ইউরোপের উত্তরে নরওয়ে উপকূলে শীতকালে ছবি তোলা যে বেশ কঠিন কাজ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ জীববিজ্ঞানী ও আলোকচিত্রী হিসেবে এক ব্যক্তি সমুদ্রের গভীরে প্রাণিজগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
পানির নীচে ছবি তোলেন উলি কুনৎস৷ পানির গভীরে প্রাণিজগত ও পরিবেশ ধরা পড়ে তাঁর লেন্সে৷ সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী, গবেষক ডুবুরি ও আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর সৃষ্টিকর্ম আন্তর্জাতিক স্তরেও খ্যাতি অর্জন করেছে৷ সাধারণ তাপমাত্রা নয়, বরফের মতো শীতল পানির নীচে ডুব দিতে তিনি পছন্দ করেন৷ এমন শখের ব্যাখ্যা দিয়ে উলি বলেন, ‘‘আমি শীতল পানির বড় ভক্ত, কারণ সেখানে বিস্ময়ের অভাব নেই৷ চারিদিকে ধূসর, কালো পানি দেখা যায়৷ কিন্তু একবার ডুব দিলে সেখানে এমন সব প্রাণীর দেখা মেলে, বিশ্বের অন্য কোথাও যা দেখা যায় না৷ ছোট কীট ও শামুক থেকে শুরু করে নানা জাতের জেলিফিশ, অ্যাডিনয়েড রয়েছে৷ ভাগ্য ভালো থাকলে আচমকা হেরিং মাছের বিশাল ঝাঁক মাথার উপর চলে আসে৷ হাম্পব্যাক বা কুঁজো তিমি, অর্কা ডুব মেরে সেই ঝাঁক থেকে মাছ শিকার করে ভরপেট খেয়ে নেয়৷ শীতল পানির নীচে এমন জীববৈচিত্র্য দেখে আমি খুবই বিস্মিত হই৷''
কখন, কোথায় প্রাণীগুলি উদয় হবে, আদৌ হবে কিনা, তা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে৷ উলি কুনৎস তাঁর অভিযানে কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু অপেক্ষা করেছেন৷
নরওয়ের উত্তরে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে পারে৷ তখন পানির তাপমাত্রা দাঁড়ায় প্রায় চার ডিগ্রি সেলসিয়াস৷ শরীরের জন্য সেটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ উলি বলেন, ‘‘বিশেষ ধরনের শুকনো ডুবুরির পোশাক পরে আমি শীতের মোকাবিলা করি৷ ফলে পানি শরীরের সংস্পর্শে আসে না৷ তার নীচে আমি মোটা ফাইবারের পোশাক পরি৷ ফলে পানির নীচে বেশ কিছু সময় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি৷ হাতে নিওপ্রেন দস্তানা এবং মাথায় নিওপ্রেন টুপি থাকে৷ তা সত্ত্বেও আধঘণ্টা, ৪৫ মিনিট পর ঠান্ডা লাগে বৈকি৷''
কখনো কখনো দিনের পর দিন তিনি কোনো প্রাণীরই দেখা পান না৷ তারপর তিমি দেখলে উত্তেজনায় ঠাণ্ডার কথা ভুলে যান৷ হয়তো এক মুহূর্তের জন্য তিমি আসে৷ ভাগ্য ভালো থাকলে তিমি খোরাকের জন্য অনেকক্ষণ একই জায়গায় থাকে৷ তখন খুব কাছে যাবার সুযোগ আসে৷
শীতের মাসগুলিতে সেই সম্ভাবনা বেড়ে যায়৷ তখন ঝাঁক বেঁধে তিমি অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে নরওয়ের উত্তরের খাঁড়িতে চলে আসে৷ সেখানে হেরিং মাছ শিকার করে৷ তারপর ডাঙায় ফিরে নিজের তোলা ছবি খতিয়ে দেখার পালা৷ উলি কুনৎস মনে করেন, ‘‘পানির নীচে তোলা ভালো ছবি যেন গল্প বলতে পারে৷ যেমন এই প্রাণী কোথায় থাকে? কোনো নির্দিষ্ট আচরণ চোখে পড়ছে কি? একেবারে অজানা জগতের কোন কঠিন পরিবেশে এই প্রাণী বাস করে?''
জীববৈচিত্র্যের দিকেও নজর দিতে বিজ্ঞানীদের আহ্বান
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে৷ তবে সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা জীববৈচিত্র্যকে নষ্টের হাত থেকে বাঁচানোর আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
জাতিসংঘের প্রতিবেদন
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত জাতিসংঘ সমর্থিত প্যানেল আইপিসিসি বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ সেই সবের ভিত্তিতেই রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন৷ এবার সেরকমই একটি প্যানেল, যা ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ফর বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস’ বা আইপিবিইএস নামে পরিচিত, জীববৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ ১৩০ দেশের বিজ্ঞানীরা ছিলেন সেই প্যানেলে৷
ছবি: IPBES
জলবায়ু পরিবর্তনের সমান হুমকি
জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক প্রধান রবার্ট ওয়াটসন (ছবি) প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের জন্য যতটা হুমকি, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিও ততটাই৷ এ কারণে দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্য ও পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সবাইকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে আসাই আমাদের যে লক্ষ্য, তা পূরণের ক্ষমতা দূর্বল হয়ে যেতে পারে৷’’
ছবি: imago/J. Jeske
দশ লক্ষ প্রজাতি হুমকির মুখে!
