কলকাতার এক নামি স্কুলে, মাত্র চার বছরের এক ছাত্রীর যৌন নিগ্রহের ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা রাজ্য৷ দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির দাবিতে মুখর সমাজ৷
বিজ্ঞাপন
দুই শিক্ষক, দু'জনেই পুরুষ৷ কলকাতার একটি নামি মেয়েদের স্কুলে শারীরিকশিক্ষার শিক্ষক হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে কর্মরত৷ স্কুলের এক ছাত্রী, যার বয়স মাত্র চার বছর, নেহাতই শিশু, সে একদিন স্কুলের পোশাকে রক্ত নিয়ে বাড়ি ফেরে৷ বাচ্চাটির মা দেখেন, মেয়ের দুই পায়ের ফাঁক দিয়েও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷ আরেকটু খতিয়ে দেখে বোঝা যায়, শিশুটির রেচনাঙ্গ, যা এখনও যৌনাঙ্গ হিসেবে অভিহিত হওয়ারও সময় আসেনি, তা ক্ষতবিক্ষত৷ শিশুটিকে প্রশ্ন করে জানা যায়, স্কুলেরই দুই শিক্ষক তাকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই তার সঙ্গে এমন করছে৷ কী করছে, সেটা বোঝার বয়স তার হয়নি, কিন্তু তাতে যে তার খুব কষ্ট হয়েছে, তা সে মাকে বলে৷ এরপর বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছালে, ছবি দেখে ওই দুই শিক্ষককে চিহ্নিতও করে দেয় ওই শিশু৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
এমন উদ্বেগজনক ঘটনার পরও স্কুলের অধ্যক্ষার নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া ক্ষুব্ধ করে ওই শিশুটির বাবা-মা এবং স্কুলের বাকি ছাত্রীদের অভিভাবকদেরও৷ কারণ অধ্যক্ষা এবং সহ-শিক্ষিকাদের কথায় এবং হাবেভাবে স্পষ্ট হচ্ছিল, এটাকে তাঁরা নিছকই ছোট ঘটনা, সুতরাং বেশি শোরগোল না করে ভুলে যাওয়াই ভালো — এমন একটা মানসিকতা নিয়েই দেখছেন৷ ফলে অভিভাবকদের বিক্ষোভ শুরু হয়, সক্রিয় হয় সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়, সচকিত হয় প্রশাসন এবং শেষ পর্যন্ত ওই দুই অভিযুক্ত শিক্ষক গ্রেপ্তার হয়৷ কিন্তু তার পরেও সামাজিক পর্যায়ে মানুষের ক্ষোভ কমছে না, বিশেষত স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে৷ কেন তারা একটি শিশুর যৌন নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়ায়৷ সেই সূত্রে উঠে আসতে থাকে শহরের আরও কয়েকটি বড় স্কুলে একই ধরনের যৌন হেনস্থার ঘটনা৷ যেসব ঘটনা এতদিন হয়ত স্কুল কর্তৃপক্ষের চাপে, বা হয়ত লোকলজ্জার ভয়ে সামনে আসেনি৷
‘খালি শিক্ষকদেরই দায় থাকবে কেন? বাকি সমাজের কি কোনো দায় নেই?’
