বাচ্চাদের ওপর যৌন নিগ্রহের শাস্তি হিসেবে মাদ্রাজ হাইকোর্ট লিঙ্গচ্ছেদের সুপারিশ করেছে, তার ঔচিত্য-অনৌচিত্য নিয়ে চলছে তুমুল সোরগোল৷ প্রশ্ন,অপরাধ দমনে এটা কতটা সক্ষম? এটা হয়ত প্রকৃত সমাধান নয়, দরকার বিজ্ঞানসম্মত যৌন শিক্ষা৷
বিজ্ঞাপন
দেশ জুড়ে বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের ওপর যৌন অত্যাচারের ঘটনা যেভাবে বাড়ছে, তা দমনে অভিযুক্তদের বাড়তি শাস্তি দিতে তাদের লিঙ্গচ্ছেদের সুপারিশ করেছে মাদ্রাজ হাইকোর্ট৷ এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারকে হাইস্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানসম্মত যৌনশিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করার কথা বলেছে৷ আদালত মনে করে, এই শাস্তি বর্বরোচিত হলেও বর্বরোচিত অপরাধের শাস্তি এমনটাই হওয়া দরকার৷ গতানুগতিক আইন যখন এই ধরণের অপরাধ দমন করতে পারছে না, তখন আদালতকে অতিরিক্ত শাস্তির সংস্থান রাখতে হচ্ছে৷ আদালত আরো জানায়, গত ৫-৬ বছরে শিশুদের ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের হার ৪০০ শতাংশ বেড়েছে৷ আর শাস্তি হয়েছে আড়াই শতাংশের কম৷ কেন কম? সেটা অন্য প্রশ্ন৷ তবে এই শাস্তির বিধান স্রেফ ভারতেই নয়, অন্য অনেক দেশেই বৈধ৷
কী প্রসঙ্গে আদালতের এই সুপারিশ? ভারতের দক্ষিণি রাজ্য তামিলনাড়ুর এক ১৪ বছরের কিশোরের ওপর যৌন নিপীড়নের দায়ে অভিযুক্ত এক ব্রিটিশ নাগরিক তাঁর বিরুদ্ধে আনীত মামলা খারিজ করার আর্জি নিয়ে আদালতে গেলে, মামলার শুনানিকালে বিচারক এই সুপারিশ করেন৷ বলা হয়, ঐ কিশোরের পড়াশুনার ভার বহনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐ ব্রিটিশ নাগরিক ২০১১ সালে ছেলেটিকে দিল্লিতে নিয়ে এসে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালায় – অভিযোগ এমনটাই৷ এছাড়া সপ্তাহ খানেক আগেও দিল্লির বস্তি এলাকায় আড়াই ও পাঁচ বছরের দুই শিশুর ধর্ষণের খবর নিয়ে মিডিয়াতে শোরগোল পড়ে যায়৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
কিন্ত লিঙ্গচ্ছেদের মতো শাস্তি এই অপরাধ দমনে কতটা সফল হবে তাই নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা, নারী সংগঠন এবং নাগরিক সমাজে আড়াআড়িভাবে বিভাজিত৷ মনস্তত্ত্ববিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বি. কে রায় মনে করেন, কড়া শাস্তি দিলেই যদি অপরাধ দমন করা যেত, তাহলে যে অপরাধে ফাঁসির শাস্তি হচ্ছে, সেই অপরাধ বন্ধ করা যেত৷ কিন্তু তা কি হয়েছে? হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘কলকাতায় এক কিশোরীকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধে ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি নামে এক ব্যক্তির ফাঁসির সাজা হয়৷ তারপর কি ধর্ষণ কমে গেছে? কমেনি৷ কাজেই লিঙ্গচ্ছেদের শাস্তিতে ইতরবিশেষ কিছু হবার নয়৷ এটা মানুষের আদিম রিপুর অদম্য তাড়না৷'' তিনি জানান, হরমোনজনিত কারণে তা কখনো কখনো বিকৃত রূপ নেয়৷ এমনকি শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও তা বিরল নয়৷
তবে আদালতের সঙ্গে সহমত পোষণ করে ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, আসল সমাধান স্কুল-স্তরের পাঠ্যসূচিতে বিজ্ঞানসম্মত যৌন শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা৷ আরও জরুরি হলো মা-বাবা ও অভিভাবকদের এ বিষয়ে বাচ্চাদের সচেতন রাখা এবং নিজেদের সাবধান থাকা৷ সব থেকে বড় দুর্ভাগ্য, এই সব জঘন্য ঘটনায় বেশিরভাগ জড়িত পরিবারের আত্মীয় স্বজন এবং প্রতিবেশী৷ শিশুদের যৌন নিপীড়নের যত অভিযোগ আদালত পর্যন্ত যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি ঘটনা ঘটে৷ কিন্তু বাড়ির লোকজন তা চেপে যায় লোকলজ্জার ভয়ে৷ একটা শিশুর সুকুমার মনের ওপর তার যে প্রভাব পড়ে, সেদিকে ততটা নজর দেয়া হয় না, বলেন অধ্যাপক রায়৷
এক বিশিষ্ট আইনজীবী গীতা রামাশেষনের মতে, লিঙ্গচ্ছেদের মত শাস্তি মানর দেহকে বিকৃত করা, সেটা মেনে নেয়া যায় না৷ পাশাপাশি নারীবাদী সংস্থাগুলির সঙ্গে সুশীল সমাজের একাংশ মনে করে কড়া শাস্তির বিধান থাকা উচিত৷ বাচ্চাদের ওপর যৌন নিপীড়নের অপরাধ করার আগে ঐ ব্যক্তিকে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করবে৷
শিশুদের নিয়ে মন খারাপ করা কিছু খবর
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু বলে গণ্য করা হয়৷ শিশুদের নিয়ে ছবিঘরে থাকছে এমন কিছু তথ্য, যা পড়ে আপনার মন খারাপ হতে বাধ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাত মাসে ৬১ গণধর্ষণ
শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ২৬৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এর হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৬১টি শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই তথ্য জানায় ফোরামটি৷ একই সময়ে ধর্ষণ, উত্ত্যক্তসহ যৌন সহিংসতার শিকার হয় ৩৪৭টি শিশু৷ এর মধ্যে চারটি ছেলেশিশুও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বয়স ১৫ হওয়ার আগেই বিয়ে
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে ২৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৫ পার হওয়ার আগে৷ আর ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয় বয়স ১৮ পার হওয়ার আগে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশু
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশুর বাস খোদ ঢাকা শহরে৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
কিশোর অপরাধী
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিবছর কমপক্ষে দুই হাজার শিশুকে নানা অপরাধে আটক করা হয়৷ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭৬ জন শিশুকে অস্ত্র ও মাদক বহনসহ নানা অভিযোগে আটক করা হয়৷
ছবি: bilderbox
মাত্র তিনটি
আইন অনুযায়ী শিশু-কিশোর অপরাধীদের বিচার করা হয় কিশোর আদালতে৷ এরপর বিচার শেষে শাস্তি ভোগের জন্য তাদের শিশু-কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা৷ কিন্তু বাংলাদেশে এমন কেন্দ্র আছে মাত্র তিনটি৷ গাজীপুরে দু’টি এবং যশোরে একটি৷ এর মধ্যে গাজীপুরের একটি মেয়েদের জন্য৷ সব মিলিয়ে এই তিনটির ধারণ ক্ষমতা ৬০০৷ অর্থাৎ আটক শিশুদের বড় একটি অংশের জায়গা উন্নয়ন কেন্দ্রে হয় না৷ ফলে তাদের কারাগারে থাকতে হয়৷