মানুষের সঙ্গে আশ্চর্য মিল রয়েছে এইপ বা শিম্পাঞ্জি ও গরিলাদের৷ অথচ এটাই সত্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মতো জার্মান চিড়িয়াখানায় এলে তাদের চরম দুরবস্থাই চোখে পড়ে৷ এ সব কারণে পশু অধিকারের বিষয়টি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে৷
বিজ্ঞাপন
বার্লিনের চিড়িয়াখানায় বিশ্বের দ্বিতীয় প্রবীণতম গরিলা ৫৭ বছর পূর্ণ করছে৷ চিড়িয়াখানাটির জন্য এটা একটা উত্সবের বিষয় বৈকি৷ শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং-ওটাংকে এইপ বলা হয়৷ হোমো গ্রুপের মধ্যে না পড়লেও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মানুষের সঙ্গে অদ্ভুত মিল রয়েছে তাদের৷
জিনের মধ্য অনেক মিল
মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জিনের মধ্যে ৯৩.৫ থেকে ৯৯.৪ শতাংশ মিল রয়েছে৷ এছাড়া শিম্পাঞ্জিদের চিন্তা করার ক্ষমতা রয়েছে৷ রয়েছে আগে থেকে পরিকল্পনা করার দক্ষতা ও দুঃখের অনুভূতি৷
গবেষক জেইন গুডঅল হলেন একমাত্র মানুষ, যিনি শিম্পাঞ্জি সমাজে গৃহীত হয়েছিলেন৷ ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত তিনি তাদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করেছেন৷ তারাও চুম্বন দিয়ে থাকে৷ আলিঙ্গন করে থাকে৷ পারস্পরিক সম্পর্কের দিক দিয়ে মানুষের সঙ্গে আশ্চর্য রকমের মিল রয়েছে৷
কিন্তু চিড়িয়াখানাগুলিতে তাদের যেভাবে রাখা হয় তা রীতিমত দুঃখজনক৷ জার্মানির ৩৮টি চিড়িয়াখানায় ৪৩০টি এইপ রয়েছে৷ পশুপালন আইন অনুযায়ী তাদের রাখার কথা৷ কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ কাজ নয়৷
বাইরের চত্বরের বেড়াটা ৫০০ বর্গমিটার হওয়ার কথা৷ কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই এটা ২০০ বর্গমিটার৷ এছাড়া ভেতরের খাঁচায়, অনেক সময় আলাদা খাঁচায়, মানসিক সমস্যাগ্রস্ত কোনো কোনো গরিলাকে রাখা হয়৷ অনেকটা ‘একক সেলে' আবদ্ধ করে রাখার মতো৷
কুকুরও আমাদেরই মতো প্রাণী
কুকুর জার্মানদের কাছে বেশ আদরের৷ অনেক জার্মানই শখ করে বাড়িতে বিভিন্ন জাতের কুকুর পোষেন৷ তবে জার্মানির হাইডেলব্যার্গের একটি সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, জার্মানিতে কুকুর পোষেন বিত্তবান লোকেরা৷
ছবি: AP
রোদ দেখে কুকুরও আনন্দিত
কুকুর যে খুবই প্রভুভক্ত গৃহপালিত পশু তা আমাদের সকলেরই জানা৷ তবে কুকুর শুধু গৃহপালিত পশু নয়, জার্মানিতে কুকুরকে প্রাণী হিসেবেই ভাবা হয়৷ আর তারই কিছু নমুনা দেখা যাক আজকের এই ছবিঘরে ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিত্তবানেরাই কুকুর পোষেন
অনেক জার্মানই শখ করে বাড়িতে বিভিন্ন জাতের কুকুর পোষেন৷ তবে জার্মানির হাইডেলব্যার্গের একটি সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, জার্মানিতে কুকুর পোষেন বিত্তবান লোকেরা৷ এই চকচকে বিশাল কুকুরটির ওজন ১১১ কেজি৷ মাসে ৫০ কেজি খাবার খায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কুকুরের সেলুন
