এ কথাটি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সাধারণ মানুষও যেন বুঝতে চান না৷ একটি শ্রেণি আছে যারা শিশুদের ভুল পথে পরিচালিত করে, ব্যবহার করে নাশকতামূলক কাজে৷ এই শিশুদের অধিকাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের অথবা ছিন্নমূল শিশু৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে, চলে অবরোধ-হরতাল, তখন এই শিশুদের কদর বেড়ে যায়৷ রাজনৈতিক দলগুলোর নানা ধরণের কর্মসূচি বাস্তবায়নে শিশুরাই যেন প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়৷ তবে এ অবস্থা আজকের নয়, বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে৷
রাজনৈতিক কর্মসূচি যখন রাজনৈতিক হয়, তখন যেমন শিশুদের ব্যবহার করা হয়, তেমনি এর অরাজনৈতিক, মানে নাশকতামূলক কাজে শিশুদের কদর আরো বেশি৷
২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকার শাপলা চত্তরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল৷ এছাড়া পুলিশি অভিযানের সময় এই শিশুরাই আহত হয়েছে বেশি৷ অথচ যারা তাদের ব্যবহার করেছে, তারা আগেই পালিয়ে গেছে৷
অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত জনজীবন
বাংলাদেশে টানা অবরোধ ও হরতালের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা৷ ক্রেতার অভাবে বেচাকেনা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে৷ শুধু অর্থনীতি নয়, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় মুষড়ে পড়েছে পরিবহন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন
পুরনো ঢাকার বাবু বাজারে কাগজ বোঝাই একটি ট্রাকে জ্বলছে দুষ্কৃতিকারীদের দেয়া পেট্রোল বোমার আগুন৷ গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ৷ ডাকা হচ্ছে হরতালও৷ অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে আলোচিত পেট্রোল বোমা৷ শুধু পেট্রোল বোমার আগুনেই পুড়ে মরেছে কমপক্ষে ৬৫ জন সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশ প্রহরায় চলছে পরীক্ষা
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়িাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পুলিশ প্রহরা৷ চলমান এ অবরোধ-হরতালে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা অন্যতম৷ বর্তমানে সারা দেশে চলা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন তাই অনেকটাই অনিশ্চয়তার মুখে৷ টানা অবরোধের মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে চলছে পরীক্ষা৷ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূরপাল্লার বাস নেই বললেই চলে
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলির ডাকা অবরোধে বাংলাদেশের প্রধান সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্ত৷ দুপুর বেলায় তোলা এ ছবিতে মহাসড়কটি প্রায় যানবাহন শূন্য৷ কিন্তু সাধারণ সময়ে এ সড়কটি থাকে যানবাহনে ভরা৷ বাংলাদেশে চলমান অবরোধে দূর পাল্লার গাড়ি চলাচল কমে গেছে বহুলাংশে৷ একের পর এক পেট্রোল বোমার ঘটনায় ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাচ্ছেন না অনেক মালিকই৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিজিবি-র টহল পর্যাপ্ত নয়
অবরোধের মধ্যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয়, মানে ঢাকার বাইরে বিজিবি-র টহল থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য৷ এছাড়া সম্প্রতি রাত ন’টার পরে বাস চলাচলে সকলকে নিরুৎসাহ করার কারণে বাস মালিকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় অস্বাভাবিক নয় যানজট
বাংলাদেশে চলমান এই অবরোধে ঢাকার ভেতরের সড়কের দৃশ্য অবশ্য আলাদা৷ যান চলাচল অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও, অনেক জায়গাতেই যানজট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসযাত্রীরা
ঢাকার ফার্মগেটে অফিস শেষে গাড়ির অপেক্ষায় বাড়িমুখী মানুষের ভিড়৷ টানা অবরোধে গণ পরিবহন ব্যবস্থা বেহাল হলেও, অর্থাৎ গাড়িঘোড়ার চলাচল কম থাকাতে দুর্ভোগ বেড়েছে অফিসমুখী ও অফিস ফেরত মানুষের৷ অফিসে যেতে বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে সাধারণ মানুষ তাই পড়ছেন দুর্ভোগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অবরোধে নদীপথের ভিন্ন চিত্র
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাটের চিত্র এটি৷ গত একমাসেরও বেশি সময়ের এই অবরোধে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো সহিংসতা ঘটেনি নদীপথে৷ তাই নদীপথে যান চলাচল প্রায় স্বাভাবিকই আছে৷ ঢাকা থেকে প্রধানত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যাচ্ছে না দূরপাল্লার বাসগুলো
বিএনপি ও সমমনা দলের জোটসমূহের ডাকা হরতাল-অবরোধে ঢাকার অন্যতম প্রধান বাস স্টেশন গাবতলীর দৃশ্য এটি৷ বেশিরভাগ দূর পাল্লার রুটের বাসই এ স্টেশনে পার্ক করে রাখা৷ হরতাল-অবরোধে দূর পাল্লার বাস চলাচল অনেকাংশেই বন্ধ আছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. Mamun
