বার্লিনের মোড়ে মোড়ে আজকাল ভিক্ষুক চোখে পড়ে৷ শিশু ভিক্ষুক৷ মা-বাবা কাজে যাওয়ার আগে সন্তানকে বসিয়ে দেন ভিক্ষায়৷ শিশুর সময় কাটল, পরিবারেরও আয় হলো৷ তবে সংঘবদ্ধ একটি চক্রের এই প্রবণতা রোধে আসছে কঠোর আইন৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে বড়দের ভিক্ষা এমনিতে নিষিদ্ধ নয়৷ প্রাপ্তবয়স্ক কেউ ভদ্রভাবে কারো কাছে আর্থিক সাহায্য চাইতে পারেন৷ তবে পথ আগলে বা কাউকে উত্যক্ত করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করা আইনত দণ্ডনীয়৷
বার্লিনে যেসব শিশুকে ভিক্ষা করতে দেখা যায় তারা হয় রোমা, নয়ত সিন্টি পরিবারের৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা নিজে সুবিধা মতো জায়গায় সন্তানকে বসিয়ে দিয়ে যান৷ কিন্তু জার্মানিতে শিশু নির্যাতন শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বার্লিনের নগর কর্তৃপক্ষ মনে করে, রোমা এবং সিন্টিরা যে শিশুদের ভিক্ষায় নামাচ্ছে তাতে শুধু পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে না, এর মাধ্যমে শিশুদের ওপর এক ধরনের নির্যাতনও হচ্ছে৷ শিশুদের স্বাভাবিক জীবনের বাইরে নিয়ে ভিক্ষার মতো কাজে বসিয়ে রাখাকে বার্লিনের অধিকাংশ সাধারণ মানুষও মনে করেন৷ ‘স্টার্ন' ম্যাগাজিনের এক জরিপে দেখা গেছে, বার্লিনের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ চান ১৪ বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য অন্তত ভিক্ষাবৃত্তি পুরোপুরি নিষিদ্ধ হোক৷
সংঘবদ্ধ চক্রটি শিশুদের বোবা সেজে ভিক্ষা করতে শিখিয়ে দেয়৷ এভাবে পথের ধারে প্রায় সারাটা দিন কাটিয়ে কত আয় করা যায়, তা জানা যায়নি৷ প্রচলিত আইন অনুযায়ী, এ ধরণের শিশু ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে পুলিশ৷ ভিক্ষারত অবস্থায় পেলে শিশুকে নিয়ে যুব কল্যাণ দপ্তরে পৌঁছে দেয়া হয়৷ অভিভাবক পরে এসে শিশুকে নিয়ে যান৷
এইটুকুতে অবশ্য কোনো কাজ হচ্ছে না৷ শিশুভিক্ষাবৃত্তি পুরোদমে চলছে৷ তাই আরো কঠোর আইনের প্রয়োগ জরুরি মনে করছে নগর কর্তৃপক্ষ৷ নতুন একটি আইনের প্রস্তাব রেখেছেন বার্লিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্রাংক হেঙ্কেল৷ প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, ভিক্ষায় লিপ্ত শিশুকে নিতে যুব কল্যাণ দপ্তরে এলেই অভিবাবকের হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে ৫০০ ইউরো জরিমানার রশিদ!
তাতেও কি কাজ হবে? অনেকে মনে করছেন, কাজ হবে, শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি কিছুটা হয়ত কমবে, তবে পাশাপাশি তাদের প্রতি এক ধরনের অন্যায়ও হয়ত করা হবে৷ তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে অভিবাবকরা বাধ্য হয়ে তখন শিশুকে সারাদিন ঘরে একা ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত নেবেন, নয়ত যেনতেন প্রকারের কোনো ‘বেবিসিটারের' কাছে রাখার ব্যবস্থা করবেন৷ দু'ক্ষেত্রেই শিশুর প্রতি এক ধরণের অবিচার করা হবে বলে আশঙ্কা অনেকের৷
অনেকে আবার মনে করছেন, প্রস্তাবিত আইনে কোনো কাজই হবে না৷ তাঁদের মতে, আর্থিক জরিমানা এ ধরনের সমস্যার স্থায়ী বা সুষ্ঠু সমাধান দিতে অক্ষম৷
বার্লিন নগর কর্তৃপক্ষ অবশ্য হাল ছাড়েনি৷ আইন প্রয়োগ করেই ফলাফল পর্যবেক্ষণ করা ঠিক মনে করছে তারা৷ আইনটি এই বসন্তে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হবে৷ সুফল পাওয়া গেলে তা-ই পরে স্থায়ী হবে৷
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