কুকুরকে চুল কাটার জন্য সেলুনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ যেন যেখানে সেখানে চুল না পড়ে যায় এবং ওকে দেখতেও যেন কুকুরের মালিকের মতোই ফিটফাট মনে হয়৷ এদেশে কখনো রাস্তায় কুকুরকে মালিক ছাড়া দেখা যায়না৷ গৃহপালিত কুকুর পথচারী বা বা অন্য কাউকে কামড় দেয়না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কুকুরও দেশের জন্য কাজ করে
কুকুর যে শুধু পরিবারের সাথেই থাকে, তাদের সঙ্গ দেয় তা নয়৷ ট্রেনিংপ্রাপ্ত কুকুরও আছে, যেগুলো অবৈধভাবে টাকার নোট পাচারকারীদের ধরিয়ে দিতে সরকারকে সাহায্য করে৷ এই ছবিটি ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরেররই একটি দৃশ্য, যাতে পাঁচশো টাকার নোট পাচারকারী ধরা পড়েছে, বুদ্ধিমান কুকুরটির সাহায্যে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কুকুর পালুন/ফিট থাকুন
বাইরে যে আবহাওয়াই থাকুক না কেন, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কুকুরকে দিনে কয়েকবার বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে হয়৷ এদেশে অতিরিক্ত ওজনের মানুষদের ওজন কমানোর জন্য অনেক সময় ডাক্তাররাও কুকুর পোষার পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷ তখন তাকে কুকুরের জন্য হলেও বাইরে বের হতেই হবে, হাঁটতে হবে৷
ছবি: Maksim Nelioubin
কুকুরেও চাই বিনোদন
নিজে যে শুধু গরম পোশাক পরেন তাই নয়, প্রচণ্ড শীতের সময় প্রিয় কুকুরটিরও যেন কষ্ট না হয় তাই ওকেও গরম পোশাক পরিয়ে নিয়ে যান গাড়িতে করে হাওয়া খেতে৷ ঠিক যেন পরিবারের একজন সদস্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
কুকুরের রেস্তোরাঁ
কুকুরের মন-মেজাজ ভালো রাখতে মাঝে মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় ওদেরই জন্য তৈরি বিশেষ রেস্তোরাঁতে৷ যেখানে কুকুর নিজের খাবার নিজেই পছন্দ করতে পারে তার ব্যবস্থা রয়েছে৷ কুকুরের জন্য আলাদা রেস্তোরাঁ, হোটেল, স্কুল, সেলুন, দোকান, গোরস্থান সবই রয়েছে৷
ছবি: picutre-alliance/dpa
মা আর সন্তান
মা বলে কথা! আদর করে মুখে তুলে খাওয়াতেই যেন আনন্দ৷ নিঃসন্তান এই মাকে কুকুরটিই দিয়েছে সন্তানের ভালোবাসা৷ মা’কে কিছুক্ষণ না দেখলেই অস্থির হয়ে পড়ে৷ মা বাইরে থেকে ফিরে এলে লাফিয়ে কোলে ওঠে নয় তো লেজ নেড়ে তার আনন্দ প্রকাশ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিয়মিত ডাক্তারের চেম্বারে
কুকুরকে চেকআপের জন্য নিয়মিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়৷ রাস্তায় কোন কুকুর কখনো কোন পথচারীকে কামড় দিয়েছে, একথা সহজে শোনা যায়না৷ কুকুর সেভাবেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত৷ কুকুরে জন্যও রয়েছে স্বাস্থ্যবীমা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কুকুরের খেলনার দোকান
কুকুরের খেলনা বা ব্যবহারযোগ্য জিনিসের দোকান৷ এখানে প্রায় বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেই কুকুর বা বেড়ালের টিনজাত খাবারের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে৷
ছবি: DW/V.Weitz
গর্বিত মা
তিন জাতের তিন কুকুরের গর্বিত পালক মা৷ এই কুকুরগুলোই তার গর্ব৷ শুধু তাই নয়, মা মহিলাটি গর্ব করে বলেন ওরা শুধু তার সন্তান নয়, তাঁর বডিগার্ডও বটে৷ কারণ তাঁর বিশাল বাড়িতে এই তিন সন্তানদের নিয়েই থাকেন তিনি৷ বাড়ির দেয়ালে ওদের ছবি টাঙানো৷ হাতব্যাগেও থাকে ওদেরই ছবি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