খদ্দেরহীন এক রেস্তোরাঁ
ঢাকার গাবতলী বাস স্টেশনের খদ্দেরশূন্য মোহাম্মাদীয়া রেস্তোরাঁ৷ অবরোধের কারণে এ রেস্তোরাঁর লোকবল ১৬ জন থেকে ৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ বাকি যে আটজন আছেন তাঁদেরও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না মালিক৷ গাবতলী স্টেশন থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচল কম থাকায় এ রেস্তোরাঁটি দিনের বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ
অবরোধ আর হরতালকারীদের প্রধান লক্ষ্য সড়কে চলাচলকারী বাস আর ট্রাক৷ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগেই যাত্রীবাহী বাস কিংবা ট্রাকে৷ এতে কমপক্ষে ৬০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পোড়ায় ক্ষত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন আরো শতাধিক সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
কমলাপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষায় যাত্রীরা
অবরোধে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল করলেও, সময়সূচি ঠিক রাখতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ৷ বিভিন্ন সময়ে অবরোধকারীদের রেল লাইনের ‘ফিশপ্লেট’ খুলে ফেলার কারণে কয়েকটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে৷ তাই বেশিরভাগ ট্রেনই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যাচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন৷
ছবি: DW/M. Mamun
খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা
টানা অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা৷ স্বল্প পুঁজির এ সব ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে যাওয়ায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেকেরই৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুঁজি ভেঙে চলছে যাঁর সংসার
ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকার ফুটপাথে কম্বলের ব্যবসা করেন গাজীরুল ইসলাম৷ দুপুরবেলা পর্যন্ত এ দিন তাঁর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭’শ টাকার একটি কম্বল৷ তাও তার কেনা দামের থেকে ৩০০ টাকা কম৷ লাভ তো দূরের কথা সংসার চালাতে এখন পুঁজি টুকুনিই ভরসা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রই যখন ভরসা
ঢাকার নবাবপুর থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ফিরছেন এক গাড়ি চালক ও তাঁর সহকারী৷ টানা অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে নিজেদের গাড়িতে এখন থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখবেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
14 ছবি1 | 14
অস্থির সময়ে বড় বড় রাজনৈতিক দলের মিছিলের আগেও থাকে শিশুরা৷ এটা বাংলাদেশে বহুদিনের রাজনৈতিক ‘কালচার'৷ প্রকৃত অর্থে তারাও শিশুদের মিছিলের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন৷ এটা সবচেয়ে বেশি হয়েছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়৷
তখন অবশ্য শিশুদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও মাঠে থাকতেন৷ কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় অজ্ঞাত স্থান থেকে, বিবৃতির মাধ্যমে৷ কর্মসূচি চলাকালে এবং কর্মসূচি ঘোষণার পর চোরাগোপ্তা ককটেল, পেট্রোল বোমা হামলা বা বাসে আগুন ছাড়া রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মাঠে দেখা যায় না৷ তাই এ সব নাশকতার কাজে শিশুদের ব্যবহার করা হয় নিরাপদ ‘ক্যারিয়ার' হিসেবে৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, তারা নাকি এখন রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে ছিন্নমূল এবং বস্তিতে বসবাসরত শিশুদের ওপরই বেশি নজর রাখছেন৷ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান অবরোধ-হরতালের সময় শিশুদেরই ককটেল, পেট্রোল বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন ও তা নিরাপদে রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে৷''
তিনি জানান, ‘‘গত দেড় মাসে ককটেল বোমা ছোড়ার সময় অথবা বহনের সময় অন্তত ২০টি শিশুকে আটক করা হয়েছে৷ তবে আটকের পর তারা তাদের এ সব কে দিয়েছে, তা ঠিকমত বলতে পারে না৷ তারা টাকা পেয়েছে তাই কাজ করেছে৷'' এর বাইরে কিছু রাজনৈতিক সংগঠন ধর্মের নামে শিশুদের নাশকতার কাজেও উদ্বুদ্ধ করে বলে জানান তিনি৷ তিনি জানান, এই শিশুদের বয়স ১০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে৷
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
9 ছবি1 | 9
