ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা – কত আর দূরত্ব? কিন্তু বেঁচে থাকার তীব্র তাগিদে শিল্পী যেদিন কোলের বাচ্চাটাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়, এই সামান্য দূরত্বটাও তার বিশাল মনে হয়েছিল৷ কিন্তু গার্মেন্টস কারখানায় কাজ যে তার চা-ই চাই...৷
বিজ্ঞাপন
সংখ্যার বিচারে এ দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের বেশি হবে না৷ কিন্তু অজপাড়াগাঁয়ের সাধারণ একটি মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়ার পথে এই পদক্ষেপ বাংলাদেশে নারীমুক্তির প্রতীক নয় কি? মেয়েটি বঙ্গবন্ধুর কন্যা নন, জিয়া পরিবারের গিন্নী নন, কোনো ধনী, তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারে তাঁর জন্মও হয়নি, কিন্তু তারপরও শিল্পীর মতো মেয়েরা যে দূরত্বটা পার হয়েছে, হচ্ছে, তাকে নারীর অগ্রযাত্রা না বললে ইতিহাসকে যে অস্বীকার করা হবে৷ ‘দ্য পাওয়ার টু চুজ' বইটিতেও প্রখ্যাত অধ্যাপক নায়লা কবীর ঠিক সেই কথাই বলেছেন৷ তুলে ধরেছেন তাঁদের কথা, যাঁরা অকল্পনীয় অচলায়তন ভেদ করে এগিয়ে এসেছেন....চোখে স্বপ্ন নিয়ে....নিজের পায়ে তাঁদের যে দাঁড়াতেই হবে...৷
বাঙালি নারীর দশ গুণ
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ নারীর গুণ সম্পর্কে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলের পাঠকরা৷ তাঁদের মতামত এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাঙালি নারীর দশগুণ নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
আবেগী, স্বাধীনচেতা
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ আবেগ যেমন তাঁদের দ্রুত স্পর্শ করে, তেমনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কিন্তু তাঁরা সত্যিকার অর্থে অনড়৷ নিজের সত্ত্বা নিয়ে অহংকার তাঁদের আছে বটে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে রয়েছে অসীম ধৈর্য্য৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাড়ি৷ সেই শাড়ি বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলে চমৎকারভাবে৷ বিভিন্নভাবে শাড়ি পরতে জানেনও তাঁরা৷ আর ‘উপহার হিসেবে শাড়ি’? – কোন বাঙালি মেয়ে না চায় বলুন?
ছবি: DW/A. Islam
উৎসব প্রেমী
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন৷ নববর্ষ, ঈদ কিংবা দুর্গা পূজা – সব উৎসবই যেন বাঙালি নারীর জন্য তৈরি৷ প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে মানানসই পোশাক পরতে এবং সেই উৎসবের উপযুক্ত রান্নায় পারদর্শী তাঁরা৷ ডয়চে ভেলের পাঠক সুজন খানের কথায়, ‘‘বঙ্গের নারী লাজুক প্রকৃতির, কিন্তু যে কোনো উপলক্ষ্যেই প্রাণ খোলা হাসি উপচে পড়ে তাঁদের৷’’
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
‘নো ডায়েট’
বাঙালি নারী ‘ডায়েট’ করছেন, এমনটা বেশ বিরল৷ তাই খাওয়ার ব্যাপারে তাঁরা বেশ উদার৷ কথায় বলে না, মাছে-ভাতে বাঙালি? অবশ্য মাছ-ভাতের পাশাপাশি ফুসকা কিংবা চটপটি পেলে তো আর কথাই নেই৷ আসলে টক, ঝাল, নোনতা, মিষ্টি, এমনকি তেতোও পছন্দ এই নারীদের৷
ছবি: Debarati Mukherji
রান্নার শখ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই ধরুন৷ দেশ সামলানোর কঠিন দায়িত্ব পালনের মাঝেও রান্না ঘরে যেতে ভোলেন না তিনি৷ গত বছর ছেলের জন্য রান্না করার সময় তোলা তাঁর এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল৷ বাঙালি মেয়েরা রাঁধতে যে ভীষণ ভালোবাসেন!
