে গেছে৷ তবে সন্তানদের সামনে মা-বাবা ঝগড়া করলে তা সন্তানদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে৷ তাই মা-বাবাকে দু’জনের ভেতরের কলহ নিজেদের ঘরেই মিটিয়ে ফেলতে হবে৷ সন্তানদের সামনে ঝগড়া নয়, বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের সামনে ঝগড়া হলে শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা পরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে৷
ছবি: goodluz - Fotolia
পারিবারিক দ্বন্দ্ব
পারিবারিক দ্বন্দ্ব নেই – এমন পরিবার বোধহয় কমই আছে৷ নানা জনের নান মত থাকবেই৷ তাই মনের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব বা ভিন্ন মত হলে তা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে কষ্ট না পেয়ে খোলাখুলি স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন বা সকলে মিলে কথা বলুন৷ পারিবারিক দ্বন্দ্ব এড়াতে সবসময় সরাসরি আলোচনা করুন, কারণ এর কোনো বিকল্প নেই৷
ছবি: Fotolia/drubig-photo
জন্মদিন বা কোন উপলক্ষ্য
জন্মদিন পালন করা পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি হলেও আজকাল তা আমাদের দেশেও চলে এসেছে৷ জন্মদিন উদযাপন মানেই বিশাল আকারে পার্টি করা নয়৷ ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা সবার জন্মদিনকে বিশেষভাবে, অর্থাৎ যার জন্মদিন তাকে পছন্দের ছোট কিছু দিয়ে সবাই মিলে পরিবারের মধ্যেই দিনটি উদযাপন করতে পারেন৷ পরিবারে যার জন্মদিন, তাকে বছরের এই দিনটিতে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়া যে, পরিবারে তার মূল্য কারো চেয়ে কম নয়৷
ছবি: pressmaster - Fotolia.com
অসুখ-বিসুখে বাড়তি যত্ন
অসুখ-বিসুখে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের প্রতি বিশেষ যত্ন নিন, বুঝিয়ে দিন অন্যদের সমবেদনার কথা৷ কিনে আনুন ফুল অথবা রোগীর পছন্দের মজার কোনো বই, যা রোগীকে আনন্দ দিতে পারে৷ কোনোভাবেই অবহেলা নয়, প্রয়োজনে নিজের কোনো কাজ ফেলে রেখে রোগীর দৃষ্টি আকর্ষণ করুন৷
ছবি: picture alliance/ZB
সপ্তাহান্ত বা ছুটির দিন
পরিবারের সবার কাছেই যেন মনে হয় দিনটি পরিবারের জন্য৷ একসাথে একটু বেশি সময় নিয়ে সকালের নাস্তা করুন৷ কারো অন্য কোন কাজ বা অন্যকিছু থাকলে সবাইকে জানিয়ে দিন, হঠাৎ করে বলবেন না ‘আমি বাইরে যাচ্ছি’৷ যার যে কাজই থাকুক না কেন, সবার যেন এই অনুভূতি হয় যে ‘আমরা সকলে সকলের’৷ বাইরে থেকে ফিরতে দেরি হলে অবশ্যই বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিন৷
ছবি: Fotolia/stefanfister
হলিডে বা ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা
এ বছর কখন কোথায় বেড়াতে যাবেন কিংবা কোথাও যাওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে সবাই মিলে আলোচনা করুন৷ পরিবারের প্রতিটি সদস্যেরই মতামতের মূল্য রয়েছে – তা সবাইকে জানিয়ে দেয়া৷ হোক সে ছোট বা বড়৷ ছুটিতে গিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত চাপ ঝেড়ে আসুন, আনন্দ করুন, নতুন উদ্যম নিয়ে ফিরে আসুন৷ ভাবুন জীবন অনেক সুন্দর!