গত ১২ই ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জে পুলিশের হাতে আটক হয় দু'টি শিশু৷ তাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে৷ তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল এবং ম্যাগজিন ভর্তি ৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ৷ পরে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে আরো তিনটি বিদেশি পিস্তল এবং একাধিক ম্যাগজিন এবং তাজা গুলিও উদ্ধার করা হয়৷
এই দু'টি শিশুর সঙ্গে কথা বলে পুলিশ যা জানতে পেরেছে, তা ভয়াবহ৷ নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের একজন বড় কর্মকর্তা এ নিয়ে আলাপকালে জানান, বস্তিতে বসবাসরত নিম্নবিত্ত শিশুদেরই অপরাধমূলক কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে৷ কখনো কখনো বস্তির মালিকরাই শিশুদের বাধ্য করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক ব্যবসায়৷ অধিকাংশ বস্তিতেই মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানো হচ্ছে শিশুরা৷ শিশুদের নাকি দিনে এ সব কাজের জন্য সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা দেয়া হয়৷
ঐ কর্মকর্তা জানান, ‘‘বড় বড় অপরাধের সাথে শিশুদের জড়িয়ে ফেলার প্রধান কারণই হচ্ছে নিরাপত্তা৷ শিশুদের ব্যবহার করে অতি সহজে সন্ত্রাসীরা পার পাওয়ার চেষ্টা করে৷ মাদক এবং আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন ও লুকিয়ে রাখতে শিশুদেরই সবচেয়ে নিরাদ মনে করে তারা৷ কারণ শিশুরা জানেও না তারা কার অস্ত্র জমা রাখছে, বহন করছে বা কার জন্য ককটেল ছুড়ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘প্রয়োজনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো বস্তি মালিক অথবা নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমেই অর্থের বিনিময়ে শিশুদের কাজে লাগায়৷''
বাংলাদেশে শিশুদের অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা দণ্ডনীয় অপরাধ৷ এছাড়া শিশুদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করারও আইন আছে৷ আইনে বলা আছে, শিশুরা (১৮ বছর পর্যন্ত) আটক হলে থানা থেকে আদালতে পাঠানোর সময় পুলিশ কাগজপত্রে তাদের নাম, বয়স এবং পরিচয় লাল কালিতে লিখবে, যাতে বিচারক দেখেই আটককে শিশু হিসেবে চিহ্নিত করে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন৷ তাকে কিশোর আদালতে পাঠাতে পারেন৷ আর আইনে তাদের শাস্তি নয়, সংশোধন করার জন্য কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর বিধান আছে৷
অস্থির বাংলাদেশ
বাংলাদেশে দশম সংসদীয় নির্বাচনের বছরপূর্তিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে৷ এতে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে৷ ৫ই জানুয়ারি রাজনৈতিক অস্থিরতার কয়েকটি ছবি পাবেন এখানে৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com
অবরুদ্ধ খালেদা
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে তাঁর গুলশান কার্যালয়ে আটকে রেখেছে পুলিশ৷ যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে, তবে সোমবার তিনি বাইরে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁর গেটে তালা লাগিয়ে দেয়৷ ফলে অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন গেটের মধ্যেই৷
ছবি: AFP/Getty Images
অবরোধ ঘোষণা
অবরুদ্ধ খালেদা জিয়া পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত সারা দেশে অবরোধের ঘোষণা দিয়েছেন৷ গুলশানের কার্যালয়ে সোমবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘‘আজ আমাদের কালো পতাকা কর্মসূচি ছিল৷ সমাবেশ করতে দেওয়া হয় নাই৷ পরবর্তী কর্মসূচি না দেওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে৷’’
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
খালেদার কার্যালয় ঘিরে পুলিশ
প্রসঙ্গত, গত দু’দিন ধরে খালেদা জিয়ার কার্যালয় ঘিরে রেখেছে পুলিশ৷ ছবিতে পুলিশে একটি গাড়ি রাস্তায় আড়াআড়িভাবে রেখে রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এভাবে আরো কয়েকটি বালু এবং ইটভর্তি ট্রাকও রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/Landov
গাড়িতে আগুন
রবিবার থেকেই ঢাকায় সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছিল৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে বিএনপিসহ বিশ দল৷ ঢাকায় একটি সিএনজি এবং মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ছবি এটি৷ বিএনপি সমর্থকরা এটা করেছে বলে জানিয়েছে সংবাদসংস্থা৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com
পার্ক করা গাড়িতে আগুন
পার্ক করে রাখা একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দিচ্ছে বিএনপির সমর্থকরা৷ ছবিটি ঢাকা থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
রাজপথে সরব আওয়ামী লীগ