স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কি এমন কোনো চাপ থাকে, থাকে কি কোনো অলিখিত নির্দেশ এ ধরনের নিন্দনীয় ঘটনাকে লঘু করে দেখানোর, চেপে যাওয়ার? কলকাতার একটি মন্টেসরি স্কুলের শিক্ষিকা সুপর্ণা মিত্র ডয়চে ভেলেকে খোলাখুলি জানালেন, ‘‘হ্যাঁ, থাকে৷'' কিন্তু তার পরেই যেটা থাকে, বা থাকা উচিত, সেটা হলো শিক্ষক শিক্ষিকাদের মানবিক দায়িত্ব৷ যে শিশুটি নির্যাতিত হলো, তার ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ও রকম আরও অনেক শিশুর কথা ভেবে সরব হওয়া৷ কিন্তু এই প্রসঙ্গে সুপর্ণার প্রশ্ন, খালি শিক্ষকদেরই দায় থাকবে কেন? বাকি সমাজের কি কোনো দায় নেই? এবারেই যেমন অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের পক্ষ সমর্থনে আদালতে দাঁড়াবেন আইনজীবী৷ হতে পারে সেটা তাঁদের পেশাগত দায়, কিন্তু ঠিক কী বলে ওই দুই শিক্ষকের কাজকে বৈধ প্রমাণ করবেন তাঁরা? নাকি প্রমাণ করার চেষ্টা হবে, ওই শিশুটি মিথ্যে বলেছে? বস্তুত অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের একজন ইতোমধ্যেই দাবি করেছেন, যে তিনি নির্দোষ! সেটা অচিরেই প্রমাণ হয়ে যাবে৷
‘পাঠক্রমের বাইরেও নানাভাবে জীবনের পাঠ নেওয়ার সুযোগ আছে শান্তিনিকেতনে’
ঘটনাটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া যখন তোলপাড়, তখন ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের এক প্রাক্তনী, গবেষক স্রোতা দত্ত৷ দুই অভিযুক্তের একজন পাঠভবনেই পড়েছেন৷ তাঁর বাবা ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক৷ স্রোতা তাঁর পোস্টে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, পাঠভবনের একজন প্রাক্তন ছাত্র কীভাবে এমন জঘন্য একটা কাজ করতে পারেন৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে স্রোতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, পাঠভবনের শিক্ষা কী এমন জীবনবোধ তৈরি করে দেয়, যার জন্য তিনি এত অবাক হচ্ছেন৷ স্রোতা জানালেন, পাঠক্রমের বাইরেও নানাভাবে জীবনের পাঠ নেওয়ার সুযোগ আছে শান্তিনিকেতনে৷ আছে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে প্রায় পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ, যা স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়েও সঙ্গে থাকে৷ যে কোনো অভিজ্ঞতা, বয়ঃসন্ধির অস্থিরতা, হতাশাও তাঁরা স্বচ্ছন্দে ভাগ করে নিতে পারেন, এখনও৷ সেখানেই তাঁর অবাক লাগছে যে, কী করে পাঠভবনের এক প্রাক্তনী এমন একটা অপরাধে প্রবৃত্ত হলেন৷
ধর্ষিতার দুই আঙুল পরীক্ষা
কোনো নারী ধর্ষিতা হয়েছেন কিনা, তা নিরূপণের জন্য বিতর্কিত দুই আঙুল পরীক্ষা চালু করতে চেয়েছিল ভারত৷ এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়৷ শেষে অবশ্য বিশেষ কারণ ছাড়া পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়৷ কী এই পরীক্ষা?
ছবি: AP
প্রমাণ করার জন্য
ধর্ষণকারীকে সাজা দিতে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনাটাই যথেষ্ট নয়৷ ধর্ষণ যে হয়েছে, সেটা প্রমাণ করতে হয়৷ তাই এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসকরা দুই আঙুল পরীক্ষা করতেন৷
ছবি: Fotolia/detailblick
সম্ভোগের অভ্যাস
নিগৃহীতা মহিলার যৌনসম্ভোগের অভিজ্ঞতা বা অভ্যাস আছে কিনা, তা যাচাই করা হতো, কোথাও কোথাও এখনও হয়ে থাকে যোনিপথে আঙুল ঢুকিয়ে৷
ছবি: AP
কুমারিত্বের প্রমাণ
আঙুলের স্পর্শে চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন, একজন নারীর সতীচ্ছদ অক্ষত আছে কিনা, অর্থাৎ সেই নারীর কুমারিত্ব অক্ষুণ্ণ আছে কিনা৷
ছবি: Fotolia/NinaMalyna
ভিত্তিহীন ধারণা
আঙুলের সাহায্যে নাকি বোঝা যায়, বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক হয়েছিল, না সম্মতি নিয়ে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতিকে ভিত্তিহীন বলে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
সর্বোচ্চ রায়
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালেই বলেছিল, দুই আঙুল পরীক্ষা ধর্ষিতার পক্ষে শারীরিক ও মানসিকভাবে অবমাননাকর৷ সরকারের বিকল্প পদ্ধতির সন্ধান করা উচিত৷
ছবি: CC-BY-SA-3.0 LegalEagle
আর্মিতে ভর্তি হতে গেলে
ইন্দোনেশিয়ায় মহিলারা আর্মিতে ভর্তি হতে চাইলে, তাঁদের এই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়৷ দেশটির আর্মি প্রধান জেনারেল মোয়েলদোকোর কথায়, ‘‘দুই আঙুল পরীক্ষা নারীর আচার-আচরণ, চরিত্র নিরীক্ষণের মূল চাবিকাঠি৷’’ বলা বাহুল্য, দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও মধ্য-পূর্ব এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও এটি একটি চালু পরীক্ষা৷
ছবি: AFP/Getty Images/A. Berry
6 ছবি1 | 6
এ বিষয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