রাতের কাজ, ওভারটাইম, কম মজুরি – এ সব কারণে বেকারিতে শিক্ষানবিশ পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে জার্মানিতে৷ তবে ১৯ বছরের মালকোলমকে তা পিছু হঠাতে পারেনি৷ এই মুহূর্তে একটি পারিবারিক বেকারিত কাজ শিখছে এই তরুণ৷
বিজ্ঞাপন
রাত দুইটার আগে থেকে ব্যাকারিতে মালকোলম ও তার সহকর্মীরা কাজ শুরু করে৷ রুটির ময়দা মেশানো, মণ্ড মাখা, রুটি বানানো, বেক করা – এ সব ছয়টার আগেই শেষ হয়ে যায়৷ পেঙ্কার্ট বেকারির চার শাখায় সরবরাহ করা হয় এসব রুটি৷ কাজ শেষ হয় ১০টার মধ্যে৷ মালকোলম জানায়, ‘‘এই মেশিনে এক রাতে আমি ৩,০০০ বান রুটি তৈরি করি৷ সব মিলিয়ে সপ্তাহে প্রায় ১৩ হাজার বান রুটি বানানো হয়৷''
জার্মানিতে ৪০০ বিভিন্ন ধরনের রুটি বেক করা হয়৷ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তা অনন্য৷ রুটি প্রস্তুতকারীদের সৃজনশীলতার কোনো অভাব নেই৷ মালকোলমও নানা রকমের রুটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আনন্দ পায়৷
আদতে মিডিয়াতে কাজ করার আকাঙ্খা ছিল ১৯ বছরের এই তরুণের৷ কিন্তু প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তা সম্ভব হয়নি৷
পাউরুটির দেশ জার্মানি
বিভিন্ন রকমের শস্য দানা দিয়ে নানা স্বাদের, নানা নামে রুটি খেতে যেমন মজা তেমনি স্বাস্থ্যকরও বটে৷রুটি যে শুধু সকালের নাস্তায়ই থাকে তা নয়৷ জার্মানরা পাউরুটি দিয়ে রাতের খাবারও সারেন৷
ছবি: Fotolia/cirquedesprit
পাউরুটির বৈচিত্র্য
সম্ভবত জার্মানিই একমাত্র দেশ, যেখানে প্রায় তিনশো রকমের পাউরুটি রয়েছে৷ রয়েছে প্রায় ১,২০০ রকমের মিষ্টি বা নোনতা বিস্কুট৷ জার্মানদের প্রিয় খাবার বিভিন্ন ধরনের পাউরুটি৷ তবে রুটির জন্ম কিন্তু মিশরে, তিন হাজার বছর আগে৷
ছবি: Fotolia/Ludwig Berchtold
দানা মিশ্রিত পাউরুটি
বিভিন্ন রকমের শস্য দানা দিয়ে নানা স্বাদের, নানা নামে রুটি খেতে যেমন মজা তেমনি স্বাস্থ্যকরও বটে৷ গম বা আটার রুটিতে মেশানো হয় ভুট্টা, গম, তিল, যব জাতীয় বিভিন্ন দানা৷ তাছাড়াও সূর্যমুখী ফুলের বীজ, বিভিন্ন কুমড়ার বীজের পাউরুটিগুলো খেতে খুবই স্বাদ৷ রুটিতে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে দেওয়া গাজরের টুকরা বেশ রসালো স্বাদের৷
ছবি: Axel Warnstedt
নানা উপলক্ষ্যে রুটি
জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, ভালোবাসা, নববর্ষ – এ সব উপলক্ষ্যে বানানো হয়ে থাকে স্পেশাল পাউরুটি৷ যদিও এসবের প্রচলন আজকাল আগের মতো তেমনটা নেই৷
ছবি: Fotolia/tolism
জার্মানরা দু’বেলায়ই পাউরুটি খায়
