সাম্প্রতিককালে জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই৷ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এ নিয়ে লিখছেন৷ জঙ্গিবাদের মতো স্পর্শকাতর ও জরুরি বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক আমাদের নতুন ও সঠিক পথ দেখাবে বলেই আমার বিশ্বাস৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ সব আলোচনার বেশিরভাগই ভুল পথে যাচ্ছে৷ অনেকক্ষেত্রেই একে-অপরের উপর দায় চাপানোর যে দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি আমাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রয়েছে, তার এক ধরনের পুনরাবৃত্তি আমরা খেয়াল করছি৷ বাংলাদেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জঙ্গিবাদ বিস্তারের জন্য দায়ী করে বক্তব্য রেখেছেন৷ আমার কাছে মনে হয়, এ অভিযোগ নিয়ে আরো আলোচনা ও বিতর্ক প্রয়োজন৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জঙ্গিবাদের জন্ম দিতে পারে কিনা, জঙ্গিবাদের কতটুকু বিস্তৃতি ঘটাতে পারে বা জঙ্গিবাদ দমনে কী ভূমিকা রাখতে পারে – এ সব প্রশ্ন সামনে রেখেই এ আলোচনা চলতে পারে৷
বাংলাদেশে ধর্মকে আশ্রয় করে যে জঙ্গিবাদ – তার শুরু গত শতকের নব্বই দশকের শুরুর দিকে, আফগানিস্তান ফেরত যোদ্ধাদের হাত দিয়ে৷ পরবর্তীতে নানা পর্বে জঙ্গিবাদের যে বিস্তার ঘটেছে, তাতে মোটা দাগে কয়েকটি পরিবর্তন খেয়াল করা যায়৷ প্রথমদিকে জঙ্গিবাদ বলতেই মাদ্রাসা ছাত্র, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার কথা বলা হতো৷ এখন যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একতরফা দোষারোপ করা হচ্ছে, তেমনি তখন কওমি মাদ্রাসা মানেই ‘জঙ্গির আখড়া' – এমনটা শোনা যেত৷
সন্ত্রাস দমনে ইউরোপের প্রস্তুতি
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে সাম্প্রতিক কালেও একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে ইউরোপ৷ ইউরোপের একাধিক দেশে এমন পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত বিশেষ সন্ত্রাস-দমন বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
হামলার শিকার ইউরোপ
প্যারিস, ব্রাসেলস, নিস – ইউরোপের একের পর এক শহরের মানুষ ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে৷ শোক সামলে নেওয়ার পর বার বার প্রশ্ন উঠেছে, এমন হামলা কি প্রতিরোধ করা যেত? অথবা আরও জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া কি সম্ভব হতো?
ছবি: Reuters/E. Gaillard
জার্মানির ‘জিএসজি ৯’
বন শহরের কাছে জার্মানির বিশেষ কমান্ডো বাহিনী ‘জিএসজি ৯’-এর ঘাঁটি৷ সন্ত্রাস দমনের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইউনিট জার্মানিতে সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়, যেমনটা সম্প্রতি মিউনিখে দেখা গেছে৷ ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকের সময় ইসরায়েলি পণবন্দি নাটকের পর এই বাহিনী গঠন করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
অস্ট্রিয়ার ‘একো কোবরা’
অস্ট্রিয়ার কেন্দ্রীয় ফেডারেল পুলিশ বাহিনীর এই ইউনিট সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলার জন্য সর্বদা প্রস্তুত৷ জার্মানির মতোই অস্ট্রিয়াও মিউনিখ অলিম্পিকে হামলার পরও নড়েচড়ে বসে৷ ১৯৭৮ সালে প্রথমে ‘জিইকে’ নামের বাহিনী তৈরি হয়৷ ২০০২ সালে তার নাম বদলে রাখা হয় ‘একো কোবরা’৷
ছবি: Getty Images
ফ্রান্সের ‘জিআইজিএন’
