শিশুমনের বিকাশ: সংগীত শিক্ষক বিতর্কের অন্তর্নিহিত প্রশ্ন
লুবনা ফেরদৌসী
অতিথি সংবাদভাষ্য
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে সংগীত শিক্ষকের নিয়োগ বন্ধের শর্তে দাঁড় করানো যুক্তিহীন; বরং এটি সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপনের এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল। মনে করেন লুবনা ফেরদৌসী৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বজুড়ে গবেষণা প্রমাণ করেছে, সংগীত শিক্ষা শিশুদের জ্ঞানীয় বিকাশ, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত করে। মনে করেন লুবনা ফেরদৌসীছবি: Md Rafayat Haque Khan/ZUMA Wire/IMAGO
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে ঘিরে সাম্প্রতিক আলোচনায় একটি বিতর্কিত দাবি উঠেছে - সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন এই দাবি তুলেছে, যেন সংগীত শিক্ষা শিশুদের বিকাশের জন্য অপ্রয়োজনীয়, বরং ইসলামবিরোধী।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বহু বছর ধরেই ধর্মীয় শিক্ষার সুসংগঠিত ব্যবস্থা বিদ্যমান। জাতীয় শিক্ষাক্রমে ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত।বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর ২০২৩)- এর তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশেই ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ আছে। সুতরাং আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি তোলা যেতে পারে, কিন্তু সেটিকে সংগীত শিক্ষকের নিয়োগ বন্ধের শর্তে দাঁড় করানো যুক্তিহীন; বরং এটি সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপনের এক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল।
জন ডিউই, প্রগ্রেসিভ শিক্ষার ‘জনক', তার ডেমোক্র্যাসি অ্যান্ড এডুকেশন (১৯১৬) গ্রন্থে বলেছেন, শিক্ষা কেবল তথ্য মুখস্থ করার প্রক্রিয়া নয়, শিক্ষা হলো, শিশুদের অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও সামাজিক বাস্তবতারসঙ্গে যুক্ত করার একটি নিরবচ্ছিন্ন চর্চা। সংগীত, নাটক, ক্রীড়া বা শিল্পচর্চা এই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্র প্রসারিত করে, শিশুদের কল্পনাশক্তি ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ায়।
অন্যদিকে পাওলো ফ্রেইরে তাঁর পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড (১৯৭০) গ্রন্থে দেখিয়েছেন, সংকীর্ণ ও একমুখী শিক্ষা প্রজন্মকে ‘নীরব ভোক্তাতে' পরিণত করে, যেখানে কল্পনা ও সমালোচনামূলক চেতনা দমিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংগীত শিক্ষার বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, এটি ধর্মীয় দাবির চেয়েও বরং এমন এক শিক্ষাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, যা শিশুদের সমালোচনামূলক চেতনাকে সংকুচিত করে এবং আনুগত্যশীল প্রজন্ম তৈরি করে।
এখানে প্রশ্নটা হলো, আমরা শিশুদের শিক্ষাজীবনকে কতটা বৈচিত্র্যময়, সৃজনশীল ও সমন্বিত করতে চাই। ইউনেস্কোর ফিউচার্স অব এডুকেশন (২০১৯) রিপোর্ট বলছে, একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো,শিশুদের এমনভাবে গড়ে তোলা, যাতে তারা শুধু জ্ঞানার্জনই না করে, বরং সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও সামাজিক সহমর্মিতায়ও দক্ষ হয়। একই গবেষণা বলছে, শিশুর সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে তাকে শারীরিক, মানসিক ও সৃজনশীল - এই তিনটি ক্ষেত্রেই সমান সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ, শিক্ষার ভেতরে থাকতে হবে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং নানা ধরনের অতিরিক্ত পাঠক্রমিক কার্যক্রম।
ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সংগীত শেখায় সমস্যা কোথায়?