দেশে রুটি যে শুধু সকালের নাস্তায়ই থাকে তা নয়৷ জার্মানরা পাউরুটি দিয়ে রাতের খাবারও সারেন৷ তবে নাস্তার রুটি আর রাতের খাবারের রুটির মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে৷ সকালে বেকারিতে রুটি কিনতে গেলে তাজা রুটির গন্ধ আর স্বাদ নিঃসন্দেহে খিদে বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: Fotolia/Grecaud Paul
সবার প্রিয় ব্র্যোটশেন
ব্র্যোটশেন – গোল বা ডিম্বাকৃতির পাউরুটি৷ আর এই রুটি ছাড়া সকালের নাস্তা জার্মানরা ভাবতেই পারেন না৷ একটি ব্র্যোটশেন মাঝখানে কেটে দু’ভাগ করে, ভেতরে মাখন, পনির, জেলি বা এ ধরনের কিছু লাগিয়ে খেতে সত্যিই দারুণ মজা৷ ব্র্যোটশেন এতোটাই প্রিয় যে, জার্মানিতে রোববারে সবকিছুই বন্ধ থাকলেও কিছু এলাকায় শুধুমাত্র ব্র্যোটশেন বিক্রির জন্য বেকারি খোলা রাখা হয়৷
ছবি: Fotolia/st-fotograf
জার্মান পাউরুটি দারুণ মজা
জার্মান রুটির প্রশংসা চারিদিকে৷ নিজের দেশে বেকারি খোলার পরিকল্পনা থেকে জার্মানিতে পাউরুটি বানানোর ট্রেনিং নিতে আসেন অনেকেই৷ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছে ক্যাথরিন, চীন থেকে চিওচাং লাম এবং দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছে এলোমালাই গোপাল৷ ওদের সবারই এককথা, ‘‘জার্মান পাউরুটি দারুণ মজা’’!
ছবি: picture-alliance/dpa
ভাতের পরিবর্তে রুটি
এশিয়ার দেশগুলোতে ভাত খাওয়ার প্রচলনই বেশি তবে দিন দিন তা বদলে যাচ্ছে৷ জাপানে গত ৩০ বছর ধরে ভাতের জায়গা দখল করছে রুটি৷ তবে তা শুধু শহরগুলোতে, গ্রামে আগের মতোই ভাত খাওয়া হয়৷ একথা বাংলাদেশ বা ভারতের ক্ষেত্রেও কিছুটা প্রযোজ্য৷
ছবি: Fotolia/ExQuisine
জার্মানিকে বলা হয় পাউরুটির দেশ
পাউরুটি তৈরির সময় বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয় এতে পুরো খাদ্যগুণ বজায় থাকে কিনা৷ এখানে সাদা রুটি খুবই কম দেখা যায়৷ সাদা টোস্ট পাউরুটি জার্মানিসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়৷ তবে জার্মানিতে সাদা অর্থাৎ শুধু ময়দায় টোস্ট নয়, এখানে তৈরি করা হয় বিভিন্ন দানাসহ টোস্ট রুটি যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পাউরুটি বানানোর কারিগর থেকে ফুটবলার
জার্মানির সুবিখ্যাত ফুটবলার এবং সাবেক জাতীয় দলের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান পেশায় একজন ‘বেকার’ অর্থাৎ তিনি পাঁউরুটি বানানো শিখেছেন৷ তবে কখনো রুটি বানিয়েছেন কিনা, তা বলা যায়না৷
ছবি: Getty Images
ছোট থেকে বড়, সবাই পাউরুটি খায়
ছোটবেলা থেকে পাউরুটি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে জার্মানদের৷ বাড়ি থেকে বের হবার সময় যার যা ইচ্ছে, অর্থাৎ সালাদ, পনির, মাছ, মাংসের স্লাইস পছন্দমতো পাউরুটির ভেতরে ঢুকিয়ে সুন্দর করে স্যান্ডউইচ বানিয়ে সাথে নিয়ে নেয়৷ স্যান্ডউইচ তাজা রাখার জন্য আলাদা বক্সও রয়েছে৷