ফ্রান্সের জাতীয় পুলিশ বাহিনীর বিশেষ ‘ইন্টারভেনশন ফোর্স’ সন্ত্রাসী হামলা, জিম্মি পরিস্থিতি, জাতীয় হুমকি ইত্যাদির সময় হস্তক্ষেপ করে৷ এই বাহিনী গঠনের পেছনেও কাজ করেছে ১৯৭২ সালে মিউনিখ হামলার ঘটনা৷ ১৯৭৪ সালে ‘জিআইজিএন’ বাহিনী গড়ে তোলা হয়৷
ফ্রান্সের আদলে ইটালিতেও ১৯৭৭ সাল থেকে এক ‘ইন্টারভেনশন ফোর্স’ সক্রিয় রয়েছে৷ সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে আকাশপথে দ্রুত মোতায়েন করা যায় এই বিশেষ বাহিনী৷ ভিআইপি-দের সুরক্ষার কাজেও লাগানো হয় এই বাহিনী৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
নেদারল্যান্ডস-এর ‘ডিএসআই’
২০০৬ সালে জাতীয় পুলিশ বাহিনীর ছত্রছায়ায় ‘ডিএসআই’ নামের এই বিশেষ ‘ইন্টারভেনশন ফোর্স’ গঠন করা হয়৷ সন্ত্রাসবাদ ও চরম হিংসার পরিস্থিতিতে এই বাহিনী দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে পারে৷ এর আগে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের প্রক্রিয়ার দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে এই ইউনিট গঠন করা হয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/M. Van Dijl
স্পেনের ‘ইউইআই’
স্পেনে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য ‘ইউইআই’ নামের ‘ইন্টারভেনশন ফোর্স’ কাজ করছে ১৯৭৮ থেকে৷ সন্ত্রাসবাদ থেকে শুরু করে জিম্মি নাটক – যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সামলাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এই ইউনিটকে৷ এই বাহিনী সম্পর্কে প্রকাশ্যে বেশি তথ্য প্রকাশ করা হয় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Saez
7 ছবি1 | 7
নতুন পর্বের জঙ্গিদের অনেকেই বেশ ধনী বা অবস্থাপন্ন পরিবার থেকে আসা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ও নামি-দামি, দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা৷ পরিবারের অবস্থা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিবর্তনের সাথে যোগ হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহারের পার্থক্য৷ নতুন পর্বের জঙ্গিরা টেক-স্যাভি, অর্থাৎ প্রযুক্তি ব্যবহারে বেশ পারদর্শী৷ নতুনদের প্ররোচনা, প্রচার, অর্থ জোগাড় ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তারা ইন্টারনেটকে ব্যবহার করছে৷
তবে নতুন পর্বের এই জঙ্গিদের নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলে আরেকটি বিষয় আমাদের বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন৷ গুলশানের ক্যাফেতে হত্যাকাণ্ড ও কল্যাণপুরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত জঙ্গিদের মধ্যে যেমন নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ বা মীর মোবাশ্বেরের মতো সমাজের উঁচু স্তরের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া তরুণরা ছিল, তেমনি তাদের সাথে মাদ্রাসা পড়ুয়া খায়রুল ইসলাম পায়েল বা সরকারি কলেজ থেকে পাশ করা শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বলও কিন্তু ছিল৷ জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত হিসেবে নাম এসেছে পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা নির্বিশেষে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের৷ নিজের পরিবার-পরিজন নিয়ে চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ারের মতো উচ্চ শিক্ষিত ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা দেশে ছেড়ে সিরিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এ যোগ দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ অর্থাৎ শুধু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে