রাজ্যের দুই হাজার ২৬টি সরকারি এবং সরকার অনুমোদিত স্কুলের গ্রন্থাগারে এক লাখ টাকার বই কেনার উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তবে নিজেদের সিদ্ধান্তে নয়, বই বাছতে হবে সরকারের পছন্দের তালিকা থেকে। সুদীর্ঘ সেই তালিকায় আছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বা শেক্সপিয়ার-- বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দুসহ একাধিক ভাষার তাবড় লেখক লেখিকাদের বই। এবং তার সঙ্গে রয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ডজন খানেক বইয়ের নামও।
বিতর্ক কেন?
বাধ্যতামূলক না হলেও, তালিকায় মুখ্যমন্ত্রীর বই থাকায় শুরু হয়েছে বিতর্ক। জেলার শিক্ষা পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকে স্কুলগুলিতে প্রায় ৫৩৭টি বইয়ের একটি তালিকা পাঠানো হয়। তার মধ্যে প্রায় ১৯টি বই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। এর মধ্যে আছে কবিতাবিতান, কন্যার চোখে কন্যাশ্রী, আমাদের দুর্গোৎসবসহ একাধিক বই।
শিক্ষা দপ্তর থেকে এই উদ্যোগে কাজ শুরু হয় ২০১৯-এ। তৎকালীন সিলেবাস কমিটির প্রধান অভীক মজুমদার, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সুধাংশুশেখর দে এবং আরো অন্যান্যদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হয়। সেই কমিটির তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় তালিকা। আলোচনার পর শিক্ষা দপ্তরকে সেই তালিকা পাঠানো হয়।
অভীক, যিনি পরবর্তীকালে সিলেবাস কমিটি থেকে সরে দাঁড়ান, ডিডাব্লিউকে বলেন, "অনেকের সুপারিশে এই তালিকা তৈরি হয়। আমি সেই সময় কমিটিতে ছিলাম। বই বাছাইয়ের কাজ করেছিলেন একাধিক লেখকসহ কমিটির বাছাই করা একটি দল। আমরা বই বাছাইয়ের দলে ছিলাম না। কাজটি চলে হিন্দু স্কুলে। আমাদের কাছে সেই তালিকা আসার পরে আমরা আলোচনা করে সরকারকে পাঠাই। সেটা এখন কার্যকর করা হচ্ছে।"
বই বাছাইয়ের দলে কারা ছিলেন সে বিষয় আলোকপাত করেননি তিনি। তিনি বলেন, "এতদিন আগের কথা। আমার ঠিক মনে নেই।"
চাকরি দুর্নীতি : যোগ্যদের পাশাপাশি অযোগ্যদেরও পাশে থাকতে চেয়ে তোপের মুখে মমতা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, যোগ্যদের চাকরির বিষয়টির ফয়সালা করে অযোগ্যদের বিষয়টিও দেখবেন। কিন্তু ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ মানতে নারাজ যোগ্যরা৷ অযোগ্যদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েও তোপের মুখে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী...