ছবি: Sajeeb Wazed
অল্পতেই সন্তুষ্ট
বাঙালি মেয়েদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা কি খুব কঠিন? না৷ সকলেই জানেন যে, কাজটা সহজই৷ একটি লাল গোলাপ পেলে কিংবা প্রিয় রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেই তাঁরা সন্তুষ্ট৷ ডয়চে ভেলের পাঠক রন্জু খালেদের মতে, বাঙালি নারীর মধ্যে ‘একইসাথে দৃঢ়তা ও নমনীয়তা এবং প্রজাপতির চপলতা’ রয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
কাজল কালো চোখ
জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি’ – বাঙালি নারীর কাজল কালো চোখের প্রশংসা পাবেন অনেক কবির কবিতাতেই৷ সত্যি বলতে কি, বাঙালি নারীর চোখ পুরুষকে টানে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: N.Seelam/AFP/GettyImages
বাকপটু
বাংলাদেশের কিংবা ভারতের মেয়েরা চুপ করে বসে আছেন – এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন৷ তাঁরা কথা বলতে ভালোবাসেন৷ রান্না থেকে রাজনীতি – সব বিষয়েই একটা মতামত আছে তাঁদের৷ ডয়চে ভেলের পাঠক জিএনএস নয়নের কথায়, ‘‘নারী পুরুষের যে কোনো কষ্ট অতি সহজে ভুলিয়ে দিতে পারে৷ এই গুণই আমাকে মুগ্ধ করে, আবার সাথে অবাকও করে৷’’
ছবি: DW/A. Islam
নারীবাদী
বাঙালি মেয়েরা নারীবাদী৷ বিতর্কিত বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁদের অনেকেরই প্রিয়৷ নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’ পড়েনি এমন নারী পাওয়া মুশকিল৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভ্রমণপ্রিয়
বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় বাঙালি নারীর গুণ কি আর অল্পতে জানানো যায়, বলুন? কিছু গুণ না হয় অজানাই থাক৷ তবে একটির কথা বলে শেষ করি, বাঙালি মেয়েরা কিন্তু ঘুরতে খুব ভালোবাসেন৷ তথ্য সহায়তা: ডয়চে ভেলে ফেসবুক পাতা, ইন্ডিয়াওপাইন্স, স্কুপহুপ
ছবি: DW/A. Islam
10 ছবি1 | 10
সীমাবদ্ধতার দেয়াল ভেঙে এগিয়ে গেছেন যাঁরা
বাংলাদেশে নারী জাগরণ, নারী আন্দোলনের ইতিহাস অবশ্য নব্বই দশকে পোশাক শিল্প কারখানার বিকাশ থেকে শুরু হয়নি৷ এর বীজ লুকিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক আগে থেকে৷ বাহান্নের ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান আর তারপর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীরা ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য, দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন৷ আসলে লড়াই-সংগ্রাম, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, শিল্প-সাহিত্য – সর্বত্রই নারী হেঁটেছে পুরুষের সমানতালে৷ বেগম রোকেয়া, লীলা নাগ, প্রীতিলতা, সুফিয়া কামাল, নুরজাহান বেগম, নভেরা আহমদ, তারামন বিবি, ইলা মিত্র, জাহানারা ইমাম অথবা সিতারা বেগম – এরা তো বাংলাদেশেরই মেয়ে ছিলেন৷ কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরেও নারীকে নারীরূপে দেখার ক্ষেত্রে বড় রকমের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি৷
নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অবশ্য বারবারই নারীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কথা বলেছেন৷ তিনি মনে করেন, ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথে সহায়ক হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও নারীর প্রতি নির্যাতনের হার তেমন কমেনি৷ এই অগ্রগতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায়, আয়ে, এমনকি স্বাস্থ্যখাতে দৃশ্যমান হলেও, নারীর প্রতি বৈষম্য আজও দূর হয়নি বাংলাদেশে৷ তবে এতেও দমে যায়নি নারী৷
'ফাস্ট ফ্যাশন': প্রদীপের নীচেই অন্ধকার
ফ্যাশনের নেশা আর জাদু চিরকালে, তা সত্ত্বেও জামাকাপড় আজ ফেলে দেওয়ার জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ড্রেসডেন শহরের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সংগ্রহশালায় আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে গার্মেন্টস শিল্পের অন্ধকার দিকটাও দেখানো হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Christians
বিশেষ মূল্য ছাড়ের মূল্য
সব ধরনের পছন্দ আর সবরকম দামের জামাকাপড় সরবরাহ করার জন্য ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এমন সব দেশে গার্মেন্টস তৈরি করাচ্ছে, যেখানে পরিবেশ সুরক্ষার মান ও পারিশ্রমিক, দুই-ই নীচের দিকে৷ ড্রেসডেনের ‘ফাস্ট ফ্যাশন’ প্রদর্শনীতে ফ্যাশন নামের বিগ বিজনেসের যবনিকার আড়ালে উঁকি মারা হয়েছে৷ প্রদর্শনীটি চলবে ২০১৬ সালের ৩রা জুন অবধি৷
ছবি: anna.k.o.