জঙ্গিবাদের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত করা বড় ধরনের ভুল হবে বলে আমি মনে করি৷ এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একাই জঙ্গিবাদ দমনে ও নিয়ন্ত্রণে আলাদাভাবে ভূমিকা রাখতে পারে কিনা – সে নিয়েও সন্দেহ রয়েছে৷ জঙ্গিবাদ একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা৷ তাই তা নিয়ন্ত্রণ ও দমনেও আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপের কথা ভাবতে হবে৷ আর এই সমন্বিত পদক্ষেপ নেবার জন্য প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে জঙ্গিবাদের কারণ ও জঙ্গি হয়ে ওঠার পেছনে ধাপগুলো কী কী৷
বিভীষিকার ১২ ঘণ্টা
ঢাকার গুলশানের আর্টিজান ক্যাফেতে দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার জিম্মি ঘটনার অবসান হলেও মানুষের মন থেকে আতঙ্ক যাচ্ছে না৷ এ ঘটনায় শুক্রবার রাতেই নিহত হয়েছে ২০ জিম্মি৷ নিহত হয়েছেন দুই পুলিশ কর্মকর্তাও৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
ঘটনার শুরু
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, শুক্রবার রাত পৌনে ৯টার দিকে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে একদল অস্ত্রধারী গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালালে অবস্থানরত অজ্ঞাত সংখ্যক অতিথি সেখানে আটকা পড়েন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু
পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে নিহত হন বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ১৩ জিম্মিকে জীবিত উদ্ধারের পাশাপাশি ছ'জন হামলাকারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ বলেছেন, বাকি কয়েকজনকে হয়তো বাঁচানো যায়নি৷ এই জঙ্গি হামলায় জড়িত একজন ধরা পড়েছে বলেও শনিবার সকালে এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন তিনি৷
ছবি: Reuters
এ যেন দুঃস্বপ্ন
কমান্ডো অভিযানে মুক্ত গুলশানের ক্যাফে থেকে উদ্ধার পাওয়া ব্যক্তিদের ১২ ঘণ্টার ‘দুঃস্বপ্ন’ কাটছে না৷ তাঁদের চোখে মুখে ক্লান্তি ও ভীতির ছাপ৷ তারা বলছিলেন, কয়েকজনের মৃতদেহ দেখেছেন, অনেক জায়গায় রক্তের ছাপ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য
তাঁরা বলছেন, জিম্মিকারীরা বাংলাদেশি মুসলমানদের সুরা পড়তে বলে৷ সুরা পড়তে পারার পর তাঁদেরকে রাতে খেতেও দেওয়া হয়৷ যাঁরা হিজাব পরা ছিল, তাঁদের বাড়তি খাতির করা হয়৷
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/S. K. Das
আইএস-এর দায় স্বীকার
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে বলে সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ জানিয়েছে৷ এই জঙ্গি দলের মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সির বরাত দিয়ে এ সব খবরে দাবি করা হয় যে, ‘তাদের’ এই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪০ জন৷
ছবি: picture-alliance/abaca
কমান্ডো অভিযান
সকাল ৭ টা ৩০ মিনিটে রাতভর গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন এলাকা ঘিরে রাখার পর যৌথ সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়৷ ৮ টা ১৫ মিনিটে প্রথম দফায় নারী ও শিশুসহ ৬ জনকে উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ভবনের নিয়ন্ত্রণ ও আতঙ্কের অবসান
৮ টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা৷ গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে৷ ৯ টা ১৫ মিনিটে ১২ ঘণ্টার রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়৷