সংগীত শিক্ষকের বদলে আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রর মতে, এটি বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা। ডয়চে ভেলেকে তাদের মতামত জানালেন বিভিন্ন মানুষ৷
ছবি: Imago/epd
পিছিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
খুবই দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। সংগীত শিক্ষা তো সংস্কৃতি চর্চার অংশ। বিদ্যালয়ে সংস্কৃতি চর্চা হওয়া অত্যান্ত প্রয়োজনীয়। আমরা যে জায়গায় পৌঁছেছিলাম, সেখান থেকে পিছিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা হচ্ছে। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য না। এটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হলে শিক্ষার অগ্রগতিকেই ব্যহত করা হবে।
ছবি: Sirajul Islam Chowdhury
সংগীতকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হচ্ছে: রাশেদা কে চৌধুরী, উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার
সংগীতকে ধর্মের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা হচ্ছে। যারা সংগীত বাদ দিয়ে ধর্ম শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার দাবি করছে, তারা আসলে চাইতে পারতেন সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হোক। যেখানে ধর্মীয় শিক্ষক নেই, সেগুলো দ্রুত পূরণ করা হোক। তা না করে শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হচ্ছে। এতে শিক্ষা ব্যবস্থাই পিছিয়ে যাবে। সংগীত একটা বাচ্চার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার জীবন গঠনে ভূমিকা রাখে।
ছবি: bdnews24.com
প্রতিটি স্কুলে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে: অ্যাডভোকেট সালমা আলী, উপদেষ্টা, মহিলা আইনজীবী সমিতি
প্রতিটি স্কুলে সংগীত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ছোট বাচ্চারা তো পরিবার থেকেই ধর্ম শিক্ষা পায়। তাই বরং সব স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। যেখানে স্কুলে ধর্ম শিক্ষা তুলে দেওয়ার দাবি ওঠার কথা, সেখানে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, শিশুর বিকাশের জন্য অবশ্যই সংগীত শিক্ষা থাকতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
ছবি: privat
বিরোধিতাকারীরা কূপমণ্ডুকতা করছে: শিরিন হক, নারী সংস্কার কমিশনের প্রধান
সরকার সংগীতের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে আমি স্বাগত জানাই। গ্রামের স্কুলগুলোতে তো গরিব শিক্ষার্থীরা সংস্কৃতি চর্চার বাইরে থাকে। যারা বিরোধিতা করছে, তারা কূপমণ্ডুকতা করছে। মানুষের জীবনে ধর্মীয় শিক্ষার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি সংস্কৃতি চর্চারও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের বিরোধিতা করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের যে দাবি করা হচ্ছে, সেটা একেবারেই অমূলক।
ছবি: Shirin Parvin Haque
সমাজকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র: ডা. ফওজিয়া মোসলেম, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
আমি নিজেই একটি স্কুল কমিটির দায়িত্বে আছি। সেখানে আমি দেখেছি, ধর্মীয় শিক্ষকের পোস্ট সেখানে আছে, সংগীত শিক্ষকের পোস্টও আছে। সংগীত শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিরোধ নেই। বরং সংগীত শিক্ষা না থাকাটা সমাজকে অনেক পিছিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজকে সামনে নিতে সংগীতের চর্চাটা খুবই দরকার। যারা এর বিরোধিতা করছেন, তারা অত্যন্ত অন্যায়ভাবে বিরোধিতা করছেন। সমাজকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার একটা ষড়যন্ত্র বলে আমি মনে করি।
ছবি: DW
সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক থাকা উচিত: মাইনুল হাসান সোহেল, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি
বাংলা, অংক ও ইংরেজির মতো মৌলিক শিক্ষায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশ দুর্বল। এটা নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। সরকারের উচিত, প্রাথমিক স্তরে সংগীতের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগসহ মৌলিক শিক্ষার মান বাড়াতে সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
ছবি: Private
‘সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল’ করতে হবে এমন দাবি জবরদখলী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ: জাবির আহমেদ জুবেল, সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী
সারা বিশ্বেই প্রাথমিকে শিশুকে সংগীতসহ ললিতকলায় পারদর্শী করে তোলায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশে যখন প্রাথমিক শিক্ষায় এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, তখন ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে বিরোধিতা করছেন, তা অবান্তর। সকল ধর্মের ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ হতেই পারে, কিন্তু ‘সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বাতিল’ করতে হবে এমন দাবি শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং জবরদখলী সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ।
ছবি: Privat
সংস্কৃতি একটি জাতির অস্তিত্ব ও আত্মার প্রকাশ: তাকিম শেখ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মুক্তচিন্তার জায়গা, যেখানে একজন শিশু স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠবে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে, যার মাধ্যমে একজন শিশু ধর্মীয় মূল্যবোধ, ধর্মীয় জ্ঞান, আচার-আচরণ শিখবে। আবার সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাও থাকবে। বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি, লোকসংগীত, নৃত্য, বাউল, ভাটিয়ালি, জারি-সারি, যাত্রাপালা যা নদীমাতৃক এই দেশের মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
ছবি: Privat
সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব থাকলেও ধর্মের অনুসারীদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে: মুহাম্মদ মুঈনুদ্দিন গাউছ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ অপরিহার্য। অথচ ধর্মীয় শিক্ষকের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সংগীত শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব থাকলেও দেশের নব্বই ভাগ মানুষ যে ধর্মের অনুসারী, তাদের মতামত উপেক্ষা করা হচ্ছে। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের বিপরীতে গিয়ে দেশে নতুন সমস্যা তৈরি না করে।
শুধু ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধ নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল জগত সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। ধর্ম শিক্ষকেরা যেমন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক গড়ে দেন, তেমনি সংগীত শিক্ষক শিক্ষার্থীর শিল্প-সংবেদন ও সৃজনশীলতাকে বিকশিত করতে পারেন। তাই আমি মনে করি, ধর্ম শিক্ষার ক্ষেত্রে যেমন কাউকে বাধা দেওয়া উচিত না, তেমনি যে সংগীত শিখতে চায়, তাকেও সেই সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
ছবি: privat
যদি নতুন কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কেন নয়: হোমায়রা আশরাফ অর্নি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই একজন শিক্ষার্থীর আসল বিকাশ ঘটে, আপনি বাচ্চাকে যা শেখাচ্ছেন পরবর্তীতে তা নিয়েই তার আগ্রহ বাড়বে, সেই বিষয়ে কাজ করবে। আমার মতে, এই বয়সে সকল কিছু সম্পর্কে শিক্ষার্থীর ধারণা থাকা দরকার। ধর্মীয় শিক্ষক প্রতি বিদ্যালয়েই রয়েছে, যদি নতুন কোনো জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়, তাহলে কেন নয়?
