1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিশুমনের বিকাশ: সংগীত শিক্ষক বিতর্কের অন্তর্নিহিত প্রশ্ন

Lubna Ferdowsi – Wissenschaftlerin an der University of Hull
লুবনা ফেরদৌসী
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে সংগীত শিক্ষকের নিয়োগ বন্ধের শর্তে দাঁড় করানো যুক্তিহীন; বরং এটি সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপনের এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। মনে করেন লুবনা ফেরদৌসী৷

বিশ্বজুড়ে গবেষণা প্রমাণ করেছে, সংগীত শিক্ষা শিশুদের জ্ঞানীয় বিকাশ, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত করে। মনে করেন লুবনা ফেরদৌসীছবি: Md Rafayat Haque Khan/ZUMA Wire/IMAGO

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে ঘিরে সাম্প্রতিক আলোচনায় একটি বিতর্কিত দাবি উঠেছে - সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন এই দাবি তুলেছে, যেন সংগীত শিক্ষা শিশুদের বিকাশের জন্য অপ্রয়োজনীয়, বরং ইসলামবিরোধী।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বহু বছর ধরেই ধর্মীয় শিক্ষার সুসংগঠিত ব্যবস্থা বিদ্যমান। জাতীয় শিক্ষাক্রমে ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত।বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০২৩)- এর তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ আছে। সুতরাং আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে সংগীত শিক্ষকের নিয়োগ বন্ধের শর্তে দাঁড় করানো যুক্তিহীন; বরং এটি সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপনের এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল।

জন ডিউই, প্রগ্রেসিভ শিক্ষার ‘জনক', তার ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড এডুকেশন (১৯১৬) গ্রন্থে বলেছেন, শিক্ষা কেবল তথ্য মুখস্থ করার প্রক্রিয়া নয়, শিক্ষা হলো, শিশুদের অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও সামাজিক বাস্তবতারসঙ্গে যুক্ত করার একটি নিরবচ্ছিন্ন চর্চা। সংগীত, নাটক, ক্রীড়া বা শিল্পচর্চা এই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রসারিত করে, শিশুদের কল্পনাশক্তি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়।

অন্যদিকে পাওলো ফ্রেইরে তাঁর পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড (১৯৭০) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, সংকীর্ণ ও একমুখী শিক্ষা প্রজন্মকে ‘নীরব ভোক্তাতে' পরিণত করে, যেখানে কল্পনা ও সমালোচনামূলক চেতনা দমিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংগীত শিক্ষার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এটি ধর্মীয় দাবির চেয়েও বরং এমন এক শিক্ষাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যা শিশুদের সমালোচনামূলক চেতনাকে সংকুচিত করে এবং আনুগত্যশীল প্রজন্ম তৈরি করে।

এখানে প্রশ্নটা হলো, আমরা শিশুদের শিক্ষাজীবনকে কতটা বৈচিত্র্যময়, সৃজনশীল ও সমন্বিত করতে চাই। ইউনেস্কোর ফিউচার্স অব এডুকেশন (২০১৯) রিপোর্ট বলছে, একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো,শিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে তারা শুধু জ্ঞানার্জনই না করে, বরং সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও সামাজিক সহমর্মিতায়ও দক্ষ হয়। একই গবেষণা বলছে, শিশুর সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে তাকে শারীরিক, মানসিক ও সৃজনশীল - এই তিনটি ক্ষেত্রেই সমান সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ, শিক্ষার ভেতরে থাকতে হবে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং নানা ধরনের অতিরিক্ত পাঠক্রমিক কার্যক্রম।

বাংলাদেশের শিক্ষা সংকট: কোথায় আসল সমস্যা?

