পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই মেয়ে শিশু৷ এছাড়া শিশু ধর্ষণ এবং শিশুর প্রতি সহিংসতার নেপথ্যে রয়েছে আইনি দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা৷ শিশুরা দুর্বল হওয়ায় সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
১৬ বছর আগের কথা৷ বাংলাদেশের মানিকগঞ্জে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে নিম্ন
আদালত আসামি শুক্কুরের মৃত্যুদণ্ড দিলেও, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তার রিভিউ রায়ে সাজা কমিয়েছে৷ ধর্ষণের সময় আসামি শুক্কুরের বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর৷ তাই সোমবার তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১২ই জুলাই মানিকগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল শুক্কুরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল৷
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই মামলাটিই প্রমাণ করে যে একটি ধর্ষণের মামলার চূড়ান্ত রায় পেতে ১৮ থেকে ২০ বছর লেগে যায়৷ আর এই দীর্ঘসূত্রিতা ধর্ষণের মামলায় বাদিকে হতাশ করে দেয়৷ অনেকেই মাঝপথে মামলা পরিচালনা থেকে সরে দাঁড়ান৷''
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর হিউম্যান রাইটস মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৮ সালে ৪৫৪ জন ধর্ষণের শিকার হয় বাংলাদেশে৷ এদের মধ্যে ২৫২ জন শিশু৷ ২০০৯ সালে ধর্ষণের শিকার ৪৫৬ জনের মধ্যে ছিল ২৪৩ জন শিশু৷ এরপর ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যা ছিল ২৯৯ জন ও শিশু ৪৭৩ জন৷ ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৭৩ জন, যার মধ্যে ছিল ৩৮৫ জন শিশু৷ আর ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ৫৫৬ জন৷ এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৩০৮৷
এই পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এলিনা খান বলেন, ‘‘শিশু ধর্ষণ এবং শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে৷ দেশে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই৷ শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অনেক সময় তো থানায় অভিযোগই করা হয় না৷''
ধর্ষণের ঘটনায় ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার' থেকে যেসব মামলায় সহযোগিতা করা হয়েছে, সেই সব মামলার হিসাব থেকে জানা যায়, ‘‘গত ১০ বছরে ঢাকায় ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩,৯৮০টি৷ মামলা হয়েছে ১,৫৫৬টি, অথচ শাস্তি হয়েছে মাত্র ৪০টি ঘটনায়৷''
শিশুদের বিষণ্ণতার ৬টি কারণ
বিষণ্ণতা কিশোর-কিশোরীদের আত্মহননের পথেও ঠেলে দেয়৷ তাই সন্তানকে শুধু ভালোবাসলেই চলবে না, খেয়াল রাখতে হবে বিষণ্ণতায় ডুবে যাওয়ার মতো কারণ থেকেও তাদের যাতে দূরে রাখা যায়৷ ছবিঘরে থাকছে শিশুদের বিষণ্ণতার কিছু কারণ৷
ছবি: Fotolia/Nicole Effinger
অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ
বাংলাদেশে পরীক্ষায় ভালো না করায় কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা প্রতি বছরই ঘটে৷ বাবা-মা, পরিবার, সমাজ অনেকক্ষেত্রেই বোঝে যে ছোটদের খুব চাপে ফেলা মানে বিপদ বাড়ানো৷ লেখাপড়া, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড – সব জায়গাতেই তীব্র প্রতিযোগিতা৷ অনেক সময় প্রত্যাশার চাপে শিশুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাদের৷ বয়ঃসন্ধিকালে এ অবস্থায় অনেকে এমন চাপ থেকে মুক্তির পথ খোঁজে আত্মহত্যায়৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ভাঙা পরিবার
বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ সন্তানের জন্য খুব বড় আঘাত৷ এই আঘাত তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ সবকিছুতেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে৷ ‘ম্যারিজ অ্যান্ড ফ্যামিলি’ জার্নালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক নিবন্ধ বলছে, ডিভোর্সি বাবা-মায়ের সন্তানদের অবসাদগ্রস্থ হওয়া এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি৷