গ্ল্যামারের অপর পীঠ
শুরু থেকে ‘শ্রেডিং’ বিশেষ দূর নয়৷ পশ্চিমের মানুষ নিত্যনতুন পণ্য চায় ও কেনে – প্রয়োজনের অনেক বেশি৷ ড্রেসডেনের প্রদর্শনীতে দেখতে পাওয়া যাবে এর অর্থনৈতিক, নৈতিক ও পরিবেশগত ফলশ্রুতি৷ পশ্চিমি জীবনধারার ফলে বাংলাদেশের মানুষ কতটা প্রভাবিত হচ্ছেন?
ছবি: Tim Mitchel/lHygienemuseum Dresden
রিসাইক্লিং, নাকি সস্তায় আবর্জনা সরানো?
ইউরোপে বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা যে সব পুরনো জামাকাপড় সংগ্রহ করেন, তার ৬০ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পাঠানো হয়৷ ধরন, রং ও ফ্যাশন অনুযায়ী বড় বড় গাঁট বেঁধে, জাহাজে করে সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করা হয়৷ ভারতের পানিপথে পুরনো গরম জামাকাপড় আবার রং অনুযায়ী ভাগ করা হয় – তার ফলে নাকি তার দাম বাড়ে৷
ছবি: Tim Mitchel/lHygienemuseum Dresden
বাঁচাও যায় না, মরাও যায় না
ফাস্ট ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে যেভাবে প্রোডাকশন চলে, তা ইউরোপেও এককালে ছিল৷ ধীরে ধীরে তা পুবদিকে ‘রপ্তানি’ করা হয়েছে: প্রথমে পূর্ব ইউরোপে, তারপর এশিয়ায়৷ মাইনেপত্র এক হিসেবে দারিদ্র্যসীমার নীচে৷ বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস কর্মীর পরিবারের ১১ জন মানুষ একটি ঘরে বাস করছেন, এমনও দেখা যায়৷
ছবি: Taslima Akhter/Hygienemuseum Dresden
হাজার স্বপ্নের সমাধি
রিনার মা কাঁটাতারের বেড়ার সামনে বসে তাঁর মেয়ের ফেরার অপেক্ষা করছেন – অনর্থক৷ বেড়ার পেছনে সাভারের সেই গার্মেন্টস ফ্যাক্ট্রি, রানা প্লাজা, যা ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ধসে পড়ে ১,১৩৪ জন মানুষের জীবন নেয়৷ ছবিটি তোলেন তসলিমা আখতার৷
ছবি: Taslima Akhter/Hygienemuseum Dresden
সোয়েটশার্টেই তার প্রমাণ
সস্তায় উৎপাদন আর কাজের পরিবেশের মধ্যে সংযোগসূত্র শুধু ছবি আর ডায়াগ্রামের মাধ্যমেই নয়, গার্মেন্টসের মধ্যে দিয়েও ফুটিয়ে তোলা যায়৷ জার্মান শিল্পী মানু ভাসহাউস চীনে এমন সব সোয়েটশার্ট তৈরি করিয়েছেন, যার উপর রানা প্লাজা বিপর্যয়ের ছবি ছাপানো রয়েছে৷
ছবি: Manu Washaus/Hygienemuseum Dresden
স্লো ফ্যাশন