বাংলাদেশের শিক্ষার আসল সংকট কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে মৌলিক একাডেমিক দক্ষতার ভয়াবহ ঘাটতি। ব্যানবেইস (২০২৩)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু সাবলীলভাবে বাংলা পড়তে অক্ষম, আর পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু মৌলিক অঙ্ক করতে ব্যর্থ। অর্থাৎ, শিক্ষাজীবনের একেবারে ভিত্তি স্তরেই শিশুরা গুরুতরভাবে পিছিয়ে পড়ছে।

শুধু তাই নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় এখনো দ্বিগুণ। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকস (২০২২) জানাচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রাথমিক স্তরে গড় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২৪ হলেও বাংলাদেশে তা গড়ে ১:৪৬। এর ফলে শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

এখানেই শেষ নয়। এএসইআর (বার্ষিক শিক্ষা অবস্থা রিপোর্ট, ২০২২)-এর মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা দেখিয়েছে, গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই স্বচ্ছন্দে পড়তে পারে না। অর্থাৎ, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে কাঠামোগত সংকট আছে, তা শিশুমনের বিকাশের মূল অন্তরায়।

অতএব, বাংলাদেশের শিক্ষার আসল সমস্যাটা হলো, মৌলিক সাক্ষরতা, গণিত দক্ষতা, শিক্ষক ঘাটতি, পাঠ্যক্রমের গুণগত মান এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। অথচ এই গভীর সংকটকে আড়াল করেই যখন সংগীত শিক্ষাকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়, তখন স্পষ্ট বোঝা যায় এটি ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্ন নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক ধর্মব্যবসা।

সংগীত শিক্ষার প্রমাণভিত্তিক সুফল

বিশ্বজুড়ে গবেষণা প্রমাণ করেছে, সংগীত শিক্ষা শিশুদের জ্ঞানীয় বিকাশ, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত করে। ওইসিডি (২০২২) অনুযায়ী, ফিনল্যান্ডে সংগীত শিক্ষার কারণে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে ১৫ শতাংশ বেশি উন্নত হয়। জার্মানির এক গবেষণায় দেখা গেছে, সংগীত শেখা শিশুরা গণিত ও ভাষায় ১৭ শতাংশ ভালো করে। ইউনেস্কো (২০১৯)-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, জাপানে সংগীত শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিশুদের মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি ২০ শতাংশ বেশি শক্তিশালী।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিজ্ঞতা

প্রায়ই সমালোচকরা বলেন, "ওটা পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা, আমাদের সমাজ ভিন্ন, আমরা মুসলিম অধ্যুষিত।” কিন্তু উন্নত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিজ্ঞতা এই যুক্তিকে খণ্ডন করে।

তুরস্কে আতাতুর্কের সময় থেকেই সংগীত শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষার অংশ। আজও সরকারি স্কুলগুলোতে সংগীত, চারুকলা ও নাটক বাধ্যতামূলক। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষকও আছে, সংগীত শিক্ষকও আছে। সমাজে ইসলাম বা নৈতিকতা বিলীন হয়নি; বরং তুরস্ক আন্তর্জাতিক মানের অর্কেস্ট্রা, সিনেমা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার জন্ম দিয়েছে।

মালয়েশিয়ার এডুকেশন ব্লুপ্রিন্ট ২০১৩–২০২৫ অনুযায়ী, সংগীত শিক্ষা "সফট স্কিল ও নৈতিক বিকাশের” অংশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশ সৃজনশীলতাকে নৈতিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ, ইউনেস্কো (২০২১)-এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলছে যে, প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত ও সংস্কৃতি বাধ্যতামূলক, কারণ, এটি শিশুদের কমিউনিটি বন্ডিং ও ধর্মীয় সহনশীলতা শেখায়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর স্কুলগুলোতেও সংগীত ক্লাস বাধ্যতামূলক, যা তারা ‘বিশ্বনাগরিক দক্ষতা'-এর অংশ হিসেবে দেখে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বিদ্যমান, সংগীতও বিদ্যমান, কোনোটাই অন্যটিকে প্রতিস্থাপন করে না। কাতারের ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০-এ বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, শিল্প ও নৈতিকতা একসঙ্গে দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। ফলে সংগীত শিক্ষা সেখানে স্টেম শিক্ষার পাশাপাশি মৌলিক অংশ হিসেবে রয়েছে।এই উদাহরণগুলো থেকে পরিষ্কার যে সংগীত শিক্ষা কোনো ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধের বিপরীতে নয়, বরং তাকে সমৃদ্ধ করে।  

পাকিস্তানে পশতুন স্কুলপড়ুয়াদের দুর্ভোগের এক খণ্ডচিত্র

00:58

This browser does not support the video element.

