শিলচরের এনআইটি থেকে বরখাস্ত পাঁচ বাংলাদেশের ছাত্র
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তর্ক থেকে শুরু হওয়া বিবাদ, সহপাঠীদের ওপর হামলা এবং হোস্টেলে মাদক সেবনের অভিযোগে আসামের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এনআইটি) শিলচর থেকে পাঁচজন বাংলাদেশি ছাত্রকে বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। এবার তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে এবং সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
৮ সেপ্টেম্বর রাতে এনআইটি'র হোস্টেলের ভেতরে বাংলাদেশি ছাত্রদের একাংশের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনার জেরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তর্ক-বিতর্ক ধীরে ধীরে হাতাহাতি ও মারপিটে গড়ায়। এসময় অন্যান্য ছাত্ররা হস্তক্ষেপ করতে এলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
বচসা, মারপিঠ ও পরে মাদক উদ্ধার
প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর, অধ্যাপক দিলীপ কুমার বৈদ্য জানিয়েছেন, তৃতীয় বর্ষের ছাত্ররা ৮ সেপ্টেম্বর রাতে ক্যাম্পাসে প্রচন্ড মারপিট করে এবং পরবর্তীতে তাদের হোস্টেল কক্ষে নিষিদ্ধ মাদক পাওয়া যায়। এরপর প্রতিষ্ঠানের তরফে তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বৈদ্য জানিয়েছেন, এরা সবাই ভারত সরকারের ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস (আইসিসিআর) স্কলারশিপ-য়ের আওতায় ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তায় এখানে পড়াশোনা করছে। তিনি বলেন, "এদের বিরুদ্ধে অতীতে অনেক অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে তাদের দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অনেকেই এখানে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করেছে। কেউ কেউ নিজেদের বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের লোক বলে, আবার কেউ কেউ অতীতের সরকারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে। তাদের তর্ক থেকে ঝগড়া বহুবার মারামারি পর্যন্ত গেছে। তবে তাদের ব্যক্তিগত ঝগড়াকে আমরা গুরুত্ব দিইনি। ৮ সেপ্টেম্বর যেটা ঘটেছে সেটা একসময় ভয়ংকর রূপ নেয়। তারা হাতে অস্ত্র নিয়ে অন্যদের ধাওয়া করেছে এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে মারপিট করেছে। এই ঘটনার পর্যাপ্ত প্রমাণ পেয়েছি আমরা। তদন্তের পর প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসাবে দুই সেমিস্টারের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে তাদের। সঙ্গে হোস্টেল থেকেও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
তিনি জানান, যেহেতু তারা এক বছর এখানে পড়াশোনা করতে পারবে না এবং হোস্টেলেও থাকতে পারবে না, তাই এই ক্যাম্পাসে বা এই দেশে থাকার তাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমরা বিষয়টি কেন্দ্র সরকারের কাছে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এদের শীঘ্রই নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান
ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীরা জানায়, ঘটনাটি ঘটে গত ৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার পর। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই রাতে তৃতীয় বর্ষের পাঁচ জন বাংলাদেশি ছাত্র মাদকাসক্ত অবস্থায় সহপাঠীদের ওপর চড়াও হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাত্রের বক্তব্য, "তাদের হাতে লোহার রড, ছুরি, স্ক্রু-ড্রাইভার ইত্যাদি ছিল। প্রথমে নিজেদের ব্যাচের কয়েকজনকে মারধর করে। পরে চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্ররা ঘটনাস্থলে গেলে তাদেরও টার্গেট করা হয়।"
আরেক ছাত্রের বয়ান, সিনিয়ররা হস্তক্ষেপ করলে অভিযুক্তরা আলোচনার নামে তাদের একটি ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। এখানে হঠাৎ আলো নিভিয়ে দিয়ে আচমকা অস্ত্র হাতে ফের হামলা শুরু হয়। টানা আধঘণ্টা ধরে হামলা চলে। আহত ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজনকে দ্রুত শিলচর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে দুই জন গুরুতর মাথায় আঘাত পেয়েছিল।"