ছবি: privat
11 ছবি1 | 11
বাংলাদেশের শিক্ষা সংকট: কোথায় আসল সমস্যা?
বাংলাদেশের শিক্ষার আসল সংকট কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে মৌলিক একাডেমিক দক্ষতার ভয়াবহ ঘাটতি। ব্যানবেইস (২০২৩)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের তৃতীয় শ্রেণির প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু সাবলীলভাবে বাংলা পড়তে অক্ষম, আর পঞ্চম শ্রেণির প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু মৌলিক অঙ্ক করতে ব্যর্থ। অর্থাৎ, শিক্ষাজীবনের একেবারে ভিত্তি স্তরেই শিশুরা গুরুতরভাবে পিছিয়ে পড়ছে।
শুধু তাই নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় এখনো দ্বিগুণ। ইউনেস্কো ইনস্টিটিউট ফর স্ট্যাটিস্টিকস (২০২২) জানাচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রাথমিক স্তরে গড় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২৪ হলেও বাংলাদেশে তা গড়ে ১:৪৬। এর ফলে শিক্ষার্থীদের প্রতি ব্যক্তিগত মনোযোগ প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
এখানেই শেষ নয়। এএসইআর (বার্ষিক শিক্ষা অবস্থা রিপোর্ট, ২০২২)-এর মাঠপর্যায়ের সমীক্ষা দেখিয়েছে, গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই স্বচ্ছন্দে পড়তে পারে না। অর্থাৎ, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে কাঠামোগত সংকট আছে, তা শিশুমনের বিকাশের মূল অন্তরায়।
অতএব, বাংলাদেশের শিক্ষার আসল সমস্যাটা হলো, মৌলিক সাক্ষরতা, গণিত দক্ষতা, শিক্ষক ঘাটতি, পাঠ্যক্রমের গুণগত মান এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। অথচ এই গভীর সংকটকে আড়াল করেই যখন সংগীত শিক্ষাকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দেওয়া হয়, তখন স্পষ্ট বোঝা যায় এটি ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্ন নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক ধর্মব্যবসা।
খেলাধুলার জগতে শিশু প্রতিভা
আইপিএলে ইতিহাস গড়া ১৪ বছরের বৈভব সূর্যবংশী মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কেউ কেউ খুব কম বয়সেই কতটা অসাধারণ হতে পারেন।
ছবি: Surjeet Yadav/AP Photo/picture alliance
বৈভব সূর্যবংশী
মাত্র ১৪ বছর ৩২ দিন বয়সে টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি করা সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হয়েছেন ভারতীয় ব্যাটার বৈভব সূর্যবংশী। ২০২৫ সালের এপ্রিলে তিনি আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি করেন। শতরানের মাইলফলকে পৌঁছান মাত্র ৩৫ বল খেলে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ১৩ বছর বয়সে তিনি আইপিএলের নিলামে বিক্রি হওয়া সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হন। তার দাম উঠেছিল প্রায় সোয়া এক কোটি টাকা।
ছবি: Surjeet Yadav/AP Photo/picture alliance
ফ্রানৎসিসকা ফান আল্মসিক
১৯৯২ সালের বার্সেলোনা অলিম্পিক গেমসে ১৪ বছর বয়সি জার্মান সাঁতারু ‘ফ্রানৎসি’ দর্শকদের মুগ্ধ করে চারটি রৌপ্যপদক জিতেছিলেন। তবে গণমাধ্যম সবসময় ফ্রানৎসিসকার প্রতি সদয় ছিল না, বিশেষ করে যখন খেলার ফল তার পক্ষে যায়নি। তিনি দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ১৮ বার ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হলেও তার অলিম্পিক স্বর্ণপদকের স্বপ্ন কখনো পূরণ হয়নি।
ছবি: Werek/picture-alliance
বরিস বেকার
১৭ বছর ২২৭ দিন বয়সে উইম্বলডনে পুরুষদের শিরোপা জিতেছিলেন জার্মানির বরিস বেকার। এখনও সবচেয়ে কম বয়সে উইম্বলডন জেতা পুরুষ খেলোয়াড় তিনি। বেকার আরো পাঁচটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা জিতেছিলেন এবং ১৯৯২ সালে বার্সেলোনায় অলিম্পিক ডাবলসেরও স্বর্ণপদক জেতেন। অবসর নেওয়ার পর থেকে অবশ্য প্রায়ই নেতিবাচক কারণেই সংবাদের শিরোনামে এসেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বিবাহবিচ্ছেদ, দেউলিয়াত্ব এবং এমনকি কারাদণ্ডও।