ফ্যাশন কথাটার সঙ্গে ‘ফেয়ার’ – মানে ন্যায্য – কথাটাও যে যোগ করা যায়, তার প্রমাণ এই ধরনের ফ্যাশন৷ এই সব ডিজাইনাররা শ্রমিকদের শোষণ, পরিবেশের পক্ষে হানিকর অথবা জন্তুজানোয়ারের পক্ষে কষ্টদায়ক, এমন কোনো পন্থায় ফ্যাশন সৃষ্টি করতে চান না৷
ছবি: Daniel Bark/Deutsches Hygiene-Museum
এথিক্যাল ফ্যাশন শো
এ বছর বার্লিন ফ্যাশন উইকে টেকসই ফ্যাশন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল৷ ড্রেসডেনের প্রদর্শনীতে তা-ও দেখানো হয়েছে৷ পশ্চিমে এখন ‘সবুজ’ ফ্যাশন আর ‘ফেয়ার ট্রেড’-এর প্রবণতা বেড়েছে৷
ছবি: Getty Images/Thomas Lohnes
কিন্তু ‘পেপে’?
পাওলো উডস-এর তোলা এই ছবিটি যে ব্যঙ্গাত্মক, তা কাউকে বলে দিতে হবে না৷ ‘আমাকে চুম্বন করো, আমি ব্লন্দিনী’, লেখা রয়েছে টি-শার্টটিতে৷ অথচ যে মেয়েটি এই সেকেন্ড হ্যান্ড টি-শার্ট পরে রয়েছে, সে হাইতির, ইউরোপ বা অ্যামেরিকার নয়৷ দাতব্য হয়ে এই ধরনের সব টি-শার্ট হাইতিতে আসে৷ সেখানে তাদের বলা হয় ‘পেপে’৷
ছবি: Paolo Woods/INSTITUTE
9 ছবি1 | 9
বরং লড়াইটা চলছে, নানা মাত্রায়, নানা ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকারও নারী৷ এছাড়া এই গত ২৫ বছরে আমরা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক সালমা খাতুনকে যেমন পেয়েছি, পেয়েছি এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার, আলোকচিত্রী সাঈদা খানম অথবা ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌসের মতো সাহসী নারীকেও৷ তাই মেধায়, মননে, শ্রমে, চর্চায়, দায়িত্বে, কর্তব্যে নারীর পদচারণ যে পুরুষের সমকক্ষ হয়েছে, সেটা ভুলে গেলে আমাদের একেবারেই চলবে না৷
এই তো কয়েক মাস আগের কথা৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছিলেন, বাংলাদেশে নাকি নারীদের জাগরণ এসেছে৷ তাঁর কথায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এ দেশের নারীদের সব পেশার দরজা খুলে দিয়েছেন৷ আজ মেয়েরা সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন৷ এমনকি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতেও কাজ করছেন বাংলাদেশের নারীরা৷ মন্ত্রীর কথায়, ‘‘কাজ করলে সমস্যা আসবে৷ তাই পিছিয়ে গেলে চলবে না৷ সমস্যা মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে৷'' আর ঠিক সেটাই তো প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত করে চলেছেন শিল্পীর মতো মেয়েরা৷ তাই না?
