বছরের পর বছর ধরে এক জার্মান মা তার সন্তানকে যৌন নিপীড়ন করেছেন, অনলাইনে ধর্ষকদের কাছে সন্তানকে ভাড়াও দিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল বলছেন, সতর্ক হওয়ার এখনই সময়৷
বিজ্ঞাপন
তদন্তকারীদের প্রতিবেদন অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল৷ শুধু সঙ্গীকে অনুমতিই দেননি, নিজেও নিজের সন্তানকে যৌন নিপীড়ন করেছেন মা৷ এটা কীভাবে সম্ভব? শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই যুগল পুরো বিশ্বের শিশু যৌন নিপীড়কদের কাছে সন্তানকে ভাড়াও দিয়েছেন!
কীভাবে এমন কাজ করতে পারে মানুষ! এ ঘটনা মনে পড়লেও এমন সব চিত্র মনে আসতে থাকে যে চিন্তা করাই বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে হয়৷ এমনিতেই এখন একের পর এক বাজে খবর আসছেই৷ পরিস্থিতি একেবারেই অসহনীয়৷
এই শিশুটিকে গত কয়েক বছর কী ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, ভাবলে নিজেকেই অসুস্থ মনে হয়৷ সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়৷ কিন্তু এটাই হবে সবচেয়ে বড় ভুল৷
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
দক্ষিণ জার্মানির স্টাউফেনে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা অস্বাভাবিক মাত্রায় ভয়াবহ৷ কিন্তু এর মানে এই না যে জার্মানির আর কোথাও যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে না৷ স্টাউফেনের ঘটনা থেকে আমরা যা জানতে পেরেছি তাতে শিশু স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা কেন আগেই কোনো তথ্য পেলেন না, তা বিষ্ময়কর৷
একজন শিশু নির্যাতক এবং নির্যাতিত শিশু বছরের পর বছর ধরে কীভাবে একই ছাদের নীচে বসবাস করে আসছে! তাও আবার জার্মানির এত বিস্তৃত প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে! স্টাউফেনের ঘটনা এমন প্রশ্নই সামনে নিয়ে এসেছে৷
এমন ভয়াবহ অপরাধের কারণ খুঁজতে বসার আগে জার্মানদের অন্য বিষয়ে আলোচনা শুরু করা উচিত৷ শিশু সুরক্ষা কর্মকর্তাদের আরো ক্ষমতা দেয়া উচিত, যাতে শিশুদের রক্ষায় তাঁরা প্রয়োজনে সবকিছু করার সামর্থ্য রাখেন৷
জার্মানির মতো সম্পদশালী একটি দেশে কর্তৃপক্ষ যখন অধিকতর তথ্য-প্রমাণ জোগাড়ের ক্ষেত্রে সামর্থ্যের অভাব নিয়ে অভিযোগ করেন, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷
পাশাপাশি, আশেপাশে ঘটে চলা অস্বাভাবিক যে কোনো কিছুর ব্যাপারে সব নাগরিককেই তাঁদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে জানানোর দায়িত্ব নিতে হবে৷ এটা যদি নিজেদের ‘কমফোর্ট জোন' থেকে বেরিয়ে এসে করতে হয়, তবুও তা করতেই হবে৷ নিজেদের রক্ষায় অক্ষম সদস্যদের কীভাবে সমর্থন দেয়া হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করে সে সমাজটি আসলে কেমন৷ সমাজ কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, আমি-আপনি মিলেই সমাজ৷ ফলে আমরা তো আর আমাদের চোখ বন্ধ রাখতে পারি না, তাই না?