ধর্মীয় শিক্ষা বনাম সংগীত শিক্ষা: মিথ্যা দ্বন্দ্ব

বিশ্বের বহু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ হোক বা ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিস্টান দেশ, ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণত পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু কোথাওই এটিকে সংগীত, শিল্প, ক্রীড়া বা অন্যান্য সৃজনশীল শিক্ষার বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো হয় না। বরং নীতি থাকে এই যে, শিশু যেন একই সঙ্গে ধর্মীয় নৈতিকতা, বৌদ্ধিক দক্ষতা এবং সৃজনশীল বিকাশ অর্জন করতে পারে।

বাংলাদেশেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বহু বছর ধরেই ধর্মীয় শিক্ষা চালু আছে। ইসলাম শিক্ষা, হিন্দু শিক্ষা, খ্রিস্টান শিক্ষা ও বৌদ্ধ শিক্ষা, সবই জাতীয় কারিকুলামের অংশ। দেশের হাজার হাজার স্কুলে এই শিক্ষা নিয়মিতভাবে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ধর্মীয় শিক্ষার উপস্থিতি নিয়ে কোনো শূন্যতা নেই। ব্যানবেইস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং শিক্ষক পদে নিয়োগও রয়েছে।

যদি আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন হয়, সেটা সরাসরি রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু সেটিকে কেন সংগীত শিক্ষক বাদ দেওয়ার শর্তের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে? এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সংগীতকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি প্রতীকী যুদ্ধের অংশ হিসেবে, যেখানে সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি ও শিল্পচর্চাকে হুমকি হিসেবে দাঁড় করিয়ে এক ধরনের সংকীর্ণ সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

সাংস্কৃতিক হেজেমনি ও সাংস্কৃতিক পুঁজি

আন্তোনিও গ্রামশি তার সাংস্কৃতিক হেজেমনি তত্ত্বে দেখিয়েছেন, ক্ষমতার লড়াই কেবল রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সংস্কৃতি, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনের ভেতরেও ঘটে। সমাজে কোন জ্ঞানকে বৈধ ধরা হবে আর কোন জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করা হবে, এই সিদ্ধান্তও আসলে ক্ষমতার রাজনীতির অংশ। বাংলাদেশের সংগীত শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন সেই প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়। এটি নিছক ধর্মীয় শিক্ষার জায়গা বাড়ানোর দাবি নয়, বরং শিশুদের কল্পনাশক্তি ও সমালোচনামূলক চিন্তার সুযোগ সীমিত করার কৌশল, যাতে একটি একরৈখিক ও আনুগত্যশীল প্রজন্ম তৈরি হয়।

পিয়ের বুর্দিয়ে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ দেন, সাংস্কৃতিক পুঁজি (cultural capital) এর ধারণা। তিনি বলেন, শিক্ষা শুধু জ্ঞান বিতরণের প্রক্রিয়া নয়, বরং সমাজে কারা কী ধরনের সাংস্কৃতিক দক্ষতা অর্জন করবে এবং সেই দক্ষতা দিয়ে সামাজিক মর্যাদা লাভ করবে, এটিও নির্ধারণ করে। সংগীত, শিল্প, সাহিত্য বা নাটক শিশুদের যে সাংস্কৃতিক পুঁজি দেয়, তা তাদের আত্মবিশ্বাস, যোগাযোগক্ষমতা এবং সৃজনশীল চিন্তায় রূপান্তরিত হয়। ফলে যারা সংগীত শিক্ষার বিরোধিতা করছে, তারা আসলে শিশুদের সেই সাংস্কৃতিক পুঁজি অর্জনের পথ বন্ধ করতে চাইছে। এর ফল হবে প্রজন্মকে সীমিত দক্ষতার ভেতর আটকে রাখা, যাতে তারা কেবল আনুগত্য শেখে, কিন্তু নেতৃত্ব, উদ্ভাবন কিংবা সমালোচনামূলক চেতনা অর্জন করতে না পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসেও আমরা সাংস্কৃতিক পুঁজির এই গুরুত্ব দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গান, কবিতা ও নাটক ছিল এক অমূল্য হাতিয়ার, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো,” কিংবা "জয় বাংলা বাংলার জয়” জাতীয় চেতনার চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার পর জাতীয় শিশু-কিশোর সংগীত ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো শিশুদের সমষ্টিগত কল্পনা, দলগত কাজ আর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। খেলাঘর আন্দোলন কিংবা শাপলা শালুকের মতো শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো গান, নাটক ও আবৃত্তির মাধ্যমে শিশুদের সামাজিকীকরণ, মানবিক মূল্যবোধ এবং নেতৃত্ব শেখানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।

পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার

18:51

This browser does not support the video element.