একই পরিবারের সদস্য
একটি সাধারণ কুকুরের মূল্য কিন্তু ২০০ ইউরোর কম নয়৷ তবে কুকুরের জাত বুঝে কয়েক হাজার ইউরোও হতে পারে৷ তাছাড়া একটি কুকুরের জন্য মাসে যে পরিমাণ টাকা খরচ করা হয়, সে টাকায় সহজেই একটি বাচ্চাও বড় হতে পারে৷ আর এরা ঠিক যেন ৬টি সন্তান ! একইসাথে বেড়ে উঠছে৷
ছবি: AP
12 ছবি1 | 12
অবস্থা অত্যন্ত করুণ
মনস্তত্ত্ববিদ ও পশু অধিকারবাদী ড. কলিন গল্ডনার এক বছর ধরে (৬০০ ঘণ্টা) জার্মান চিড়িয়াখানায় এইপগুলিকে কীভাবে রাখা হয়েছে, তা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন৷ মাঝে মাঝে ছদ্মবেশেও এই কাজটি করতে হয়েছে তাঁকে৷ কেননা পরিচয় জানতে পারলে সবসময় একজন চিড়িয়াখানার কর্মী থাকতেন তাঁর সঙ্গে৷ একবার তো এক চিড়িয়াখানা থেকে বেরও করে দেওয়া হয় এই গবেষককে৷
তাঁর গবেষণার ফলাফল – বেশিরভাগ চিড়িয়াখানায় এইপদের অবস্থা ‘মন্দ থেকে চরম দুর্দশাগ্রস্ত'৷ ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড' বইটিতে বিশদভাবে এ সম্পর্কে লিখেছেন ড. কলিন৷ একটি চিড়িয়াখানায় এমনভাবে ৪১টি শিম্পাঞ্জিকে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে, যা কল্পনা করা যায় না৷ তাদের জন্য বরাদ্দ করা খাঁচাটির আয়তন মাত্র ২২০ বর্গমিটার৷
ওষুধ দিয়ে শান্ত রাখা হয়
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন এই মনস্তত্ত্ববিদ৷ আর তা হলো অনেক প্রাণীকে ওষুধ দিয়ে শান্ত করে রাখার প্রবণতা৷ ক্লিনিক্যাল মনস্তাত্ত্বিক হিসাবে ড. কলিন অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে লক্ষ্য করেছেন এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া৷ ডিপ্রেশন নিরাময়ক ওষুধ অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস দিয়ে রাখা হয় এইপগুলিকে৷ অথচ এটা আসলে মানুষের জন্য তৈরি ওষুধ৷
চিড়িয়াখানায় অনেক পশুই বিষন্নতা, আক্রমণাত্মক মনোভাব, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা ইত্যাদিতে ভোগে৷ ‘‘আর তাই চিড়িয়াখানায় তাদের টিকিয়ে রাখার জন্য অধিকাংশ প্রাণীকেই ওষুধ দিয়ে রাখা হয়,'' বলেন ড. কলিন৷
‘গ্রেট এইপ' প্রকল্প
এইসব প্রাণীর দুরবস্থা দূর করার ব্যাপারে পশু অধিকারবাদীরা উদ্যোগ নিয়েছেন৷ ২০১১ সালে জার্মানিব্যাপী একটি ‘গ্রেট এইপ প্রকল্প' যাত্রা শুরু করেছে৷ এতে বলা হয়েছে মানুষের মৌলিক অধিকার এইপদের অধিকার পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে৷ মূল দাবি হলো, ‘‘এইপদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, বাঁচার অধিকার ও শারীরিক অখণ্ডতা সংরক্ষিত করতে হবে৷''
গবেষণার প্রয়োজনে এই প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হত্যা করা কিংবা তাদের আবাসস্থল ধ্বংস করা নিষিদ্ধ করতে হবে৷ অবশ্য পশু অধিকারবাদীরা এব্যাপারে সচেতন যে, মানুষ ও বনমানুষের মধ্য পার্থক্য রয়েছে৷ কিন্তু তবু তাদেরও সম্মানজনকভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে৷