এনআইটির ডিন অব স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার এসএস ধর জানান, মূলত মারপিট করার কারণেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে অভিযুক্তদের হোস্টেল ঘরে মাদক উদ্ধার হওয়ার অভিযোগ সত্য। তিনি বলেন, "আমরা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের হোস্টেল কক্ষে গেছি এবং সেখানে নিষিদ্ধ মাদক পাওয়া গেছে। বিষয়টি আমাদের আলোচনায় তুলে ধরা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি মুলক ব্যবস্থা অন্য ক্ষেত্রে এই বিষয়টিও বিবেচনা করা হয়েছে।"
তিনি জানান ঘটনার পর আইসিসিআর-য়ের গুয়াহাটি জোনের ডিরেক্টরও ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেছেন এবং এনআইটির তরফে করা তদন্ত এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিষয় নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। অধ্যাপক ধর বলেন, "আমাদের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকার ফলেই শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হয়নি। আইসিসিআর-য়ের গুয়াহাটি জোনের ডিরেক্টর গোটা বিষয় শুনেছেন এবং তিনি আমাদের কাজে সন্তুষ্ট। বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশের বহু ছাত্রছাত্রীরা ভারত সরকারের সহায়তায় আমাদের এখানে পড়াশোনা করে। ডিরেক্টর তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং তাদের বুঝিয়ে বলেছেন এখানে পড়াশোনা করতে হলে কী কী নিয়ম পালন করতে হয়। আমরা আশাবাদী তার কথায় ছাত্রছাত্রীরা কান দেবে।"
অভিযুক্তরা যা জানালেন
যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের বয়ান, প্রতিষ্ঠানের তরফে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তারা স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে, দুপক্ষের মধ্যে তর্ক ও মারপিট হয়েছিল এবং ছেলেদের হোস্টেলে প্রায়ই হয়। বিষয়টাকে অকারণে বড় করে দেখা হচ্ছে এবং এর পেছনে হয়তো তাদের বাংলাদেশী পরিচয় কাজ করছে। ডিডাব্লিউ তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেষ্টা করেছে তবে সেই সুযোগ পাওয়া যায়নি।
এনআইটির ছাত্রদের মধ্যে মারপিট নতুন ঘটনা নয় এবং অতীতেও বারবার ক্যাম্পাসে মাদক সেবনের প্রসঙ্গ উঠেছে। তবে প্রত্যেকবার কর্তৃপক্ষ এটি অস্বীকার করেছে। এবার তারা স্বীকার করেছেন উন্মত্ত ছাত্রদের ঘরে নিষিদ্ধ মাদক পাওয়া গেছিল। কয়েক বছর আগে হাইলাকান্দিতে এনআইটির এক প্রাক্তন ছাত্র মাদক পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। তখন সে পুলিশের কাছে জানিয়েছিল, বহুবার ক্যাম্পাসে মাদক পাচার করেছে।
এবারের ঘটনায় পাঁচ জন ছাত্রকে বরখাস্ত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডিরেক্টর জানান, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হলে বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। এছাড়া যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গেছে, এরপরে আর পুলিশের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। গত বছর এক ঘটনার পর কাছাড় জেলার পুলিশ সুপার নুমাল মাহাত্তা জানান, এনআইটি বা আসাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হলে কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে।
পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, কেন্দ্র সরকারের নির্দেশ এলে বাংলাদেশের এই পাঁচ ছাত্রকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
একইভাবে গতবছর এক ছাত্রীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোহয়েছিল এবং তাকেও কড়া পাহারায় সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল পুলিশ। সেই ছাত্রীর বিরুদ্ধে শিলচরের কিছু ছাত্র সংগঠন অভিযোগ করেছিল সে নাকি ভারত বিরোধী ফেসবুক পোস্টে লাইক করেছে। তার বিরুদ্ধে এখানে মামলা হয় এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে তাকে সাময়িকভাবে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এনআইটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মাঝেমধ্যে এধরনের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা এখানে নিরাপদে পড়াশোনা করছে।