আধুনিক সময়েও এই সাংস্কৃতিক পুঁজির গুরুত্ব সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১ সালে চালু হওয়া নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে ‘কলা ও সংস্কৃতি' (arts and culture) একটি বাধ্যতামূলক উপাদান হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নীতি দলিলে বলা হয়েছে, শিশুদের সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি ও সহযোগিতার মানসিকতা বিকাশের জন্য সংগীত, চারুকলা, নাটক ও নৃত্যকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। একইভাবে প্রতি বছর আয়োজন করা হচ্ছে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতা, যেখানে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক ও নাচের মতো শাখায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এসবই প্রমাণ করে, রাষ্ট্রও বুঝতে পারছে যে শিশুদের বিকাশে সাংস্কৃতিক শিক্ষা অপরিহার্য।

শিশুমনের পূর্ণ বিকাশের প্রশ্ন

শিশু মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুদের কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বিকাশেসংগীতের ভূমিকা অপরিহার্য।এর সঙ্গে যুক্ত হয় শরীরচর্চা, ক্রীড়া, নাটক বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। গবেষণা বলছে, যেসব স্কুলে নিয়মিত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয়, সেখানে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি, পড়াশোনার আগ্রহ এবং মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে ২০–৩০ শতাংশ ভালো থাকে। কাজেই শিশুমনের বিকাশের জন্য, সর্বোপরি সুস্থ দেহ এবং নানা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতিভার বিকাশ নিশ্চিত করতে শিক্ষাঙ্গনে অতিরিক্ত পাঠক্রমিক কার্যক্রম অপরিহার্য।

শুধু একাডেমিক পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ রেখে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে পারব না। শিশুরা খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, শিল্পচর্চা থেকে দলগত কাজ, নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, এসব শিখে। আর এগুলোই একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে দরকার। ইউনেস্কো শিক্ষা কমিশন (২০২১) বলছে, ২১ শতকের শিক্ষার লক্ষ্য শুধু সাক্ষরতা বা গণনাশক্তি নয়; বরং সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তা। এই প্রেক্ষাপটে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বন্ধের দাবি আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার আসল সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, সেই সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংস্কৃতিক সক্ষমতাকে সংকুচিত করার প্রচেষ্টা। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দাবির কাছে নীতিনির্ধারকদের মাথা নোয়ালে, প্রজন্মের কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত সমন্বিত শিক্ষা, ও সমন্বিত বিকাশ । যেহেতু ধর্মীয় শিক্ষা আগে থেকেই বিদ্যমান এবং প্রয়োজন হলে তার আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা করা সম্ভব, তাই সংগীত শিক্ষকের নিয়োগ বন্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং সংগীত ও ধর্মীয় শিক্ষা পাশাপাশি চলা উচিত, কারণ ধর্মীয় শিক্ষা শিশুদের নৈতিকতা শেখাবে, আর সংগীত শিক্ষা বিকশিত করবে তাদের কল্পনাশক্তি, সাংস্কৃতিক পুঁজি ও সৃজনশীলতা। উভয়ের সম্মিলনেই সম্ভব হবে শিশুমনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ।

প্রশ্নটা ধর্ম বনাম সংগীত নয়। শিক্ষানীতির মূল প্রশ্ন হলো, আমরা কী ধরনের প্রজন্ম গড়তে চাই? সংকীর্ণ, একমুখী, আনুগত্যশীল; নাকি বহুমাত্রিক, সৃজনশীল ও বিশ্বনাগরিক? উত্তরটা সেখানেই নিহিত।

লুবনা ফেরদৌসী মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সায়েন্টিস্ট, হাল ইউনিভার্সিটির হেলথ ট্রায়াল ইউনিটে গবেষণা বিজ্ঞানী
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