ছবি: Fotolia/Quade
দেশের কথা মনে পড়ে
জার্মানরা নানা দেশ ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, সে কথা অনেকেরই জানা৷ ছুটি থেকে ফিরে এলে বহু জার্মানকেই বলতে শোনা যায়, ছুটি উপভোগ করলেও দেশি পাউরুটি তারা মিস করেছে বিদেশে, বিশেষ করে সকালের নাস্তায়৷ আর বিদেশিরা জার্মানিতে এসে জার্মান পাউরুটির বৈচিত্র্য দেখে, খেয়ে আনন্দিত হয়৷
তবে অনুরাগ ছাড়া এই পেশায় কাজ করা সহজ নয়৷ বিশেষ করে রাতের কাজ অনেককে আতঙ্কিত করে৷ তাই গত ছয় বছরে বেকারির শিক্ষানবশির সংখ্যা ৩৬ হাজার থেকে কমে ২৩ হাজারে দাঁড়িয়েছে৷
সপ্তাহে দু-একবার বৃত্তিমূলক স্কুলে যেতে হয় তাকে৷ সেখানে অঙ্ক ও জার্মান ভাষায় ক্লাস করতে হয়৷ এছাড়া ময়দার মণ্ড মাখার কৌশল ও স্বাস্থ্যসম্মত নিয়ম কানুন শিখতে হয় তাকে৷ তবে মালকোলম হাতে কলমে কাজ করতে পছন্দ করে৷
যে দিন ক্লাস থাকে, সেদিন কিছুটা বেশি সময় ঘুমাতে পারে সে৷ তবে এটা সুবিধাজনক বলে মনে করে না এই তরুণ৷ এতে ঘুমের রুটিন উল্টোপাল্টা হয়ে যায়৷ এছাড়া বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে তার৷ আগে ১০ জন বন্ধু থাকলেও এখন রয়েছে মাত্র দু'জন৷ ‘‘তারা যখন কাজে যায়, তখন আমি ঘুমিয়ে থাকি৷ তাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে আমার ঘুম ভাঙে৷''
জার্মানদের কেক প্রীতি
জন্মদিনের উৎসবে কেক খাওয়ার প্রচলন প্রায় সব দেশেই রয়েছে৷ কিন্তু জার্মানিতে শুধু জন্মদিন নয়, কেক খাওয়া হয় নানা উৎসবে এবং নানাভাবে৷ চলুন তারই কিছু নমুনা দেখা যাক এই ছবিঘরে৷
ছবি: Fotolia/allari
হরেক রকমের কেক
কত স্বাদ আর কত ধরণের কেক যে রয়েছে জার্মানিতে, তার হিসেব নেই৷ সাধারণ খাবারের দোকানে পাওয়া যায় সাধারণ কেক৷ তবে শুধু কেকের জন্য আলাদা বিশেষ দোকানও আছে জার্মানিতে৷ ছবিতে যেমন দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/I. Wanner
জন্মদিনের কেক
জন্মদিনে কেক খাওয়ার হয় সব দেশেই৷ কাজেই এ আর নতুন কিছু নয়৷ তবে জার্মানিতে জন্মদিনের উৎসবে বিশেষ করে জার্মানরা অনেকেই বাড়িতে কেক তৈরি করেন৷ জার্মানরা শুধু কেক খেতেই ভালোবাসেন না, নিজেরা ঘরে কেক তৈরি করতেও ভালোবাসেন৷ ঘরে তৈরি কেকের স্বাদই আলাদা!
ছবি: Fotolia/allari
বিয়েতে বিশেষ কেক
বিয়ে মানেই বিশেষ দিনের বিশেষ অনুষ্ঠান, তাই এ দিনটির জন্যও চাই বিশেষ ধরণের কেক৷ বেশিরভাগ বিয়ের কেকের ওপরে সাজানো থাকে ক্রিমের তৈরি পুতুল বর-বধু৷
ছবি: Fotolia/jörn buchheim
বিভিন্ন ঋতুর কেক
জার্মানদের কাছে বিভিন্ন ফল দিয়ে তৈরি কেক বেশ প্রিয়, বিশেষ করে বড়দের কাছে৷ বিভিন্ন ফল দিয়ে তৈরি কেক খেতে খুব মজা৷ স্ট্রবেরি আর আপেলের তৈরি কেকের কথা এখানে না বললেই নয়!