আরো হাজারো শিল্পী লুকিয়ে আছে ঢাকা শহরে
শিল্পীর মতোই আরো অজস্র নারী কাজ করছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানায়৷ কিশোরী ও মাঝবয়সি এ সব নারীরা মফঃস্বল এবং প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে যোগ দিয়েছে, দিচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পে৷ কিশোরগঞ্জের সখিনা, নীলগঞ্জের সমলা, বাসিরন ও ঝুমা আর বরিশালের তসলিমা গার্মেন্টসের কারখানায় নাম লেখানো তালিকারই কয়েকটি নাম৷ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছে এরা৷ এদের কেউ ঢাকায়, কেউ গাজীপুর, আবার কেউ স্থায়ী হয়েছে নারায়ণগঞ্জের কারখানায়৷
বাংলাদেশে পোশাক কারখানার নিরাপত্তা
পশ্চিমা বিশ্বের একদল পরিদর্শক বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে ভয়াবহ নিরপত্তা ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন৷ রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় তারা এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
রানা প্লাজা বিধ্বস্তের পর...
২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলে নিহত হয় অন্তত ১,১০০ পোশাক শ্রমিক৷ এ ঘটনার পর পশ্চিমা যেসব দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়, তারা পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়৷ সম্প্রতি বেশ কিছু নামি-দামি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করেছেন৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ঝুঁকি
পরিদর্শকরা জানিয়েছেন, বেশিরভাগ পোশাক কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা এবং ভবনের কাঠামোর বিষয়ে অন্তত ৮০,০০০ নিরারপত্তা ইস্যু খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷
ছবি: Kamrul Hasan Khan/AFP/Getty Images
২,২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য
বাংলাদেশে পোশাক খাতে বাণিজ্যের পরিমাণটি বিশাল৷ অর্থের অঙ্কে প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার৷
ছবি: DW/C. Meyer
পোশাক রপ্তানিতে মন্দা
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে গার্মেন্টসগুলো তাদের ক্রেতা হারাচ্ছে৷ ফলে পোশাক রপ্তানির হার হ্রাস হয়েছে৷
ছবি: Reuters
পোশাক কারখানা পরিদর্শন
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পোশাক ব্র্যান্ড এইচঅ্যান্ডএম এবং ইনডিটেক্সসহ ১৮০টিরও বেশি ব্র্যান্ডের প্রতিনিধি ও সদস্যরা অন্তত ১,১০৬টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ তাঁরা জানিয়েছেন, প্রতিটি কারখানায় বৈদ্যুতিক ঝুঁকির পাশাপাশি, ভবনের কাঠামো ও অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাতে গাফিলতি খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা৷ এমনকি অনেক কারখানায় ফায়ার অ্যালার্ম ও ফায়ার এক্সিটও নেই৷
ছবি: DW/C. Meyer
অবিলম্বে খালি করার নির্দেশ
১৭টি কারখানা অবিলম্বে খালি করে বন্ধের নোটিস দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিদর্শকরা৷ কারণ ঐ ১৭টি কারখানা যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে বলে জানিয়েছেন তাঁরা৷ এছাড়া ১১০টি কারখানার ভবন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলেও জানা গেছে৷
ছবি: Reuters
নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা
এর আগে নর্থ অ্যামেরিকান কোম্পানি ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর মতো বেশ কিছু কোম্পানির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের ৫৮০টি কারখানা পরিদর্শন করেছেন৷ উদ্দেশ্য একই, নিরাপত্তা ইস্যু খতিয়ে দেখা৷ দেশের অন্তত ৩০০টি কারখানায় ওয়ালমার্ট ও গ্যাপ-এর পোশাক তৈরি হয়৷
ছবি: AP
আশঙ্কায় শ্রমিকরা
তবে যেসব কারখানা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেসব শ্রমিকরা বেতন না পাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন৷ কেননা পরিদর্শকরা শ্রমিকদের বেতন দেয়ার কথা বললেও মালিকরা এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি৷
ছবি: Imago/Xinhua
পরবর্তী পদক্ষেপ
পরিদর্শকরা বেশিরভাগ কারখানার মালিক ও প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনায় বসে কী কী ইস্যুতে পরিবর্তন আনা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে৷ এরপর আবারো তাঁরা পরিদর্শনে আসবেন নিজেদের নির্দেশনা কতটা বাস্তবায়ন হলো, তা দেখার জন্য৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
বলা বাহুল্য, আজ বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস তৈরি পোশাক শিল্প৷ প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৭০ ভাগেরও বেশি এ খাত থেকেই আয় হয়৷ বাংলাদেশের প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করছে অন্তত ৪৫ লাখ শ্রমিক৷ আর এই বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের মোট আশি ভাগই নারী কর্মী৷ বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটা দেশের জন্য এ একটা বিরাট প্রাপ্তি, অর্জন নয় কি? শিল্পীর মতো এ সব মেয়েরা সমাজ-সংস্কার-সংসার সামলে যেভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন, স্বামী বা বাবার দুস্থ সংসারের হাল ধরছেন অথবা স্বপ্ন দেখছেন কোলের ছেলেটার জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যতের, তাঁদের কি আপনি নারীর অগ্রযাত্রার প্রতীক বলবেন না?
