রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলায় জেএমবির দুই জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত৷ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পলাতক৷ তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শিরীন কবিতা আখতার মঙ্গলবার দেয়া মামলার রায়ে বলেছেন, ‘‘মুক্তচিন্তার কারণেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়েছে৷ হত্যাকারীরা বাংলাদেশ খেলাফত প্রতিষ্ঠার ‘আদর্শে' কাজ করত৷ তারা মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক চিন্তাকে তাদের পথে বাধা মনে করত৷''
আদালত রায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম ও বগুড়ার শিবগঞ্জের মাসকাওয়াত হাসান ওরফে আব্দুল্লাহ ওরফে সাকিবকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে৷ শরিফুল ইসলাম অধ্যাপক রেজাউল করিমের ছাত্র ছিল৷ সে-ই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী৷ নীলফামারির মিয়াপাড়ার রহমত উল্লাহ, রাজশাহী মহানগরীর নারিকেলবাড়িয়া এলাকার আবদুস সাত্তার এবং তার ছেলে রিপন আলীকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷
হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী শরিফুল ইসলাম পলাতক৷ বাকি চারজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে ডয়চে ভেলেকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এন্তাজুল হক বাবু জানান৷
‘এটা কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়, যারা হত্যা করেছে তারা বাংলাদেশে খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়’
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে রাজশাহী নগরীর শালবাগান এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় রাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে৷ তিনি ‘কোমলগান্ধার' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন৷ ‘সুন্দরম' নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও উপদেষ্টা ছিলেন৷ তিনি একটি গানের স্কুল প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা করছিলেন৷
হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর আট জনকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজশাহী মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক রেজাউস সাদিক৷ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এন্তাজুল হক বাবু জানান, চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার অভিযুক্ত আট আসামির মধ্যে খায়রুল ইসলাম বাঁধন, নজরুল ইসলাম ওরফে হাসান ওরফে বাইক হাসান ও তারেক হাসান ওরফে নিলু ওরফে ওসমান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন৷ তিনি জানান, ‘‘ রায়ে আদালত বলেছেন, এটা কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড নয়৷ যারা হত্যা করেছে, তারা বাংলাদেশে খেলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়৷ তারা দেশের প্রচলিত ব্যবস্থা, গণতন্ত্র , মুক্তচিন্তা এগুলো মানে না৷ অধ্যাপক রেজাউল করিম মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন৷ সংস্কৃতি চর্চা করতেন৷ তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ সেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হতো, গান হতো, সাংস্কৃতিক চর্চা হতো৷ এটা হত্যাকারীরা সহ্য করতে পারেনি৷ তাঁর বিভাগের শিক্ষক শরিফুল তাঁকে বলেছিল, এসব চলবে না স্যার৷ আদালত মনে করে এটা গণতন্ত্র এবং মুক্তবুদ্ধির ওপর হামলা৷''
‘আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট আমরা এখন এই রায়ের বাস্তবায়ন চাই’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সবার অপরাধ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি৷ পলাতক শরিফুলকে গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আদালত৷''
নিহত শিক্ষক রেজাউল করিমের মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি রায়ের পর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এই রায়ে সন্তুষ্ট৷ আমরা এখন এই রায়ের বাস্তবায়ন চাই৷ এই রায় যেন উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে এবং দ্রুত কার্যকরহ হয়৷ শরিফুল বাবাকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী৷ তার ফাঁসির আদেশ হলেও এখনো পলাতক৷ আমরা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি৷ তাকে যেন দ্রুত গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করা হয়৷ আদালতও শরিফুলকে মূল পরিকল্পনাকারী বলেছেন৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ মুক্তচিন্তার জন্যই আমারবাবাকে হত্যা করা হয়েছে৷ আমার বাবাকে হত্যার সঙ্গে আরো অনেক হত্যাকাণ্ডই একইসূত্রে গাঁথা৷ তাই মুক্ত ও গণতান্ত্রিক চিন্তার পক্ষে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে৷ আমি লক্ষ্য করেছি, এখন অনেকে ভয় পান৷ কোনো একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে গেলে বলে, ‘না থাক, দরকার নাই৷' আমাদের এই ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না৷''
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক রেজাউল হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শরিফুলকে ধরিয়ে দিতে রাজশাহী মহানগর পুলিশ দুই লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল৷ কিন্তু তাকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি৷ পুলিশ ধারনা করছে, সে পাশের কোনো দেশে পালিয়ে গেছে৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