ছবি: goodluz - Fotolia
কম খেলাধুলা
শিশুদের সুস্থ জীবনের জন্য খেলাধুলা খুবই দরকার৷ খেলাধুলা বেড়ে ওঠা, মেধার বিকাশ, শেখার আগ্রহ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বাড়ানো – বলতে গেলে স্বাভাবিক জীবনের জন্য অপরিহার্য অনেক গুণ তৈরিতেই বড় ভূমিকা রাখে৷ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ পেটার গ্রে জানিয়েছেন, যেসব শিশু খেলাধুলা কম করে তারা দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সমস্যা সমাধানেও বহুক্ষেত্রে কম দক্ষ হয়৷ বিষয়টি তাদের একসময় হতাশাগ্রস্ত করে আর হতাশা ডেকে আনে বিষাদ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Schlesinger
ইলেক্ট্রনিক গেমের নেশা
আপনার সন্তান খুব বেশি কম্পিউটার গেম খেলে? কম্পিউটার, স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট হাতে পেলেই গেম খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে? তাহলে সন্তানকে একটু সময় দিন৷ অ্যামেরিকান জার্নাল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেডিসিন-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, যেসব শিশু দিনে পাঁচ ঘণ্টা বা তার বেশি গেম খেলে, তারা অবসাদগ্রস্তও হয় বেশি৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘদিন সপ্তাহে ২০ ঘণ্টার বেশি গেম খেললে শিশুদের মস্তিষ্কের কোষ সংকুচিত হতে শুরু করে৷
ছবি: dpa
বেশি চিনি খাওয়া
ব্রিটিশ মনস্তত্ত্ববিদ ম্যালকম পিট গবেষণা করে দেখেছেন, বেশি চিনি, কেক, মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া এবং কার্বোনেটেড পানীয় বেশি পান করার অভ্যাসও অনেক সময় শিশুদের অবসাদগ্রস্ত করে৷ চিনি বেশি খেলে মস্তিষ্কে বৃ্দ্ধি হরমোনের কার্যক্রমেও সমস্যা তৈরি করে৷
ছবি: Colourbox
বেশি অ্যান্টিবায়োটিক
বেশি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো অনেক কারণেই খারাপ৷ বেশি অ্যান্টিবায়োটিকও শিশুদের মনস্তত্ত্বে কুপ্রভাব ফেলে৷ ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা কিছু ইঁদুরের দেহে দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. May
6 ছবি1 | 6
বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের মামলায় ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বছরের পর বছর মামলা ঝুলতে থাকে৷ মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মামলা ঝুলে থাকার কারণেই অভিযোগ প্রমাণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে৷ আলামত নষ্ট হয়ে যায়৷ এছাড়া দীর্ঘদিন মামলা চালিয়ে নেয়ার আর্থিক সক্ষমতা থাকে না অনেক পরিবারের৷''
গত শনিবার ঢাকার মিরপুর এবং রায়েরবাগে একই দিনে দু'টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়৷ চলতি বছরে এ পর্যন্ত শুধু ঢাকায় অন্তত ৩০টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে পুলিশের সূত্র জানিয়েছে৷ তবে নূর খান বলেন, ‘‘শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতার প্রকৃত ঘটনা আরো বেশি৷ কারণ অনেক ঘটনাই স্থানীয়ভাবে মীমাংসা করা হয়৷ আবার কেউ কেউ শিশুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে থানায় অভিযোগ করেন না৷''
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের আইনজীবী ফাহমিদা খাতুন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘দেখা গেছে, সাধারণভাবে ১০ বছরের নীচে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হলে বাবা-মা টাকার বিনিময়ে মীমাংসা করে ফেলেন৷ এখানেই শেষ নয়, ১০ বছরের ওপরে মেয়েদের সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনাও ঘটে অহরহ৷''
‘‘শিশুরা সবচেয়ে দুর্বল আর তারা প্রধানত তাদের পরিচিত আত্মীয়স্বজনের হাতেই যৌন সহিংসতার শিকার হয়'', জানান অ্যাডভোকেট এলিনা খান৷ তিনি বলেন, ‘‘আইনের সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি শিশু ধর্ষণ প্রতিরোধে দরকার ব্যাপক সচেতনতা৷''
দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের যেভাবে বাঁচাবেন...
বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই সড়ক দুর্ঘটনার হার খুব বেশি৷ দুর্ঘটনায় অনেক শিশুও মারা যায়৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) পথদুর্ঘটনায় শিশু মৃত্যুর হার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ শিশুদের বাঁচানোর কিছু উপায়ও জানিয়েছে সংস্থাটি৷
নজর রাখুন
রাস্তার কাছে কোনো শিশু দেখলে তাঁর দিকে বড়দের নজর রাখা উচিত৷ শিশুরা অবুঝ বলেই অনেক সময় ব্যস্ত রাস্তাও পার হতে যায়৷ এ কারণে অনেক শিশু মারাও যায়৷ ডাব্লিউএইচও বলছে, বড়রা সতর্ক হলে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব৷
ছবি: Colourbox/D. Pereiras
ধীরে চলুন
যানবাহন বেশি দ্রুত চালালে দুর্ঘটনার শঙ্কা বাড়ে৷ তাই নিয়ন্ত্রিত গতিতে চালানো সবার জন্যই মঙ্গলজনক৷ শিশুদের জন্য তা আরো বেশি দরকার৷ দ্রুত চালালে কোনো শিশু যদি হঠাৎ গাড়ির সামনে চলে আসে, চালক চট করে গাড়ি থামাবেন কী করে!
ছবি: picture-alliance/dpa
মদ্যপান করে রাস্তায় নয়...
মদ্যপান করে গাড়ি চালালে চালক গাড়ির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না৷ তাই বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মদ্যপান করে গাড়ি চালানো আইনত দণ্ডনীয়৷ তারপরও অনেকেই মাতাল অবস্থাতেও গাড়ি চালান৷ শিশুদের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সবার প্রতি মদ্যপান না করে গাড়ি চালানোর অনুরোধও জানিয়েছে ডাব্লিউএইচও৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media/Pictures From History
হেলমেটে সুরক্ষা
শুধু মোটর সাইকেলে নয়, শিশুদেরকে বাইসাইকেলেও হেলমেট ব্যবহার করতে বলেছে ডাব্লিউএইচও৷ শিশুদের মাথা বড়দের চেয়ে অনেক নরম৷ তাই সব অবস্থাতেই তাদের ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Felix Kästle
শিশুদের শেখানো
পথে নামলে কী কী দিকে খেয়াল রাখতে হয়, তা শিশু যত তাড়াতাড়ি শিখবে ততই ভালো৷ বিশেষ করে শিশু যেন রাস্তার কোনদিক থেকে যানবাহন আসছে তা দেখতে শেখে এবং রাস্তা ফাঁকা না হলে পার হওয়ার চেষ্টা না করে – এইটুকু সব বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনেরই শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে শেখানো উচিত৷
ছবি: picture-alliance/Markus C. Hurek
সড়কের সার্বিক উন্নয়ন
রাস্তাঘাট ভালো না হলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে৷ তাই রাস্তাঘাট ভালো করাটা দুর্ঘটনার রোধের খুব গুরুত্বপূর্ণ উপায়৷ তাছাড়া প্রতিটি রাস্তায় সতর্কতা সংকেত, রাস্তা পারাপারের চিহ্ন, জেব্রা ক্রসিং – এ সব থাকা জরুরি৷ শিশুদের জন্য চিহ্নগুলো বেশি দরকার, কেননা, ছবি দেখে তারা যেমন সব কিছু দ্রুত শিখতে পারে, সেভাবে নানা রংয়ের সংকেত দেখেও নিজেকে নিরাপদ রাখতে শেখে শিশুরা৷
ছবি: picture-alliance/AP/V.R. Caivano
উপযুক্ত চালক
যানবাহন চালানো খুব দায়িত্বশীল কাজ৷ একজন চালকের ওপর অনেকের জীবন নির্ভরশীল৷ তাই অবশ্যই লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই যানবাহন চালানোর সুযোগ দিতে বলেছে ডাব্লিউএইচও৷ এর সঙ্গে মানবিক শিক্ষার ওপরও জোর দিতে বলা হয়েছে৷ নিজের জীবনের পাশাপাশি অন্যের জীবনের গুরুত্ব না বুঝলে লাইসেন্সধারী চালকও তো কারো জন্য নিরাপদ নয়!
ছবি: Nobilior/Fotolia
দ্রুত চিকিৎসা
সড়ক দুর্ঘটনার পর খুব তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায় না বলেও অনেক শিশু মারা যায়৷ তাই রাস্তার কাছেই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা এবং শিশুদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল বাড়ানোর দিকে প্রতিটি দেশকে নজর দিতে বলেছে ডাব্লিউএইচও৷