ভিসা অধিকার নয়, বিশেষ সুযোগ: ডিডাব্লিউকে মার্কিন দপ্তর
২৮ জুন ২০২৫
২৬ জুন দূতাবাসের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার অ্যাফেয়ার্স বিভাগের বরাতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পোস্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থী বা স্টুডেন্ট ভিসার আবেদনকারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গোপনীয়তা ‘পাবলিক' রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় ভিসার ক্ষেত্রেও এই নির্দেশনা কার্যকর হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্দেশনার পর সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে আলোচনা হচ্ছে এই নির্দেশনা কি বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা একজন ব্যক্তির নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে কিনা! কেউ কেউ এ নির্দেশনাকে সঠিক মনে করলেও অনেকেই সমালোচনা করেছেন। তারা মনে করছেন, এটা অবশ্যই একজন ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পোস্টের নিচেও অনেকে সমালোচনা করেছেন।
এই নির্দেশনার কারণে কি একজন শিক্ষার্থী ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা বা তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে না? এটা জানতে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই নির্দেশনা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কনস্যুলার অ্যাফেয়ার্স বিভাগ থেকে এসেছে। ফলে এ ব্যাপারে কিছু জানতে হলে তাদের মেইল করতে হবে।”
ডয়চে ভেলে এ বিষয়ে জানতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে মেইল পাঠালে ফিরতি মেইলে বেশ কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরা হয়েছে।
ডয়চে ভেলেকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যা বলেছে
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর বরাত দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, "এটা বাকস্বাধীনতার ব্যাপার নয়, শিক্ষার্থী ভিসা কারো অধিকার নয়।"
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডয়চে ভেলেকে আরো বলেছে,
* ট্রাম্প প্রশাসন আমাদের (মার্কিন) ভিসা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা এবং জননিরাপত্তার সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে আমাদের জাতি এবং আমাদের নাগরিকদের সুরক্ষার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। মার্কিন ভিসা একটি বিশেষ সুবিধা, অধিকার নয়। প্রতিটি ভিসার সিদ্ধান্ত, একটি জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সিদ্ধান্ত।
* নতুন নির্দেশিকা অনুসারে, আমরা এফ, এম, এবং জে অ-অভিবাসী শ্রেণীর সকল ছাত্র এবং এক্সচেঞ্জ (বিনিময়) দর্শনার্থী আবেদনকারীদের অনলাইন উপস্থিতিসহ একটি বিস্তৃত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া পরিচালনা করবো।
* এই যাচাই-বাছাই সহজতর করার জন্য, এফ, এম, এবং জে অ-অভিবাসী ভিসার জন্য সকল আবেদনকারীকে তাদের সকল সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলের গোপনীয়তা সেটিংস "পাবলিক" করার জন্য অনুরোধ করা হবে।
* ভিসা আবেদনকারীদের যথাযথভাবে যাচাই করা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়। আমাদের ভিসা নীতিগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিশ্রুতিকেই তা প্রতিফলিত করে।
ডয়চে ভেলের প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, "অন্য সব দেশের মতোই ভিসার জন্য আবেদন করা (কোনো ব্যক্তির) নিজস্ব ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে, এবং কেউ যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করবেন কিনা সে সিদ্ধান্ত তারা স্বাধীনভাবেই নিতে পারেন।"
তীব্র সমালোচনার মুখে নতুন নীতি
২০১৯ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভিসা আবেদনকারীদের সোশ্যাল মিডিয়া আইডেন্টিফায়ার বা ব্যবহারকারীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করেছে।
