শিক্ষক নিয়োগে খুলছে না জট
১৫ জুলাই ২০২৫
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী। এদের মধ্যে যারা দাগি হিসেবে চিহ্নিত নন, তাদের চাকরি ডিসেম্বর পর্যন্ত টিকে গিয়েছে। কিন্তু তারপরে চাকরিতে বহাল থাকতে গেলে নতুনভাবে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। এ নিয়েই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন যোগ্য শিক্ষিকারা-শিক্ষিকারা।
শিক্ষকদের আন্দোলন
সোমবার নবান্ন অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তাদের মিছিল আটকাতে হাওড়া শহর থেকে নবান্নের দিকে যাওয়া সব রাস্তায় লোহার ব্যারিকেড করা হয়েছিল। সেখানে এসে মিছিল আটকে যায়।
তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয় হাওড়া ময়দানে মল্লিক ফটকের কাছে। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় আন্দোলনকারীদের। সেখানেই বসে পড়েন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা
এখান থেকে আন্দোলনকারীদের ১৮ জনের একটি প্রতিনিধি দল শিবপুর পুলিশ লাইনে যায়। সেখানে মুখ্যসচিব মনোজ পন্থের সঙ্গে তাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। মূলত সাতটি দাবিকে সামনে রেখেছেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারীদের তিনটি দাবি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সার্টিফায়েড তালিকা স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েবসাইটে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে ২২ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ওএমআর শিট আপলোড করতে হবে এবং যে কোনো মূল্যে রিভিউয়ের মাধ্যমে যোগ্যদের চাকরিতে পুনর্বহাল করতে হবে রাজ্য সরকারকে।
আলোচনা বিফলে
এই দাবিগুলি সামনে রেখে মুখ্যসচিবের সঙ্গে আলোচনা করেন আন্দোলনকারীরা। নবান্নের বদলে প্রশাসনের শীর্ষকর্তা পুলিশ লাইনে আসেন কথা বলার জন্য। কিন্তু সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। বৈঠক শেষে আন্দোলনকারীরা দাবি করেছেন, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
তালিকা প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত সোমবার রাতভর অবস্থানের কথা ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নেন, তারা আপাতত অবস্থান তুলে নেবেন। ভবিষ্যতে তারা কালীঘাট অভিযান করবেন। কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
হাইকোর্টে শুনানি
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে নতুনভাবে পরীক্ষা নিয়ে স্কুলে নিয়োগ করতে হবে রাজ্য সরকারকে। এই প্রক্রিয়ায় দাগি বলে যারা চিহ্নিত নন, তারা শুধু পরীক্ষায় বসতে পারবেন। চাকরিহারা সকলেই যাতে পরীক্ষায় বসার সুযোগ পান, সেজন্য রাজ্য হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছিল। এই আরজি খারিজ হয়ে গিয়েছে আগেই। রাজ্যের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে আরো কিছু প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট।
কোন সালের বিধি অনুযায়ী নয়া নিয়োগ করা হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। মামলাকারীদের দাবি, ২০১৬ সালের বিধি না মেনে চলতি বছরের নয়া বিধি অনুসারে রাজ্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে চলতি বছরের মোট শূন্যপদকে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
যদিও রাজ্যের বক্তব্য, ২০১৮ সালে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের যে নিয়োগ হয়েছিল, তারপরে স্কুল সার্ভিস কমিশন বিধিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। ২০১৯-এ নতুন বিধি চালু হয়। ২০১৬ সালের কোনো বিধির অস্তিত্ব আজ নেই। ফলে সেই বিধি অনুযায়ী নিয়োগের প্রশ্ন আসছে না।
আইন ও আন্দোলন
বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি স্মিতা দাস দে-র ডিভিশন বেঞ্চে সোমবার শুনানি শেষ হয়েছে। এই মামলায় রায়দান আপাতত স্থগিত রেখেছে হাইকোর্ট। যে বিষয়টি এখন নিতান্তই আইনি মারপ্যাঁচের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার জন্য পথের লড়াই কতটা কার্যকরী হতে পারে?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর গার্লস স্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা, আন্দোলনকারী শাহানী নাজনীন বলেন, "যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা দাগি নন, তাদের তালিকা কমিশন প্রকাশ করছে না। যদি সেটা প্রকাশ করে বলে যে, এই শিক্ষকদের নিয়োগে দুর্নীতি নেই, এই সংক্রান্ত তথ্য সুপ্রিম কোর্টে জমা দিলে আমরা অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে পারি। সে কারণেই আমরা রাজ্য সরকারের কাছে দাবি রাখছি। এসএসসি যতই স্বশাসিত সংস্থা হোক না কেন, তারা রাজ্যের নির্দেশেই কাজ করে। কমিশনের কাছে এই সংক্রান্ত তথ্য আছে, তবু কেন তারা প্রকাশ্যে আনছে না বা আদালতকে দিচ্ছে না?
নাজনীন বলেন, "একই পদের একই চাকরি পাওয়ার জন্য আমরা আবার পরীক্ষা দেব কেন? এটা নীতিগতভাবে আমরা মেনে নিতে পারছি না। আমি উচ্চতর ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার জন্য পরীক্ষায় বসতে পারি, কিন্তু যে পদে আমি এখন চাকরি করছি, আবার তার জন্য পরীক্ষা দেব কেন? যেখানে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যে আমাদের নিয়োগে কোনো রকম দুর্নীতি পাওয়া যায়নি। এখন ১০ বছর পার করে মাত্র আড়াই মাস সময় দিয়ে আমাদের বলল, একই পরীক্ষায় বসতে হবে। এটা কতটা অমানবিক বলুন তো?"
তৃণমূলের মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমে বলেন, "মুখ্যসচিব নয়, খোদ মুখ্যমন্ত্রী গত এপ্রিল মাসে নেতাজি ইনডোরে চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শীর্ষ আদালতের নির্দেশের বাইরে কেউ যেতে পারবেন না। আদালত বলেছে, আবার পরীক্ষা নিতে হবে। রাজ্য সরকার সেই অনুযায়ী চলছে।"
আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহরায় প্রশ্ন তোলেন, কেন শাসক দল আদালতকে ঢাল করছে? তিনি সংবাদমাধ্যমে বলেন, "আদালত বলেছিল দাগিদের সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে। সেই প্রক্রিয়া এখন এগোয়নি। উল্টে দাগিদের জন্য রাজ্য সরকার কেন আদালতে আবেদন করছে? ২২ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ফলাফল বা ওএমআর শিট প্রকাশ করা হয়নি। যারা পরীক্ষা দিয়েছেন তাদের উত্তরপত্র দেখার অধিকার আছে। সেটা প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন?"