ছবি: Getty Images/M. H. Opu
8 ছবি1 | 8
জঙ্গিবাদের কারণ
জঙ্গিবাদের কারণের তিনটি পর্যায় রয়েছে বলে আমি মনে করি৷ প্রথমত, ব্যক্তি পর্যায়ে নানা কারণে একজন জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে৷ হতাশা, নিজেকে তুচ্ছ মনে করা ও নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, নিজের একটি আলাদা পরিচয় নির্মাণ করা ও জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা থেকেও অনেকের জঙ্গিবাদের প্রতি আকর্ষণ শুরু হয়৷ আইএস বা আল-কায়েদার মতো সংগঠন তরুণদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি, ভ্রান্ত মতবাদ দিয়ে তারা একটি ‘মহান' কাজের অংশ হতে যাচ্ছে, এই অনুভূতি দেয়৷ অনেক সময় ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, রাষ্ট্রের নিপীড়নও একজনকে জঙ্গিবাদের পথে ঠেলে দিতে পারে৷ এছাড়া প্রযুক্তির এই যুগে ইন্টারনেটে নানা উগ্রবাদী মতবাদের উপকরণও রয়েছে৷ এসব অনুসরণ করে নিজে নিজেও অনেকে জঙ্গি হয়ে ওঠে৷ তারুণ্যের সাথে উত্তেজনা ও অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানের একটি যোগাযোগ রয়েছে৷ সেই উত্তেজনার বশে এ সব জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে ধার্মিক না হয়েও ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার ব্রত নিয়ে হত্যাকাণ্ড ও নিষ্ঠুরতাকে বৈধতা দেয় এ সব জঙ্গিরা৷
দ্বিতীয় পর্যায়টি সামাজিক৷ কেউ যদি মূলধারার সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে, তবে সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে৷ বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে, দুইটি রাজনৈতিক জোট একে-অপরের প্রতি যে হিংসাত্মক ও সহিংস মনোভাব পোষণ করে, তা গণতন্ত্রের প্রতি অনেকের অনাস্থা পোষণের কারণ হয়ে ওঠে৷ জঙ্গি সংগঠনগুলো একটি ‘স্বপ্নের দেশের' প্রতিশ্রুতি দেয়৷ তাই শরিয়া প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা মনে করে জঙ্গিরা সহিংস কাজে জড়িয়ে পড়ে৷
তৃতীয় পর্যায়টি আন্তর্জাতিক৷ পশ্চিমা-বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান ও মানবিক বিপযর্য়ের নানা উদাহরণ অনেকের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে৷ ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও কাশ্মীরে মুসলমানদের উপর নির্যাতনের বিভিন্ন খবর নানাভাবে বাংলাদেশে প্রচার করা হয়৷ বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয় এক ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে৷ শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে সে নিগৃহীত হতে হচ্ছে – এই অনুভূতি অনেককেই উগ্রপথে টেনে নিয়ে যেতে পারে৷ তখন পশ্চিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার একটি উপায় খুঁজতে গিয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর দেখানো সহিংস পথ বেছে নেয় এবং হামলায় অংশ নেয়াকে একটি জিহাদি দায়িত্ব বলে মনে করে এ সব জঙ্গিরা৷ অনলাইনে এবং অফলাইনে এ সব বিষয়ে জঙ্গিপন্থি হাজার রকমে বক্তৃতা শুনে ও বিভিন্ন ফোরামে আলোচনায় অংশ নিয়েও অনেকে জঙ্গিতে পরিণত হয়৷
ধর্মের রাজনীতি ও তরুণ প্রজন্ম
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎসাহ, উদ্বেগ দুই-ই আছে৷ আর সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দল ও ইসলামপন্থিদের উত্থানের বিষয়টিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ৷ ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে কী ভাবছে আজকের প্রজন্ম?
