শিল্প যখন হাতিয়ার
৩০ জুন ২০১৪বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে, কাজেই সিনেমা-থিয়েটারের আলোচনায় বার বার চলে আসছিল ফুটবলের প্রসঙ্গ৷ আর সেই সূত্রেই আলোচনায় চলে এলো ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের কর্মীদের প্রসঙ্গও!
আসলে বিশ্বনন্দিত জার্মান নাট্যকার ব্যার্টল্ট ব্রেশট-এর নাট্য ভাবনার কথা বলছিলেন কলকাতার নাট্যকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্দেশক সুমন মুখোপাধ্যায়৷ প্রসঙ্গ, থিয়েটার এবং সিনেমাকে যখন রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ সেই সূত্রেই অবধারিতভাবে উঠে এসেছিল রাজনৈতিক নাট্যকার হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম বহুলচর্চিত এবং আলোচিত ব্যার্টল্ট ব্রেশট-এর নাম৷ এবং সুমন বোঝাচ্ছিলেন ব্রেশট-এর একটি নাট্যপদ্ধতির কথা যে, কখনও কখনও নাটকের শুরুতেই নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়, একেবারে শুরু থেকে শেষ দর্শকদের জানিয়ে দিতেন ব্রেশট৷ নাটকীয়তাকে এই ভাবে শুরুতেই নষ্ট করে ব্রেশট চাইতেন, দর্শকরা এবার মন দিক কীভাবে শুরু থেকে শেষে পৌঁছানো হলো, কেবলমাত্র সেই দিকে৷
এই কথা প্রসঙ্গেই সুমন আনলেন চলতি বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রসঙ্গ৷ বিশেষ করে অনেকে যেমন রাত জেগে খেলা না দেখে পরদিন ‘রিপ্লে' বা ‘হাইলাইটস' দেখছেন, এবং সেক্ষেত্রে, গত রাতের খেলার ফলাফল আগে থেকেই জানা থাকায় লোকে যেমন খেলাটা বেশি উপভোগ করতে পারছে, অনেকটা তেমনই ছিল ব্রেশট-এর ওই নাটকীয়তাবর্জিত নাটক দেখার অভিজ্ঞতা৷ সেই কথারই সূত্র ধরে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক রাজু রামণ, যিনি দীর্ঘদিন কলকাতায় জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গ্যোটে ইন্সটিটিউট, অর্থাৎ মাক্স ম্যুলার ভবনের সংস্কৃতি বিষয়ক অধিকর্তা ছিলেন, তিনি জানালেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা৷
কয়েক বছর আগে রাজু রামণ জার্মানি সফরের সময় বন শহরে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের দপ্তরে গিয়ে দেখেছিলেন, একজন কর্মীও দপ্তরে নেই! তাঁরা সবাই দল বেঁধে গিয়েছে পাশের শহর ডুসেলডর্ফে, ফুটবল খেলা দেখতে৷ কারণ, ফুটবল খেলায় যেমন একটি দলের ১১জন খেলোয়াড় ক্রমাগত উঠে-নেমে, অন্যদের ফাঁকা জায়গা আগলে রেখে খেলেন, কর্মীরাও ওইভাবে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে দলগত সমন্বয় বজায় রেখে – সেটাই আসলে শেখাতে চেয়েছিলেন ডয়চে ভেলে কর্তৃপক্ষ৷ এই ঘটনার কথা শুনে উপস্থিত শ্রোতারা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাততালি দিয়ে উঠলেন৷ কারণ সুমন মুখোপাধ্যায়ও তাঁর ভাষণে শুরু থেকেই বলতে চাইছিলেন যে থিয়েটার বা সিনেমার রাজনীতি মানে আসলে কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ, আদর্শ-নির্দিষ্ট রাজনীতি নাও হতে পারে৷ একজন নাট্যকর্মী, সিনেমার অভিনেতা বা নির্দেশক যে জীবনযাপন করেন, যে সৃজন চর্চা করেন, সেটা চলতি হাওয়ার পন্থি হতে পারে, চলতি ধারার সমর্থন আবার প্রয়োজন হলে সমালোচনা হতে পারে, আবার সেই গতানুগতিকতার পরিপন্থি হতে পারে৷ সেটাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে পারে৷
সুমনের মতে, এটাও এক ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্যেরই প্রকাশ৷ চলতি সামাজিক প্রথা, বা চলতি স্রোতের বিরুদ্ধে যাওয়া৷ কখনও উচ্চকিত না হয়েও নিজের রাজনৈতিক বক্তব্যকে সুকৌশলে জানিয়ে দেওয়া৷ গ্রিক নাটক থেকে সংস্কৃত নাটক, উদাহরণ তুলে আনছিলেন সুমন৷ তাঁর বক্তব্য, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম নাটকে এক সিঁধেল চোর যখন সিঁধ কাটার আগে নিজের উপবীত দিয়ে জায়গার মাপ নেয়, তখন সেটা অবশ্যই ব্রাক্ষ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে এক জোরালো রাজনৈতিক বক্তব্য৷ তবে অনেক সময় সেটা অন্যমনস্ক দর্শকের নজর এড়িয়েও যায়৷ ফলে আইরিশ নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট রাজনৈতিক নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত হন না, যতটা হন জার্মানির ব্রেশট৷ অথচ খুঁজে দেখলে বেকেটের নাটক প্রায়সময়ই সামাজিক ধ্যান-ধ্যারণার বিরুদ্ধমতকে প্রশ্রয় দেয়৷
আর চলতি প্রথা মানে শুধুই কি রাজনৈতিক প্রবণতা? প্রশ্ন তুলেছেন সুমন৷ হ্যাঁ, সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর আরোপিত রাজনৈতির ধ্যান-ধারণারও বিরুদ্ধাচরণ করতে হয় অনেক সময়৷ কিন্তু নাট্যকর্মী বা সিনেমা নির্মাতা হিসেবে বাজারচলতি কাঠামো বা পদ্ধতিও কি বিরোধিতার জন্ম দেয় না একজন সৃজনশীল মানুষের মনে? চলচ্চিত্র ঠিক এভাবেই তৈরি হতে হবে, থিয়েটার মানেই তার কাঠামো এরকম হবে – এগুলোও বিরুদ্ধতার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়৷ তবে তাতে আদতে শিল্পেরই লাভ হয়৷ নতুন শিল্পধারণার জন্ম হয় সেই বিরোধিতা থেকে৷ সুমন মুখোপাধ্যায়ের বিশ্বাস, একজন শিল্পীর আজীবন চেষ্টা, তাঁর রাজনীতি আসলে সেটাই৷