আমি তো বলবো৷ একটা সময় ছিল, যখন দরিদ্র পরিবারের অনেক মেয়েই বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতো৷ কিন্তু গার্মেন্টস কারখানাগুলো নারীকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছে৷ যে মেয়ে একদিন সংসারে বোঝা ছিল, আজ সে-ই পারিবারিক আয়ের একটা বড় উৎস৷ দেশের অর্থনীতিতে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, ক্ষমতায়ন হয়েছে নারীর৷ তবে ন্যূনতম মজুরি বাড়লেও আজও শিল্পীদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়৷ এদের সকলকে মাথা গোঁজার একটা ঠিকঠাক ঠাঁই, এমনকি বিশুদ্ধ খাবার পানির নিশ্চয়তাও আমরা দিতে পারিনি৷ তাজরীন আর রানা প্লাজার ভয়াবহ ঘটনার পরেও দিতে পারিনি পর্যাপ্ত সুরক্ষা...৷
এই গার্মেন্টস কর্মীদের মতো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব প্রান্তিক মানুষের প্রতিবাদী-প্রগতিসূচক আন্দোলন আমাকে আন্দোলিত করে৷ তাই কণ্ঠ সোচ্চার করে, নাটক করে, লিখে, তাঁদের এই আন্দোলনে শরিক থাকার চেষ্টা করি৷ আর যতবারই সেটা করি, অবাক হই গ্রামবাংলার এই সাধারণ মেয়েদের মনের জোর, অক্লান্ত পরিশ্রম আর সরলতা দেখে৷ মনে পড়ে যায় নারীর ক্ষমতায়নের অনেকটা পথ এখনও পার হতে হবে৷ মনে মনে বলি, নারী-শ্রমিকের জীবন আজও কিন্তু সমস্যার নিগড়ে বাঁধা...৷
বন্ধুরা, শিল্পীরা কি সত্যিই নারীর অগ্রযাত্রার প্রতীক নয়? জানান আপনার মন্তব্য, নীচের ঘরে৷
বিশ্বের যত নারী প্রেসিডেন্ট এবং নারীর ক্ষমতায়ন
নারীর ক্ষমতায়নের পথে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিল নেপাল৷ এই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি৷ বিদ্যা ভান্ডারি’র রাষ্ট্রপতি হওয়াকে উপলক্ষ্য করে সারা বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের খণ্ডচিত্রটাও একটু দেখে নেয়া যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/O. Andersen
বিশ্বের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট, প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী
বিশ্বের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট আর্জেন্টিনার ইসাবেল পেরন৷ সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরনের তৃতীয় স্ত্রী ইসাবেল প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পান৷ পরে ১৯৭৪ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টও ছিলেন৷ বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে৷ তিন দফা (১৯৬০-৬৫, ১৯৭০-৭৭, ১৯৯৪-২০০০) দায়িত্বে ছিলেন তিনি৷ ওপরে তাঁরই ছবি৷
ছবি: picture alliance/Sven Simon
হিমালয় কন্যা বিদ্যা ভান্ডারি
অবশেষে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেলো নেপাল৷ সাংসদ এবং ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সিপিএন-ইউএমএল) -এর ভাইস চেয়ারপারসন বিদ্যা ভাণ্ডারিকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত করেছে সে দেশের সংসদ৷ নেপালের রাষ্ট্রপতি এখন রাম বরণ যাদব৷ ২৪০ বছর রাজতন্ত্রের অধীনে থাকা দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি তিনি৷ তাঁর কাছ থেকেই দেশের প্রথম নারী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন ৫৪ বছর বয়সি বিদ্যা ভান্ডারি৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Mathema