ছবি: Steve Powell/Getty Images
স্টেফি গ্রাফ
স্টেফিকে এই ছবিতে ১১ বছর বয়সে জার্মান চ্যাম্পিয়নশিপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা যাচ্ছে। ১৩ বছর বয়সে স্টেফি পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে ডাব্লিউটিএ ট্যুরে খেলেন। ১৯৮৭ সালে ১৭ বছর বয়সে তিনি ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন। তার জেতা ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে এটি ছিল প্রথম। ১৯৮৮ সালে গ্রাফ একই বছরে চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম এবং একটি অলিম্পিক একক স্বর্ণপদক জিতে ঐতিহাসিক ‘গোল্ডেন স্ল্যাম’ অর্জন করেন।
ছবি: Herbert Rudel/picture alliance
ওয়েইন গ্রেটসৎকি
১৯৭৮ সালে ১৭ বছর বয়সে ওয়েইন ওয়ার্ল্ড হকি অ্যাসোসিয়েশনের ইন্ডিয়ানাপোলিস রেসার্সের হয়ে পেশাদার খেলায় অভিষিক্ত হন। পরবর্তী মৌসুমে তিনি এডমন্টন অয়েলার্সের হয়ে তার এনএইচএল অভিষেক করেন। ৮৯৪টি গোল এবং ১,৯৬৩টি অ্যাসিস্টের সঙ্গে মোট ২,৮৫৭ পয়েন্টসহ (নিয়মিত মৌসুম) এনএইচএলের এখনো সর্বকালের সেরা স্কোরারের রেকর্ড রয়েছে ওয়েইনের দখলে। অসংখ্য অর্জনের মধ্যে চারটি স্ট্যানলি কাপ জয়ও আছে এই ক্যানাডিয়ানের।
ছবি: Reed Saxon/AP/picture alliance
লেব্রন জেমস
ক্যানাডার ওয়েইন গ্রেটসৎকির মতো জেমস (ডানদিকে) কিশোর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে বিখ্যাত ছিলেন। ভবিষ্যতের এই সুপারস্টারের হাই স্কুলে থাকা অবস্থায় কিছু খেলা জাতীয় টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল। ২০০৩ সালে জেমস স্কুল থেকেই সরাসরি এনবিএতে যোগ দেন। তিনি চারবারের এনবিএ চ্যাম্পিয়ন হন, অসংখ্য ব্যক্তিগত পুরষ্কার অর্জন করেন এবং ২০২৩ সালে লীগের সর্বকালের শীর্ষস্থানীয় স্কোরার হন।
ছবি: picture-alliance/ASA/Icon Sports
লুক লিটলার
২০২৩ সালে উত্তর লন্ডনে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অভিষেকেই বিশেষজ্ঞদের অবাক করে দিয়েছিলেন লুক। ১৬ বছর বয়সি এই খেলোয়াড় একের পর এক প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে দৃঢ় মনোবল প্রদর্শন করেছিলেন। ফাইনালে ওঠার পর তিনি বলেছিলেন, "আমাকে থামাতে অনেক কিছু করতে হবে।" অবশ্য ফাইনালে তার প্রতিপক্ষ আরেক লুক- লুক হামফ্রিসের কাছে লুক লিটলার ৭-৪ ব্যবধানে হেরে গিয়েছিলেন। এখন বিশ্ব ব়্যাংকিংয়ে লুক লিটলারের অবস্থান দ্বিতীয়।
ছবি: Kin Cheung/AP/picture alliance
নাদিয়া কোমানেচি
১৯৭৬ সালে ক্যানাডার মন্ট্রিলে শক্তি গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকসে জিমন্যাস্টিক্সের সময়কাল ১৪ বছর পুরানো গেমি এই কিশোরী তৎপরতা শিখেছিলেন ১০-এ ১০। ইতিহাসের প্রথম জিমন্যাস্ট হিসাবে নিখুত স্কোর অর্জন করেন নাদিয়া। এই রোমানিয়ান জিমনস্ট ১৯৮০ সালে মিন্ট্রিলে পার্ক এবং ১৯৮৪-তে মস্কোতে আরো স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি তার জিমন্যাক্স কোম্পানির সমপ্ত ঘটান।
ছবি: Paul Vathis/AP/picture alliance
ইয়ান থার্প
১৯৮৮ সালে ১৫ বছর বয়সে প্রথম শুরুর মতো বিশ্ব সম্প্রদায় হন ইয়ান থার্প। তিনি আরো ১০টি বিশ্ব সম্প্রদায়শিপ এবং পাঁচটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। তবে এই অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারু নিরাপত্তা হশা এবং অ্যালকো আসক্তির সাথে লড়াই করে। আপনি ধরেছিলেন তার সমকামিতা গোপন করেছিলেন। সাঁতার থেকে অবসর নেওয়ার দুই বছর পরে এবং ২০১৪ সালে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন।
ছবি: Laci Perenyi/IMAGO
মাক্স ফেরস্টাপেন