পুলিশ সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করলেও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হন৷ বিষয়টি সমালোচনা করে ফেসবুকে সাংবাদিক প্রভাষ আমিন লিখেছেন, ‘‘...নিষেধাজ্ঞা কি শুধু বিএনপির জন্য? আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তো দেখি শহরজুড়ে মিছিল করছে, উল্লাস করছে, গান শুনছে, গান গাইছে৷’’ ছবিতে ঢাকায় বিএনপির এক সমর্থককে পেটাচ্ছে আওয়ামী লীগের কর্মীরা৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Abdullah
‘শান্তির পথে আসুন’
এদিকে সোমবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বিএনপি নেত্রীকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তবে মধ্যবর্তী নির্বাচনের যে দাবিতে বিএনপিসহ বিশদল আন্দোলন করেছে, সেই দাবির প্রতি কোন নমনীয়তা দেখাননি তিনি৷ হাসিনা মনে করেন, সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়াটা বিএনপির রাজনৈতিক ভুল ছিল৷
ছবি: Oli Scarff/Getty Images
‘একতরফা’ নির্বাচন
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের পাঁচ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল অংশ নেয়নি৷ সেই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে কোন ভোটাভুটি হয়নি৷ বাকি আসনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল বেশ কম৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেটিকে ‘একতরফা’ নির্বাচন আখ্যা দিয়েছে৷
ছবি: DW
8 ছবি1 | 8
শুধু পুলিশ নয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরেরও দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে৷ প্রত্যেক থানা এলাকায় একজন করে ‘প্রবেশন' অফিসারের পদ আছে৷ তাদের দায়িত্ব হলো থানার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে আটক শিশুদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা৷
কিন্তু পুলিশ বা সমাজসেবা অধিপ্তর কেউই এই দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হয় না৷ পুলিশ শিশুদের বয়স বাড়িয়ে দিয়ে 'দাগি অপরাধী' ধরার কৃতিত্ব নেয়৷ অন্যদিকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমান৷
এই সুযোগে মূল অপরাধীরা থাকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে৷ যারা শিশুদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করেন, তাদের শাস্তি তো দূরের কথা চিহ্নিতই করা হয় না৷ অথচ আইনে এই ‘গডফাদাররাই' অপরাধী৷ তাদেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান আছে৷
তাছাড়া সবার উপরে যারা দেশের জন্য রাজনীতি করেন বলে দাবি করেন, সেই রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে শিশুদের নাশকতায় ব্যবহার করে? কে এর জবাব দেবে?
১০ বছর আগের কথা৷ শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলাম শিশু আইন এবং শিশুদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নিতে৷ সেই প্রশিক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ আরো কয়েকটি দেশের বর্তমান এবং সাবেক বিচারকরা ছিলেন প্রশিক্ষক৷ আমার কাছে বাংলাদেশে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের প্রতি পুলিশ ও আইনের আচরণ শুনে তারা শিউরে ওঠেন৷ আমাকে তাঁরা বলেন, ‘‘শিশুরা অপরাধ করে না, তারা ভুল করে৷ তাই তাদের সংশোধন করে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করাটাই আইনি দায়িত্ব৷ তাদের জীবনকে অন্ধকরে ঠেলে দেয়া নয়৷''
ঐ কর্মশালাতেই মৌরিন নামে শ্রীলঙ্কার শিশু অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী একজন আইনজীবী জানিয়েছিলেন, তারা কীভাবে কলম্বোর সমুদ্র সৈকতে শিশুদের অপরাধে ব্যবহার করছে, এমন একটি দলকে চিহ্নিত করে আইনের মুখোমুখি করেন৷ আর তারপর কীভাবে তাঁরা শিশুদের ফিরিয়ে নিয়ে যান স্বাভাবিক জীবনে৷
কিন্তু বাংলাদেশে শিশুদের অপরাধী বানিয়ে যেন কেউ কেউ হিরো হতে চান৷ পুলিশ, সমাজসেবা অধিদপ্তর আর রাজনীতির কথা তো আগেই বলেছি৷ এবার জানুন কিছু সাংবাদিকের কথা৷
আইনে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের নাম, পরিচয় ছবি প্রকাশে বাধা আছে৷ কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম এ সব শিশু আটক হওয়ার পর তাদের ছবিসহ নাম পরিচয় প্রকাশ করে দেয়৷ কথিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নামে প্রকাশ করে তাদের ‘অপরাধের আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য'৷ আবার কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল শিশু-কিশোর অপরাধের প্রতিবেদন দেখাতে গিয়ে শিশুকে দিয়েই অপরাধ করিয়ে তা প্রচার করে৷ এই শিশুদের ভবিষ্যত্ নিয়ে তাঁরা ভাবেন না৷ বুঝতে পারেন না যে, এ ধরণের প্রতিবেদন শিশুদের শেষ করে দেবে৷ তাদের আর সমাজ গ্রহণ করবে না৷ তাদের আরো ‘বড় অপরাধী' হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না৷ ঠিক যেমন পুলিশ শিশুদের জেলে পাঠিয়ে আরো ‘বড় অপরাধী' বানানোর রাস্তা খুলে দেয়৷