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে নারীকে প্রেসিডেন্ট করেছে ভারত৷ ২০০৭ সালে সে দেশের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হন প্রতিভা পাতিল৷ ভারতের দ্বাদশ প্রেসিডেন্ট প্রতিভা ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন৷ তাঁর কাছ থেকেই দায়িত্ব নিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি৷ ছবিতে প্রতিভা পাতিলের কাছ থেকে প্রণব মুখার্জির দায়িত্ব নেয়ার মুহূর্ত৷
ছবি: Reuters
১৪টি দেশে নারী প্রেসিডেন্ট
এ মুহূর্তে ১৪ দেশের প্রেসিডেন্ট নারী৷ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, চিলি, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, লাইবেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, মাল্টা, মরিশাস, স্যান মারিনো, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বুধবার যোগ হলো নেপাল৷ ওপরের ছবিতে মরিশাসের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আমিনা ফিরদাউস গারিব ফাকিম৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশ এখনো অপেক্ষায়
প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিচারপতিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ পদেই নারী পেয়েছে বাংলাদেশ৷ তবে এ পর্যন্ত ২০ জন রাষ্ট্রপতি পেলেও এ দায়িত্বে এখনো কোনো নারীকে দেখা যায়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
অনন্য সুইডেন ও ফিনল্যান্ড
নারীর ক্ষমতায়নে অনন্য এক নজির রেখেছে সুইডেন৷ ১৯৯৯ সালে সে দেশের মন্ত্রীপরিষদে পুরুষের চেয়ে নারী সদস্যই ছিল বেশি৷ ১১ জন নারীর বিপরীতে পুরুষ ছিলেন ৯ জন৷ এমনটি আগে কোনো দেশেই দেখা যায়নি৷ পরে ফিনল্যান্ডের মন্ত্রীপরিষদেও নারীর আধিক্য দেখা গেছে৷ ২০০৭ সালে ফিনল্যান্ডের মন্ত্রীপরষদের শতকরা ৬০ ভাগ সদস্যই ছিলেন নারী৷ ছবিতে সুইডেন ও ডেনমার্কের দুই নারী নেত্রী৷
ছবি: AP
যারা অনেক পিছিয়ে
বিশ্বের সব দেশ নারীর ক্ষমতায়নে কম-বেশি উদ্যোগী হলেও ব্রুনাই এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি পিছিয়ে৷ মুসলিমপ্রধান দেশটিতে নারীকে এখনো উপমন্ত্রীর চেয়ে বড় দায়িত্ব দেয়া হয়নি৷ তবে এ মুহূর্তে অ্যাঙ্গোলা, ভুটান, কোমোরো আইল্যান্ড, কুক আইল্যান্ড, লেবানন, মঁসেরাত এবং সলোমন আইল্যান্ডই সবচেয়ে বেশি নারীবিমুখ৷ এই দেশগুলোর মন্ত্রীপরিষদ, এমনকি সংসদেও এই মুহূর্তে কোনো নারী নেই৷ছবিতে ব্রুনাইয়ের কয়েকজন নারী৷
ছবি: AP
মালালা ও তাঁর প্রজন্ম
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ অনেক দেশেই মাথা চাড়া দিয়েছে৷ তবে শান্তির পথে, মানবতার পথে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নারীর দৃপ্ত পদচারণাও দেখা যাচ্ছে৷ গত বছর (২০১৪) সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল জয় করেছেন মালালা ইউসুফজাই৷ পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন রাজ্য তাঁর জন্মস্থান৷ সেখানে হত্যার উদ্দেশ্যে তালেবান তাঁর ওপর হামলাও চালিয়েছিল৷ মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে মালালা এখন প্রজন্মের মুক্তচিন্তার মুক্তির প্রতীক৷