২০১৫ সালে যখন এই ডাচম্যান তার প্রথম ফর্মুলা ওয়ান রেসে অংশ নিয়েছিলেন তখন প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। ১৭ বছর ১৬৬ দিন বয়সে ফেরস্টাপেনের ড্রাইভিং লাইসেন্সই ছিল না। ফর্মুলা ওয়ানের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ চালকে পরিণত হন তিনি। মেলবোর্নে তার প্রথম রেসটি ৩৪ ল্যাপের পরে ইঞ্জিনের ক্ষতির কারণে শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ফর্মুলা ওয়ান ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গ্রঁ প্রিঁ বিজয়ী এবং তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন ফেরস্টাপেন।
ছবি: Srdjan Suki/dpa/picture alliance
আরমান্ড ডুপ্লান্টিস
সুইডিশ-অ্যামেরিকান এই পোল ভল্টারের ছোটবেলা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, তার ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল। মাত্র সাত বছর বয়সেই বিশ্বসেরা রেকর্ড করেন ডুপ্লান্টিস। ছয় বছর পর তিনি সাতটি বয়সভিত্তিক বিশ্ব রেকর্ড নিজের করে নেন। প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে তিনি অলিম্পিক, বিশ্ব এবং ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হন। ইনডোরে ৬ দশমিক ২২ মিটার এবং আউটডোরে ৬ দশমিক ২৩ মিটারের বিশ্ব রেকর্ড তার দখলে।
ছবি: Matthias Schrader/AP Photo/picture alliance
11 ছবি1 | 11
সংগীত শিক্ষার প্রমাণভিত্তিক সুফল
বিশ্বজুড়ে গবেষণা প্রমাণ করেছে, সংগীত শিক্ষা শিশুদের জ্ঞানীয় বিকাশ, স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা উন্নত করে। ওইসিডি (২০২২) অনুযায়ী, ফিনল্যান্ডে সংগীত শিক্ষার কারণে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে ১৫ শতাংশ বেশি উন্নত হয়। জার্মানির এক গবেষণায় দেখা গেছে, সংগীত শেখা শিশুরা গণিত ও ভাষায় ১৭ শতাংশ ভালো করে। ইউনেস্কো (২০১৯)-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, জাপানে সংগীত শিক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিশুদের মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি ২০ শতাংশ বেশি শক্তিশালী।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিজ্ঞতা
প্রায়ই সমালোচকরা বলেন, "ওটা পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা, আমাদের সমাজ ভিন্ন, আমরা মুসলিম অধ্যুষিত।” কিন্তু উন্নত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের অভিজ্ঞতা এই যুক্তিকে খণ্ডন করে।
তুরস্কে আতাতুর্কের সময় থেকেই সংগীত শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষার অংশ। আজও সরকারি স্কুলগুলোতে সংগীত, চারুকলা ও নাটক বাধ্যতামূলক। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষকও আছে, সংগীত শিক্ষকও আছে। সমাজে ইসলাম বা নৈতিকতা বিলীন হয়নি; বরং তুরস্ক আন্তর্জাতিক মানের অর্কেস্ট্রা, সিনেমা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার জন্ম দিয়েছে।
মালয়েশিয়ার এডুকেশন ব্লুপ্রিন্ট ২০১৩–২০২৫ অনুযায়ী, সংগীত শিক্ষা "সফট স্কিল ও নৈতিক বিকাশের” অংশ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশ সৃজনশীলতাকে নৈতিক বিকাশের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ, ইউনেস্কো (২০২১)-এর রিপোর্টে স্পষ্ট বলছে যে, প্রাথমিক শিক্ষায় সংগীত ও সংস্কৃতি বাধ্যতামূলক, কারণ, এটি শিশুদের কমিউনিটি বন্ডিং ও ধর্মীয় সহনশীলতা শেখায়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)-এর স্কুলগুলোতেও সংগীত ক্লাস বাধ্যতামূলক, যা তারা ‘বিশ্বনাগরিক দক্ষতা'-এর অংশ হিসেবে দেখে। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা বিদ্যমান, সংগীতও বিদ্যমান, কোনোটাই অন্যটিকে প্রতিস্থাপন করে না। কাতারের ন্যাশনাল ভিশন ২০৩০-এ বলা হয়েছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান, শিল্প ও নৈতিকতা একসঙ্গে দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। ফলে সংগীত শিক্ষা সেখানে স্টেম শিক্ষার পাশাপাশি মৌলিক অংশ হিসেবে রয়েছে।এই উদাহরণগুলো থেকে পরিষ্কার যে সংগীত শিক্ষা কোনো ধর্মীয় বা নৈতিক মূল্যবোধের বিপরীতে নয়, বরং তাকে সমৃদ্ধ করে।
পাকিস্তানে পশতুন স্কুলপড়ুয়াদের দুর্ভোগের এক খণ্ডচিত্র
00:58
This browser does not support the video element.