এই নিয়ম ইমিগ্র্যান্ট (অভিবাসী) ও নন-ইমিগ্র্যান্ট (অ-অভিবাসী) উভয় শ্রেণির ভিসার আবেদনকারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতায়, জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভিসা যাচাই ও নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য যেকোনো প্রাসঙ্গিক তথ্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
নতুন নীতির ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থী ও বিনিময় কর্মসূচির অংশগ্রহণকারীদের তাদের ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার (এক্স), ইউটিউবসহ অন্য অ্যাকাউন্টের তথ্য সরকারি কর্মকর্তাদের সহজে যাচাইয়ের সুযোগ করে দিতে হবে।
তবে সদ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা ভিসা পেয়েছেন অরিণ আহমেদ। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আমি ২২ মে ভাইভা দিয়েছিলাম। তখন অবশ্য এই শর্ত ছিল না। তবে আমাদের যে ফরমটি পূরণ করতে হয়েছে সেখানে একটা অপশন ছিল। কিন্তু বাধ্যতামূলক ছিল না। ফলে আমি সেটা পূরণ করিনি। যদিও আমার ফেসবুক উন্মুক্ত। তারপরও ভয়ে ভয়ে ছিলাম যদি এ নিয়ে প্রশ্ন করে তাহলে কি বলবো? শেষ পর্যন্ত আমাকে ওরা কোন প্রশ্ন করেনি। আগামী মাসেই আমি ক্যালিফোনিয়ায় পড়তে চলে যাচ্ছি।”
কেন এই নির্দেশনা? কি মনে হয় আপনার? জবাবে তিনি বলেন, "এমন কিছু হয়তো ঘটেছে, যার কারণে তারা এটা নিচ্ছে। কেউ হয়ত সেখানে গিয়ে ভিন্ন কোন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারেন, ফলে তারা সবার ক্ষেত্রে এটা বাধ্যতামূলক করেছে।”
এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এটা অবশ্যই বাক স্বাধীনতার বিরোধী। আমরা যে অ্যামেরিকাকে চিনতাম, এখন সেই অ্যামেরিকা আর নেই। ট্রাম্প আসার পর সবকিছুই বদলে ফেলেছেন। তিনি তো ফিলিস্তিনির পক্ষে বিক্ষোভ করায় বেশ কিছু শিক্ষার্থীর ভিসাও বাতিল করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের একটা মেয়েও আছে। ফলে আমাদের ছেলে মেয়েদের সেখানে পড়তে যেতে হলে ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে চাইছে, সেভাবেই সেখানে যেতে হবে। এর তো কোন বিকল্প নেই।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদও মনে করেন, এটা ভয়াবহভাবে বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধ। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "ওরাই তো এখন বিশ্ব চালাচ্ছে। ফলে তারা যেভাবে চাইবে আমাদের সেভাবেই সেখানে যেতে হবে।”
মার্কিন দূতাবাসের ফেসবুক পোস্টের নিচেও অনেকে সমালোচনা করেছেন। সেখানে আইমান নামে একজন লিখেছেন, "দুঃখের বিষয় হলো, বেশিরভাগ অথবা সকল আবেদনকারীই হয়তো ‘অপর্চুনিটিসের দেশ'-এ প্রবেশের জন্য তাদের গোপনীয়তার অধিকার বিক্রি করে দেবেন। হয়তো আমি নিজেও একই কাজ করতাম।”
পাপিয়া সুলতানা লোপা নামে একজন লিখেছেন, "এটা কি গোপনীয়তার লঙ্ঘন নয়?” শাওন শেখ নামে একজন লিখেছেন, "যদি একটা রসিকতা শুনতে চাও সেটা হলো আমেরিকায় বাক স্বাধীনতা!”
তবে ভিন্নমতও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী মনে করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে, অন্য অনেক দেশ সেই কাজ গোপনে আগে থেকেই করে আসছে।
ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একটা দেশ কাকে তার দেশে যাওয়ার সুযোগ দেবে সেই স্বাধীনতা তো তার আছে। আমাদের তরুণ সমাজের অনেকেরই অনেক বেশি সময় কাটে সামাজিক মাধ্যমে। ফলে একজনের সামাজিক মাধ্যম দেখলে বোঝা যায় তার মানসিকতা। এখন যুক্তরাষ্ট্র যেটা উন্মুক্ত করেছে, সেটা কিন্তু গত দুই বছর ধরে বহু দেশ গোপনে করে আসছিল। ফলে অ্যামেরিকার জন্য যদি কাউকে হুমকি মনে করে, তাহলে তাকে ভিসা নাও দিতে পারে। একইভাবে বাংলাদেশ বিদেশি কাউকে ভিসা দেওয়ার ক্ষেতে এই বিষয়গুলো দেখতে পারে। এতে তো দোষের কিছু নেই। আর যদি বাক স্বাধীনতার কথা বলেন, তাহলে আপনি সেখানে ভিসার আবেদন করবেন না। তাহলে তো আপনার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে না। আমরা বুঝতে হবে স্বাধীনতা সব সময় শর্তসাপেক্ষ।”