ছবি: Fotolia/M. Elflaco
গরম কেক
কেক গরম গরম খাওয়া হয় শুনলে কেমন যেন মনে হয়, তাই না? অথচ পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি কেক খেতে কিন্তু খুবই সুস্বাদু৷ অনেক সময় দুপুরেও এই কেক খাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকেলে কফি আর কেক
বিকেলে চা আর বিস্কুট খাওয়া খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যেমন চায়ের সঙ্গে টা, তেমনই জার্মানিতেও বিকেলে কফি ও কেক খাওয়ার চল আছে৷ কফি আর কেক খাওয়ার দোকানগুলোকে এখানে ‘ক্যাফে’ বলা হয়, যা খুবই জনপ্রিয় জার্মানিতে৷
ছবি: picture-alliance/Bildagentur Huber
রবিবারের কেক
রবিবার, অর্থাৎ ছুটির দিন৷ জার্মানিতে এ দিনে সবই হয় একটু ভিন্ন ধরণের৷ অনেকে বাড়িতে কেক বানান৷ সে সময় মা বা নানি-দাদির সাথে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও সঙ্গী হয়৷ অনেকে আবার ঘটা করে শহরের নাম করা ‘ক্যাফে’-তে কফি আর কেক খেতে যান৷ বলা বাহুল্য, বিশেষ কিছু কেক শুধু রবিবারেই তৈরি করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Stockfood
কেক ডেজার্ট
ক্রিম, দই, সুজি – এ ধরনের উপাদান দিয়ে কিছু কেক তৈরি করা হয়, যেগুলো খাওয়া-দাওয়ার শেষে ‘ডেজার্ট’ হিসেবে খাওয়া হয়৷
ছবি: Koelnmesse
বিখ্যাত কেক
জার্মানির কিছু কিছু অঞ্চলের আলাদা কেক রয়েছে৷ বিশেষ করে ব্ল্যাকফরেস্ট অঞ্চলের বিখ্যাত এই কেকের কথা অনেকেই হয়তো জানেন৷
ছবি: Fotolia/don57
বাচ্চাদের কেক
ছোট ছোট এক ধরণের কেক বাচ্চারা খুবই পছন্দ করে৷ বাচ্চাদের জন্মদিন বা কোনো অনুষ্ঠানে বাচ্চারা গেলে, সেখানে বাচ্চাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে এ সব কেক কিনে অথবা বানিয়ে রাখেন অনেকেই৷
ছবি: Fotolia/CS
10 ছবি1 | 10
তবে শুধু রাতের কাজই নয়, অন্যান্য পেশার তুলনায় বেকারির শিক্ষানবিশের বেতন খুব কম৷ তাই বেশিরভাগ শিক্ষানবিশ মা-বাবার সঙ্গে বসবাস করেন৷ বড় বড় বেকারিতে ছুটির দিনে কাজ করলে উপরি পাওয়া যায়৷ কিন্তু ছোট বেকারিগুলিতে সেটা সম্ভব নয়৷ কিন্তু মালকোলম ছোট পারিবারিক বেকারিতে কাজ শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার ভাষায়, ‘‘আমার ধারণা বড় বেকারির চেয়ে এখানেই আমি হাতের কাজটা ভালোভাবে শিখতে পারবো৷''
বনের কাছে পেঙ্কার্ট বেকারিটি ৫০ বছর ধরে ব্যবসা চালাচ্ছে৷ সস্তা পণ্যের বেকারিতে বাজার ছেয়ে যাওয়ায় মালিক বোডো পেঙ্কার্টকে প্রতিযোগীদের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে টিকে থাকতে হচ্ছে৷
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মান দিয়ে তাঁর পণ্যকে তুলে ধরতে চান পেঙ্কার্ট৷ রুটি, বান রুটি থেকে শুরু করে কেক পর্যন্ত৷ বছরে খুব বেশি হলে দু'জন শিক্ষানবিশকে প্রশিক্ষণ দেন তিনি৷
মালকোলমকে পেয়ে খুব খুশি এই বেকার মাস্টার৷ সে শুধু সৎ ও পরিশ্রমীই নয়, প্রতিভাবানও৷ মালকোলমের সামনে বিশাল লক্ষ্য: প্রশিক্ষণ ও মাস্টার পরীক্ষা শেষ করে ফ্রান্সে পাড়ি দিতে চায় সে৷ সহায়তা পাওয়া যাবে মায়ের কাছ থেকে৷ তার কথায়, ‘‘আমার ইচ্ছা মাকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে কাজ করা৷ সেখানে মা কনফেকশনারির ভার নেবেন এবং আমি বেকারির দায়িত্ব নেবো৷