ধর্মীয় শিক্ষা বনাম সংগীত শিক্ষা: মিথ্যা দ্বন্দ্ব
বিশ্বের বহু দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ হোক বা ইউরোপ-আমেরিকার খ্রিস্টান দেশ, ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণত পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু কোথাওই এটিকে সংগীত, শিল্প, ক্রীড়া বা অন্যান্য সৃজনশীল শিক্ষার বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো হয় না। বরং নীতি থাকে এই যে, শিশু যেন একই সঙ্গে ধর্মীয় নৈতিকতা, বৌদ্ধিক দক্ষতা এবং সৃজনশীল বিকাশ অর্জন করতে পারে।
বাংলাদেশেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বহু বছর ধরেই ধর্মীয় শিক্ষা চালু আছে। ইসলাম শিক্ষা, হিন্দু শিক্ষা, খ্রিস্টান শিক্ষা ও বৌদ্ধ শিক্ষা, সবই জাতীয় কারিকুলামের অংশ। দেশের হাজার হাজার স্কুলে এই শিক্ষা নিয়মিতভাবে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, ধর্মীয় শিক্ষার উপস্থিতি নিয়ে কোনো শূন্যতা নেই। ব্যানবেইস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং শিক্ষক পদে নিয়োগও রয়েছে।
যদি আরো ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন হয়, সেটা সরাসরি রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু সেটিকে কেন সংগীত শিক্ষক বাদ দেওয়ার শর্তের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে? এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সংগীতকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি প্রতীকী যুদ্ধের অংশ হিসেবে, যেখানে সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি ও শিল্পচর্চাকে হুমকি হিসেবে দাঁড় করিয়ে এক ধরনের সংকীর্ণ সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বিজ্ঞাপন
সাংস্কৃতিক হেজেমনি ও সাংস্কৃতিক পুঁজি
আন্তোনিও গ্রামশি তার সাংস্কৃতিক হেজেমনি তত্ত্বে দেখিয়েছেন, ক্ষমতার লড়াই কেবল রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা সংস্কৃতি, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনের ভেতরেও ঘটে। সমাজে কোন জ্ঞানকে বৈধ ধরা হবে আর কোন জ্ঞানকে অবমূল্যায়ন করা হবে, এই সিদ্ধান্তও আসলে ক্ষমতার রাজনীতির অংশ। বাংলাদেশের সংগীত শিক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন সেই প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়। এটি নিছক ধর্মীয় শিক্ষার জায়গা বাড়ানোর দাবি নয়, বরং শিশুদের কল্পনাশক্তি ও সমালোচনামূলক চিন্তার সুযোগ সীমিত করার কৌশল, যাতে একটি একরৈখিক ও আনুগত্যশীল প্রজন্ম তৈরি হয়।
পিয়ের বুর্দিয়ে এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ দেন, সাংস্কৃতিক পুঁজি (cultural capital) এর ধারণা। তিনি বলেন, শিক্ষা শুধু জ্ঞান বিতরণের প্রক্রিয়া নয়, বরং সমাজে কারা কী ধরনের সাংস্কৃতিক দক্ষতা অর্জন করবে এবং সেই দক্ষতা দিয়ে সামাজিক মর্যাদা লাভ করবে, এটিও নির্ধারণ করে। সংগীত, শিল্প, সাহিত্য বা নাটক শিশুদের যে সাংস্কৃতিক পুঁজি দেয়, তা তাদের আত্মবিশ্বাস, যোগাযোগক্ষমতা এবং সৃজনশীল চিন্তায় রূপান্তরিত হয়। ফলে যারা সংগীত শিক্ষার বিরোধিতা করছে, তারা আসলে শিশুদের সেই সাংস্কৃতিক পুঁজি অর্জনের পথ বন্ধ করতে চাইছে। এর ফল হবে প্রজন্মকে সীমিত দক্ষতার ভেতর আটকে রাখা, যাতে তারা কেবল আনুগত্য শেখে, কিন্তু নেতৃত্ব, উদ্ভাবন কিংবা সমালোচনামূলক চেতনা অর্জন করতে না পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসেও আমরা সাংস্কৃতিক পুঁজির এই গুরুত্ব দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গান, কবিতা ও নাটক ছিল এক অমূল্য হাতিয়ার, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো,” কিংবা "জয় বাংলা বাংলার জয়” জাতীয় চেতনার চালিকাশক্তি। স্বাধীনতার পর জাতীয় শিশু-কিশোর সংগীত ও সাংস্কৃতিক উৎসবগুলো শিশুদের সমষ্টিগত কল্পনা, দলগত কাজ আর আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। খেলাঘর আন্দোলন কিংবা শাপলা শালুকের মতো শিশু-কিশোর সংগঠনগুলো গান, নাটক ও আবৃত্তির মাধ্যমে শিশুদের সামাজিকীকরণ, মানবিক মূল্যবোধ এবং নেতৃত্ব শেখানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।
পারিবারিক সহিংসতার শেকড় এবং বিস্তার
18:51
This browser does not support the video element.