ছবি: Reuters
পিয়ান মুগ্ধ নবীর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়ান মুগ্ধ নবীর কাছে ধর্ম বিষয়টা পুরোপুরি ব্যক্তিগত হলেও রাজনীতি ব্যক্তিগত বিষয় নয়৷ তবে ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে তিনি কখনোই সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
শিবরাজ চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শিবরাজ চৌধুরী৷ তার মতে, ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ ধর্মের মূল বিষয় মনুষত্ব বা মানুষের মধ্যকার শুভবোধ৷ তবে ধর্মের নামে যদি কখনো মৌলবাদ কিংবা চরমপন্থা চলে আসে, সেটা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়৷
ছবি: DW
শিহাব সরকার
ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী শিহাব সরকার৷ তার মতে, ধর্ম ধর্মের জায়গায় আর রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়৷ বলা বাহুল্য, ধর্মের নামে রাজনীতি তিনিও সমর্থন করেন না৷
ছবি: DW
আসিফ হামিদী
আসিফ হামিদীও মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন৷ তিনিও মনে করেন ধর্ম এবং রাজনীতি কখনোই এক হতে পারে না৷ তাই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘোর বিরোধী তিনি৷
ছবি: DW
মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর
ঢাকার একটি মাদ্রাসা থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন মুহাম্মদ হুমায়ূন কবীর৷ তাঁর মতেও রাজনীতি ধর্মভিত্তিক হতে পারে না৷ তবে আল্লাহ এবং রাসুলের কিংবা ইসলামের উপর কোনোরকম আঘাত আসলে তার বিরোধীতা করা সব মুসলমানের নৈতিক দ্বায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW
সাদমান আহমেদ সুজাত
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদমান আহমেদ সুজাত৷ তাঁরও ঐ এক কথা৷ ‘‘ধর্ম এবং রাজনীতি কখনো এক হতে পারে না৷’’ তিনি জানান, ‘‘ধর্ম আমরা সাধারণত জন্মগতভাবে পাই, কিন্তু রাজনীতিকে আমরা অনুসরণ করি৷’’
ছবি: DW
সাজ্জাদ হোসেন শিশির
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন শিশির৷ তাঁর মতে, রাজনীতি সবসময়ই ধর্ম নিরপেক্ষ হওয়া উচিত৷ তাঁর বিশ্বাস, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে ফেললে তার ফল কখনো ভালো হয় না৷
ছবি: DW
দাউদুজ্জামান তারেক
ঢাকার আরেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দাউদুজ্জামান তারেক মনে করেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কখনো মিল হতে পারে না৷ কারণ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা একই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসরণও করতে পারেন৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
জঙ্গিবাদের পাঁচটি ধাপ
একজন আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ তরুণ যখন জঙ্গি হামলায় অংশ নেয়, তখন অনেককেই অবাক হতে দেখা যায়৷ বাংলাদেশে সাম্প্রতিকতম হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের পরিবার ও বন্ধুরা হামলাকারীদের ‘স্বাভাবিক' হিসেবে বর্ণনা দিয়েছে৷ কেউ গিটার বাজিয়ে গান গাইতো, কেউ ফুটবল খেলতো, কেউ বা বলিউডের কোনো অভিনেত্রীকে পছন্দ করতো৷ প্রশ্ন হলো, এ ধরনের ‘সহজ', ‘স্বাভাবিক' তরুণ থেকে তারা কীভাবে জঙ্গিতে পরিণত হয়?