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সময় চাইলো এসএসসি
সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছিল, যেহেতু যোগ্য ও অযোগ্যর মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না, তাই প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হবে। এসএসসি সুপ্রিম কোর্টে করা আবেদনে বলেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষের শেষপর্যন্ত যোগ্যদের চাকরি করতে দেয়া হোক। এর জন্য সুপ্রিম কোর্ট প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিক।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মমতা যা বললেন
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে চাকরিহারাদের একাংশকে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ''কারো চাকরি যাবে না। আগে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্য়া চাইবে। সুপ্রিম কোর্টের নেতিবাচক উত্তর হলে সরকার যোগ্যদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবে। দুই মাসের মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা করে দেবো।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
স্বেচ্ছাশ্রমের প্রস্তাব
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘আপনারা কি এখনো বরখাস্তের নোটিস পেয়েছেন? (না পেয়ে থাকলে) চাকরি করুন না! স্বেচ্ছায় তো সকলেই কাজ করতে পারেন।’’ তিনি আরো বলেন, ''আপনাদের সরকার বরখাস্ত করেনি। আপনারা স্কুলে যান। কাজ করুন।'' কিন্তু স্বেচ্ছায় কাজ করলে বেতন পাওয়া যাবে কিনা, স্বেচ্ছায় কাজ করলে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষকদের মতো অল্প বেতন দেয়া হবে কিনা, সে বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী কিছু বলেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
প্রতিবাদ
মুখ্যমন্ত্রীর স্বেচ্ছাশ্রমের বিষয়টি উপস্থিত চাকরিহারা শিক্ষকরা মেনে নিতে পারেননি। তাদের অনেকেই বলতে থাকেন, এভাবে হয় না, স্বেচ্ছাশ্রম বিষয়টির ব্যাখ্যা চাই। তবে তারা স্কুলে ফিরতে চান। তারা বলেন, বেতনসহ চাকরি রাখা হলে তারা স্কুলে ফিরবেন। তবে তারা চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতে চান না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের চাকরির প্রসঙ্গে মমতা
এ বিষয়ে মমতা বলেন, ''অযোগ্যদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করবো। অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে আমার কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু অযোগ্য কাকে বলেছে, কেন বলেছে, কোন এজেন্সি বলেছে- সে সব দেখবো। নিশ্চিন্তে থাকুন। যোগ্য এবং অযোগ্যদের মধ্যে গন্ডগোল বাঁধাবেন না। মানুষকে শিক্ষা দিন। শিক্ষিত করুন। কারা যোগ্য, কারা অযোগ্য তা আদালত বলেনি। ২০২২ থেকে খেলা শুরু করেছে। আমি জেনে-শুনে কারো চাকরি খাইনি।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অযোগ্যদের নিয়ে বক্তব্যের প্রতিবাদ
অযোগ্যদের নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার প্রতিবাদ করেন সভায় উপস্থিত চাকরি হারানো শিক্ষকরা। তারা বলেন, অযোগ্যদের চাকরি দেয়া যাবে না। তাদের প্রশ্ন- যোগ্যদের তালিকা তিনি কি সুপ্রিম কোর্টে দেবেন? সুপ্রিম কোর্ট তো তালিকা দেবে না। দেবে এসএসসি। সিবিআই রিপোর্ট মানলে যোগ্য ও অযোগ্যদের তো আগেই আলাদা করা যেতো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চাকরিহারাদের দাবি
চাকরিহারা শিক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, রাজ্য সরকার ও এসএসসির জন্য এখন তাদের এই অবস্থা। তারা যোগ্য ও অযোগ্য আলাদা করেনি। চাকরি হারানো যোগ্য শিক্ষকরা মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী সব গোলমাল পাকিয়েছেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিকাশ ভট্টাচার্য বনাম মমতা
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''সিপিএমের কাছে প্রশ্ন করছি, কেন বিকাশ ভট্টাচার্য সব চাকরি বাতিল করালেন? তাকে আইসোলেট করুন।'' এর জবাবে বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ''তিনি দুর্নীতি করেছেন। সকলে পেটাবে। মারের হাত থেকে বাঁচতে এসব বলছেন। তিনি বারবার যোগ্য অযোগ্য বলছেন। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে তো বললেন না। রায়ের পর লম্ফঝম্প করছেন।''