আধুনিক সময়েও এই সাংস্কৃতিক পুঁজির গুরুত্ব সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১ সালে চালু হওয়া নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমে ‘কলা ও সংস্কৃতি' (arts and culture) একটি বাধ্যতামূলক উপাদান হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নীতি দলিলে বলা হয়েছে, শিশুদের সৃজনশীলতা, কল্পনাশক্তি ও সহযোগিতার মানসিকতা বিকাশের জন্য সংগীত, চারুকলা, নাটক ও নৃত্যকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য। একইভাবে প্রতি বছর আয়োজন করা হচ্ছে জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতা, যেখানে সংগীত, আবৃত্তি, নাটক ও নাচের মতো শাখায় লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। এসবই প্রমাণ করে, রাষ্ট্রও বুঝতে পারছে যে শিশুদের বিকাশে সাংস্কৃতিক শিক্ষা অপরিহার্য।
শিশুমনের পূর্ণ বিকাশের প্রশ্ন
শিশু মনোবিজ্ঞানীদের মতে, শিশুদের কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বিকাশেসংগীতের ভূমিকা অপরিহার্য।এর সঙ্গে যুক্ত হয় শরীরচর্চা, ক্রীড়া, নাটক বা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। গবেষণা বলছে, যেসব স্কুলে নিয়মিত ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয়, সেখানে শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি, পড়াশোনার আগ্রহ এবং মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে ২০–৩০ শতাংশ ভালো থাকে। কাজেই শিশুমনের বিকাশের জন্য, সর্বোপরি সুস্থ দেহ এবং নানা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রতিভার বিকাশ নিশ্চিত করতে শিক্ষাঙ্গনে অতিরিক্ত পাঠক্রমিক কার্যক্রম অপরিহার্য।
শুধু একাডেমিক পাঠ্যক্রমে সীমাবদ্ধ রেখে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে পারব না। শিশুরা খেলাধুলা, সংগীত, নাটক, শিল্পচর্চা থেকে দলগত কাজ, নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, এসব শিখে। আর এগুলোই একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে দরকার। ইউনেস্কো শিক্ষা কমিশন (২০২১) বলছে, ২১ শতকের শিক্ষার লক্ষ্য শুধু সাক্ষরতা বা গণনাশক্তি নয়; বরং সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তা। এই প্রেক্ষাপটে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ বন্ধের দাবি আসলে শিক্ষা ব্যবস্থার আসল সংকট থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা, সেই সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাংস্কৃতিক সক্ষমতাকে সংকুচিত করার প্রচেষ্টা। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দাবির কাছে নীতিনির্ধারকদের মাথা নোয়ালে, প্রজন্মের কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশের শিক্ষানীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত সমন্বিত শিক্ষা, ও সমন্বিত বিকাশ । যেহেতু ধর্মীয় শিক্ষা আগে থেকেই বিদ্যমান এবং প্রয়োজন হলে তার আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা করা সম্ভব, তাই সংগীত শিক্ষকের নিয়োগ বন্ধ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং সংগীত ও ধর্মীয় শিক্ষা পাশাপাশি চলা উচিত, কারণ ধর্মীয় শিক্ষা শিশুদের নৈতিকতা শেখাবে, আর সংগীত শিক্ষা বিকশিত করবে তাদের কল্পনাশক্তি, সাংস্কৃতিক পুঁজি ও সৃজনশীলতা। উভয়ের সম্মিলনেই সম্ভব হবে শিশুমনের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ।
প্রশ্নটা ধর্ম বনাম সংগীত নয়। শিক্ষানীতির মূল প্রশ্ন হলো, আমরা কী ধরনের প্রজন্ম গড়তে চাই? সংকীর্ণ, একমুখী, আনুগত্যশীল; নাকি বহুমাত্রিক, সৃজনশীল ও বিশ্বনাগরিক? উত্তরটা সেখানেই নিহিত।
নারী ও শিশু সুরক্ষা নিয়ে সচেতন নাগরিকদের ভাবনা
নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার কিছু উপায়ের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের কয়েকজন সচেতন নাগরিক৷ চলুন জেনে নেই তাদের ভাবনা৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
‘মানুষের মনোগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি’
মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান মনে করেন, ‘‘নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কম তো আইন প্রণীত হয়নি৷ কিন্তু সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়নি বলে নারী ও শিশুরা বারবার সহিংসতা, যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷ সবচেয়ে জরুরি হলো আপামর মানুষের মনোগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন৷ মানুষরূপী মুখোশের আড়ালে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, আর হীনমন্যতা কাজ করলে সমাজে শুধু নারী, শিশু নয়, কোনো প্রগতিশীল মানুষই নিরাপদ থাকবেন না৷’’
ছবি: DW