জঙ্গি হবার পেছনে আসলে কয়েকটি ধাপ থাকে৷ বেশিরভাগ সময় কারো সহযোগিতায় বা প্রভাবে একজন জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হতে পারে৷ আবার নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জঙ্গি হামলা চালানোর ঘটনাও ঘটার সম্ভবনা আছে৷ আর সবাই চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছে জঙ্গি হামলকারী নাও হতে পারে৷ অর্থাৎ প্রথম কয়েকটি ধাপ থেকে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও আসতে পারে কেউ কেউ৷
প্রথম ধাপ: হতাশা, বৈষম্য ও অবিচার অনুভব করা
দ্বিতীয় ধাপ: এর সমাধান কী হতে পারে তা খোঁজা এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা
তৃতীয় ধাপ: উগ্র হয়ে মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে পড়া
চতুর্থ ধাপ: উগ্র মতবাদে আরো শক্তিশালী হয়ে ‘আমরা' বনাম ‘তারা' পরিচয় নির্মাণ ও শত্রু চিহ্নিতকরণ
পঞ্চম ধাপ: হামলায় অংশ নেয়া
তাই আমার মতে, জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করতে হলে শুধু শেষ ধাপটি প্রতিরোধ করলে হবে না৷ বরং প্রথম থেকেই এর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে৷
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও জঙ্গিবাদ
দুঃখের বিষয় হলো জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে বাংলাদেশে শুধু ‘হার্ড পাওয়ার' ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এর অংশ হিসেবে নিরাপত্তা ও নজরদারি জোরদার করা হয়েছে৷ ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে অস্ত্র উদ্ধারের নামে মারা যাচ্ছে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা৷ প্রশ্ন হলো, এই বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা, অব্যাহত নজরদারি ও নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি কি জঙ্গি দমনের জন্য যথেষ্ট? আমাদের মনে রাখতে হবে, জঙ্গিরা কিন্তু বেশ সাফল্যের সাথেই ‘সফট পাওয়ার' ব্যবহার করছে৷ তারা তাদের উগ্র মতবাদ, ‘প্রপাগান্ডা' ও ‘ন্যারেটিভস' অনলাইন ও অফলাইনে ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ জঙ্গিবাদের সাথে যেখানে মনোজাগতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইমোশনাল সংযোগ রয়েছে, সেখানে শুধু নিরাপত্তা ও নজরদারির মাধ্যমে তা মোকাবিলা করা কি আদৌ সম্ভব?
সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো শিক্ষার্থী পরপর তিনটি ক্লাস বা পরপর দশদিন অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষকদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া শিক্ষকদের ও কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের উপর কড়া নজরদারি চালানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড চালানো শুরু হবে এ মন কথাও শোনা যাচ্ছে৷ অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্র সংগঠনগুলোর নানা উজ্জ্বল অবদান রয়েছে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ সব ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক আদর্শ ও ছাত্রদের কল্যাণের চেয়ে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, কোন্দল ও সন্ত্রাসেই তাদের ভূমিকা রেখেছে বেশি৷ তাই ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির – যে ছাত্রসংগঠনই হোক না কেন, তারা জঙ্গি দমনে ভূমিকা রাখবে না সন্ত্রাসের নতুন পরিসর তৈরি করবে – তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্লগারদের উপর বিভিন্ন হামলায় মাদ্রাসা এবং সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার কথা বলছে গোয়েন্দারা৷ এই নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মহলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে
২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি বা এনএসইউ-এর পাঁচ ছাত্র৷ তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়৷ এরা সকলেই ছিল আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মগজ ধোলাই
ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের ভুলিয়েভালিয়ে দলে নিচ্ছে জঙ্গিরা, এমন ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিতরা তাই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের জন্য আগামীতে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করার কথাও ভাবছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
আছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট-এর ছাত্র মোহাম্মদ নুরউদ্দনি এবং আবু বারাকাত মোহাম্মদ রফকিুল হাসান হাসানকে বুয়েট থেকে বহিষ্কার করে পুলিশে দেয়া হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
হিযবুত তাহরীরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববদ্যিালয়ের আইবিএ-র শিক্ষক ছিলেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও রয়েছে
কওমি মাদ্রাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের কারখানা বলা হতে একসময়৷ সেই বাস্তবতা মুছে যায়নি৷ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আটক দু’জন নিজেদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থী দাবি করেছেন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid
সতর্ক পুলিশ
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এবং জঙ্গি বিষয়ক বিশেষ সেলের সদস্য সানোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের একাংশ এখন জঙ্গি তৎপরতার দিকে ঝুঁকছে৷ আর যারা অপারেশনে অংশ নিচ্ছে, তারাও বয়সে তরুণ এবং ছাত্র৷''
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
6 ছবি1 | 6
উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, জঙ্গিবাদের কারণ বিভিন্ন ও নানা দিকে বিস্তৃত৷ এটি কোনো সহজ-সাধারণ বিষয় নয়৷ তাই শুধু একটি চালক বা কারণ দিয়ে জঙ্গিবাদকে বিশ্লেষণ করা যাবে না৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যাঁরা জঙ্গিবাদের সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে যে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একা জঙ্গিবাদের জন্ম দেয় না৷ তাই তারা একা তা দমনও করতে পারে না৷ যেসব বুদ্ধিজীবী ‘বড় মাঠের অভাব' অথবা ‘দেশপ্রেম আর দেশের ইতিহাস সম্পর্কিত শিক্ষার' অভাবের সাথে জঙ্গিবাদের উত্থান মিলাচ্ছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে শিক্ষা দুই ধরনের৷ ‘ফর্মাল' বা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আমরা পাই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে৷ আবার ‘ইনফর্মাল' বা অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা আমরা পাই বিভিন্ন আলোচনা, টেলিভিশন অনুষ্ঠান, সংবাদপত্র, বই, ম্যাগাজিন, পরিবার ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে৷ তাই জঙ্গিবাদের বিস্তারের পেছনে যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দায়ী থাকে, তবে ইনফর্মাল শিক্ষার আধার, যেমন বিভিন্ন মিডিয়া ও সুশীল সমাজও এই দায় এড়াতে পারে না৷
আমি মনে করি, শিক্ষা একটি ‘ডাবল এজড সর্ড' – যা জঙ্গিদের পক্ষে যেমন কাজে লাগানো যায়, তেমনি বিপক্ষেও কাজে লাগানো যায়৷ শিক্ষার মাধ্যমে কাউকে ‘ইনডকট্রিনেট' করে উগ্রপন্থায় ঠেলে দেয়া সম্ভব, একটি নির্দিষ্ট মতবাদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তৈরি করা সম্ভব৷ আবার ঠিকমত প্রস্তুতি নিলে শিক্ষা দিয়েই জঙ্গিবাদকে কমানো যায়৷ জঙ্গিবাদের ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে শক্ত কাউন্টার ন্যারেটিভও দাঁড় করানো যায়৷ এই লড়াই মনোজাগতিক৷ তাই নিরাপত্তা ও নজরদারির পাশাপাশি দরকার জঙ্গিবাদের কারণগুলো নির্মূল করা৷ সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিরতা তৈরি করা যেন বৈষম্য, হতাশা ও অবিচারের ঘটনা কম ঘটে৷
আইএস কী, কোথায় এবং কেন?
প্রতিদিনই খবরে আইএস৷ কোনোদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য, কোনোদিন হয়তো ইরাক বা সিরিয়ায় কোনো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য৷ আইএস বলছে, ইসলামি খেলাফত কায়েম করার জন্য যুদ্ধে নেমেছে তারা৷ ছবিঘরে আইএস সম্পর্কে কিছু তথ্য....
ইসলামিক স্টেট বা আইএস আসলে কী?
আল কায়েদা থেকে তৈরি হওয়া সুন্নি মুসলমানদের জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ সাদ্দাম পরবর্তী সময়ে ইরাকে এবং বাশার আল আসাদের আমলে সিরিয়ায় সুন্নিদের হতাশা থেকেই জন্ম সংগঠনটির৷ আইএস-এর পতাকায় লেখা থাকে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নবী’ এবং ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই৷’
ছবি: AP
আইএস কোথায় সক্রিয়?
শরিয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে এমন রাষ্ট্র, বা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় আইএস৷ সিরিয়া এবং ইরাকেই প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় তারা৷ দুটি দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে বেশ বড় অঞ্চল দখল করে নিয়েছে আইএস৷
আইএস কেন আলাদা?