ছবি: Srijit Roy
বিরোধী নেতার বক্তব্য
রাজ্যের বিরোধী দলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''সরকারের কাছে সুযোগ আছে চাকরি দেয়ার। সরকার রিভিশন পিটিশন করেছে। সরকার যোগ্যদের তালিকাটা ফেলে দিন। তাহলে দুধ ও জল আলাদা হবে। কোনো বিতর্ক থাকবে না। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকার ও এসএসসির অসহযোগিতার জন্য যোগ্য ও অযোগ্য বাছতে পারলাম না। তিনি (মমতা) যদি বলেন, সবাইকে চাকরি দিলাম ১০ হাজার টাকা করে দেবো. সেটা মানবো না।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
নবান্নর কাছে বিক্ষোভ
চাকরি না পাওয়া শিক্ষকদের একাংশ নবান্নর কাছে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। তাদের দাবি, যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তারা কেন চাকরি পাবেন না তাদের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সারা রাত চাকরিহারা শিক্ষকদের অপেক্ষা
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাবেন বলে কলকাতার বাইরে থেকে আসা শিক্ষকরা সারা রাত শহিদ মিনারের পাশে মাঠে ছিলেন। ‘যোগ্য’ লেখা কার্ড সংগ্রহ করে সকালে নেতাজি ইন্ডোরে যান তারা।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ঢোকার সময় ঝামেলা
‘যোগ্য’ কার্ড না পাওয়ায় অনেক শিক্ষকই ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। জোর করে ঢুকতে চাওয়ায় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয় তাদের।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
12 ছবি1 | 12
'কেন্দ্রীয় আরোপ'
শিক্ষা দপ্তর কেন স্কুলগুলিকে বইয়ের তালিকা দেবে, স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকা বা ছাত্রছাত্রীরা কেন স্বাধীন সিদ্ধান্তে বই বাছাই করতে পারবে না, প্রাথমিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়ে। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার এই ঘটনাকে 'অবৈধ এবং অন্যায়' বলে মনে করেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "কোন স্কুলে কী বই লাগবে, তা তারা নিজেরাই ঠিক করবে। শিক্ষা দপ্তর টাকা দেবে। সেই টাকায় স্কুলের শিক্ষকেরা বই বাছাই করে কিনবেন। এমনটাই হওয়ার কথা। এই টাকা আমাদের করের টাকা। শিক্ষা দফতরের নিজস্ব টাকা নয়। শিক্ষকেরা কিছু জানেন না, এমনটা তো নয়। এই কেন্দ্রীয় আরোপের মধ্যে স্বেচ্ছাচারের গন্ধ লুকিয়ে আছে।"
এই প্রকল্প অনুসারে বই সরবরাহের কাজটি করছে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড। চিত্রশিল্পী সমীর আইচ বলেছেন, "এই সরকার মূলগতভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। আমার আশংকা এই প্রকল্পের মাধ্যমেও তারা দুর্নীতির রাস্তা প্রশস্ত করবে।"
একই সঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর বইয়ের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সমীর। তিনি বলেন, "আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনীতিবিদ হিসেবে চিনি। লেখিকা হিসেবে তাকে কারা স্বীকৃতি দেন, আমি জানি না। তার যারা কাছের মানুষ, তাদের উচিত তার লেখার ঠিক মূল্যায়ন মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরা।"
অন্যদিকে, পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সুধাংশুশেখর দে-র মতে, এই বিতর্ক 'অপ্রয়োজনীয়'। তিনি বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৫ থেকে বই লেখেন। মানুষ তার বই কিনে পড়েন। বাজারে তার বইয়ের ভালো কাটতি। সেই কারণে তালিকাতেও তার বই আছে। এতে এতো বিতর্কের কিছু নেই।" প্রসঙ্গত, তালিকার একাধিক বইসহ মুখ্যমন্ত্রীর অনেক বই সুধাংশুশেখরের মালিকানাধীন দেজ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হয়।
লেখার গুনগত মান নিয়ে মন্তব্য না করে সরকারি প্রকল্পে মুখ্যমন্ত্রীর বই রাখার বিষয়টির নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন পবিত্র। তিনি বলেন, "কীভাবে একটি সরকার মুখ্যমন্ত্রীর বই সুপারিশ করে তা আমার কল্পনার বাইরে। পৃথিবীতে এর আগে কখনো এমন ঘটনা শোনা গেছে বলে আমার মনে হয় না।"