‘নারী ও শিশু নিরাপত্তা আইন জোরদার করতে হবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অদ্বিতীয়া বলেন, ‘‘নারী ও শিশু নিরাপত্তা আইন জোরদার করতে হবে৷ তাদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালু করতে হবে৷ পাশাপাশি তারা যেনো নিজেদের রক্ষা করতে পারে এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে৷’’
ছবি: DW
‘সাদা পোশাকে টহল নিশ্চিত করতে হবে’
অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মনে করেন, নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় আইনের দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ করতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো সক্রিয় হতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা স্তরে সাদা পোশাকে টহল নিশ্চিত করতে হবে৷ টহলরতদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাথে বা নিজেদের মধ্যে কনফারেন্স কল বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে সর্বদা যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখতে হবে৷’’
ছবি: DW
‘পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন’
চিকিৎসক সিফাত নাহার বলেন, ‘‘নারী ও শিশুদের সুরক্ষার জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং তার যথাযথ প্রয়োগ যা একটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব৷ এর পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা খুবই প্রয়োজন৷ এছাড়াও বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন কমিয়ে দেশীয় সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও আচার ব্যবহারের প্রচলন বাড়ানো প্রয়োজন৷’’
ছবি: DW
‘স্কুল পর্যায়ে লিঙ্গ সমতা ও নৈতিক শিক্ষা দরকার’
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক বিপাশা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বাংলাদেশে নারী ও শিশু সুরক্ষায় বিদ্যমান আইনগুলো আরও কার্যকর করতে হবে৷ নতুন আইন প্রণয়ন করাও জরুরি৷ পাশাপাশি নীতি নির্ধারণে নারী ও শিশুর অধিকারকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন৷ এছাড়া জনগণের মধ্যে ব্যাপক আকারে সচেতনতা তৈরি করতে হবে৷ বিশেষত, স্কুল পর্যায়ে লিঙ্গ সমতা ও নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ৷’’
ছবি: DW
‘শুধু কঠোর আইন সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না’
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী তায়্যিব-উল-ইসলাম সৌরভ বলেন, ‘‘আমি মনে করি না যে শুধু কঠোর আইন করেই নারী ও শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে৷ সবার আগে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, যেটি আমাদের মতো দেশে অনেক অভাব রয়েছে৷ আইনের কথা বলতে গেলে, ভুক্তভোগী এবং সাক্ষীর নিরাপত্তা ও সহায়তা বৃদ্ধি এবং ওয়ানস্টপ সাপোর্ট সেন্টার কার্যকর করতে হবে৷’’
ছবি: DW
‘সার্বিক পরিবেশ নারী ও শিশু অধিকারবান্ধব হতে হবে’
উদ্যোক্তা সোনিয়া সরকার সনি বলেন, ‘‘নারী আর শিশুদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক সুরক্ষায় সরকারকে আরও বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে৷ তা না হলে আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে বেশ বেগ পেতে হবে৷ সামাজিক আর পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ দেশের সার্বিক পরিবেশ নারী আর শিশু অধিকারবান্ধব হতে হবে৷’’
ছবি: DW
‘শিশু নির্যাতন হলে বিচার দ্রুত করতে হবে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব বলেন, ‘‘বর্তমানে যে আইনগুলি আছে তা যেন শুধু কাগজে না থাকে৷ এগুলো যত দ্রুত সম্ভব যথার্থভাবে কার্যকর করতে হবে৷ নারী এবং শিশু সবার ক্ষেত্রে যেন দ্রুত কার্যকর করা হয়৷ শিশুদের ক্ষেত্রে যেন জেন্ডার বেজড কোনো বিচার না হয়৷ শিশুরা যে জেন্ডারই হোক না কেন তাদের উপর কোনো নির্যাতন হলে তার বিচার দ্রুত করতে হবে৷’’
ছবি: DW
‘দায়িত্বের অবহেলা’
অটোচালক মো: জসিম উদ্দিন বলেন, ‘‘এমন একটা আইন পাস করতে হবে যাতে করে দ্রুত বিচার করা যাবে৷ কোনোভাবেই এর শাস্তি ঝুলিয়ে রাখা যাবে না৷ নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা সঠিকভাবে না দেয়ার জন্য দায়ী হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থা এবং জনগণ এর দায়িত্বের প্রতি অবহেলা৷ উন্নত দেশগুলোতে কোন সমস্যা হলে সবাই একসাথে কাজ করে, যা আমাদের দেশে তেমন দেখা যায় না৷ আমরা কেউ কারো বিপদে এগিয়ে যেতে চাই না৷’’
ছবি: DW
‘আমাদের সব ব্যবস্থা রয়েছে’
অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ বলেন, ‘‘নারী এবং শিশুর নিরাপত্তা রক্ষা না শুধু, একটি রাষ্ট্রের জনগণ এবং জীববৈচিত্র রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর৷ জনগণ হিসেবে আমাদের অধিকার এবং রাষ্ট্রের তা দায়িত্ব৷ আমাদের যে সকল বিভিন্ন হটলাইন রয়েছে, সে সকল হটলাইন গুলোকে অ্যাকটিভ থাকতে হবে৷ আমাদের সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে৷ জনগণ হিসেবে আমরা সেই সকল ব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত না৷’’