মূলত নিষ্ঠুরতার জন্য৷ শত্রুপক্ষ এবং নিরীহ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াতে তারা এমন বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যা আগে কেউ করেনি৷ জবাই করে ভিডিও প্রচার, পুড়িয়ে মারা, বাবার সামনে মেয়েকে জবাই করা এবং তার তার ভিডিও প্রচার, মেয়েদের যৌনদাসী বানানো আর পণ্যের মতো বিক্রি করা – এসব নিয়মিতভাবেই করছে আইএস৷ কোনো অঞ্চল দখলে নেয়ার পর সেখানে শাসন প্রতিষ্ঠায় মন দেয় আইএস৷
ছবি: gebphotography - Fotolia.com
অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক
আইএস যদিও শুধু সিরিয়া এবং ইরাকেই সক্রিয়, তবে বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়৷ নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম কয়েকদিন আগেই জানিয়েছে, আইএস-কে তারা সমর্থন করে৷ দুটি সংগঠনের মধ্যে একটি জায়গায় মিলও আছে৷ আইএস-এর মতো বোকো হারামও নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে৷ অন্য ধর্মের নারীদের প্রতি দুটি সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণই মধ্যযুগীয়৷
ছবি: Getty Images/A. Katib
আইএস-এর অনুসারী কারা?
অনুসারী সংগ্রহের সাফল্যেও আইএস অন্য সব জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে আলাদা৷ এ পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার বিদেশী যোদ্ধা আইএস-এ যোগ দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে ৪ হাজারই পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর অ্যামেরিকার৷
আইএস-কে রুখতে অন্য দেশগুলো কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেশ কিছু পশ্চিমা এবং আরব দেশ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটির ওপর বিমান থেকে বোমা হামলা চালাচ্ছে৷ বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সিরিয়ায় ১৪২২ এবং ইরাকে ২২৪২ বার হামলা হয়েছে৷ কোনো কোনো সরকার দেশের অভ্যন্তরেও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ সিরিয়া ফেরত অন্তত ৩০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির বিচার শুরু করবে জার্মানি৷ গত মাসে সৌদি পুলিশও ৯৩ জন সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
6 ছবি1 | 6
তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নাগরিক অধিকার, বৈচিত্রের প্রতি সম্মান, অন্য জাত, মত ও পথের প্রতি সম্মান করা শেখাতে হবে৷ বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত লাভজনক ব্যবসা ও বাণিজ্য শিক্ষা শুধু নয়, সামাজিক বিজ্ঞান ও লিবারেল আর্টসের প্রতি জোর দেয়া৷ ট্রেনিং, স্কিল ডেপেলপমেন্ট বা শুধু কেরিয়ারের জন্য শিক্ষা পয়সা কামাতে শিখায়, জীবন সম্পর্কে ধারণা দেয় না, ক্রিটিক্যাল থিংকিং বা প্রশ্ন করতে শেখায় না৷ তাই সাধারণ শিক্ষা জঙ্গিবাদ দমন করতে পারবে না৷ শিক্ষাব্যবস্থা সেক্যুলার হলেও ততক্ষণ তা উগ্রপন্থা দমনে সাহায্য করতে পারবে না, যতক্ষণ না তা শিক্ষার্থীদের উদারতা ও বৈচিত্রের সাথে সন্ধি করতে শেখায়৷ আমাদের সময় এসেছে শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে, ‘পেডাগজি' নিয়ে চিন্তা করার৷ শিক্ষককেন্দ্রিক নয়, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার৷ নিজের পরিচয় নির্মাণ, ক্রিটিক্যাল থিংকিং বাড়ানো ও শিক্ষার্থীদের ‘প্রশংসার' জায়গা শিক্ষা কার্যক্রমে রাখতে হবে৷ আর সেই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের দর্শক বা শ্রোতা নয়, অংশগ্রহণকারী করে তুলতে হবে৷
জঙ্গিবাদ দমন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া৷ সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের তা দমন করতে হবে৷ আমাদের মনে রাখা উচিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একাই সব সমস্যার মূলেও নয়, সর্ব রোগের ওষুধ বা প্যানাশিয়াও নয়৷