আইপিবিইএস-এর প্রতিবেদন বলছে, গাছপালা ও পশুপাখির সংখ্যা এমন হারে কমছে, যা মানব ইতিহাসে নজিরবিহীন৷ বর্তমানে প্রায় দশ লক্ষ প্রজাতি হুমকির মুখে রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে৷ এর মধ্যে কিছু প্রজাতি নাকি কয়েক দশকের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে!
ছবি: picture-alliance/Kyodo
পাঁচটি কারণ
গত ৫০ বছরে প্রকৃতির অবনতির পেছনে পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানীরা৷ এগুলো হচ্ছে, জমি ও সাগরের অত্যধিক ব্যবহার, জীবন্ত প্রাণীদের যথেচ্ছ ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ এবং দখলদারি প্রজাতি (যেমন কচুরিপানা)৷
ছবি: Maheder Haileselassie
মাটির উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে
ভূমি অবক্ষয়ের কারণে ২৩ শতাংশ জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়৷ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পরিবেশবান্ধব কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: AP
ডেড জোন
জমিতে ব্যবহৃত সারের একটি অংশ নানাভাবে সাগরের পানিতে গিয়ে মেশে৷ এভাবে উপকূলীয় এলাকায় আড়াই লক্ষ বর্গকিলোমিটারেরও বেশি অঞ্চলে ‘ডেড জোন’ গড়ে উঠেছে বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Seiden
ভর্তুকি বন্ধের আহ্বান
বর্তমানে সাগরের প্রায় ৫৫ শতাংশ এলাকায় মাছ ধরার ট্রলার কিংবা জাহাজ ঘুরে বেড়ায়৷ এতে মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে৷ আর এসব জাহাজ পরিচালনায় বিভিন্ন দেশের সরকার অনেক ভর্তুকি দিয়ে থাকে৷ এছাড়া কৃষিখাতেও অনেক দেশ ভর্তুকি দেয়৷ তাই বিজ্ঞানীরা এসব ভর্তুকি কমিয়ে মাছ ধরা ও কৃষি উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন খাতে ভর্তুকি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: DW
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সাড়া
প্রতিবেদনটি প্যারিসে প্রকাশিত হয়েছে৷ এরপর একদল বিজ্ঞানী ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁর সঙ্গে দেখা করেন৷ এরপর মাক্রোঁ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি কমাতে তাঁর দেশের কয়েকটি পরিকল্পনার কথা জানান৷ এর মধ্যে আছে, খাদ্য উৎপাদনে সারের ব্যবহার কমানো, রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে ক্ষয়ে যাওয়া মাটির ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা, প্লাস্টিক বর্জ্য কমানো ইত্যাদি৷
ছবি: picture-alliance/AA/M. Yalcin
8 ছবি1 | 8
হামবুর্গ শহরের এই আলোকচিত্রী গোটা বিশ্বে নানা বয়সের দর্শকের সামনে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন৷ প্রকৃতি ও মহাসাগরের জগতকে অনেক মানুষের নাগালে নিয়ে আসতে চান তিনি৷ কুনৎস বলেন, ‘‘আশাকরি আমার বেশিরভাগ ছবিকেই নান্দনিক বলা চলে৷ আমি বিশাল ও সুন্দর ছবি তুলি৷ তবে বাস্তব তুলে ধরতে ও সচেতনতা বাড়াতে এমন ছবিও দেখাতে হয়, যেগুলি মোটেই সুন্দর নয়৷ মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরার পরিণতি, মহাসাগরে দূষণ ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা তাতে ফুটে ওঠে৷ এভাবে মানুষ সচেতন হয়ে উঠতে পারেন৷''
শীতল পানির মধ্যে কঠিন পরিশ্রম সত্ত্বেও এই জগতের আকর্ষণ যাবতীয় উদ্যোগ সার্থক করে দেয়৷ উলি বলেন, ‘‘শীতকালে নরওয়ের ফিয়র্ডের প্রসঙ্গ এলে বেশিরভাগ মানুষ ভাবেন সেখানে প্রাণের কোনো স্পন্দন নেই৷ অথচ বাস্তব এর ঠিক বিপরীত৷ আমার তোলা ছবি ও লেকচারের মাধ্যমে আমি প্রাণে ভরপুর এই এলাকা সবাইকে দেখাতে চাই৷ এমন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়ে আমি সত্যি অভিভূত৷''
নরওয়ে উপকূলে জীববৈচিত্র্য তুলে ধরতে ছবি তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন উলি কুনৎস৷
টেওডোরা মাভ্রোপুলুস/এসবি
নরওয়েতে বৃহত্তম সাগরতলের রেস্টুরেন্ট
যাত্রা শুরু করল ইউরোপের প্রথম ও বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্ডারওয়াটার রেস্টুরেন্ট ‘আন্ডার’৷ নরওয়ের দক্ষিণাঞ্চলে সাগরের পাঁচ মিটার গভীরে কাস্টমাররা সাগরতলের জীবন দেখতে দেখতে খাবার উপভোগ করতে পারবেন৷
ছবি: Reuters/L. Karagiannopoulos
‘আন্ডার’ মানে ‘ওয়ান্ডার’
নরওয়েজিয়ান ভাষায় আন্ডার (তলে) মানে ওয়ান্ডার (বিস্ময়)৷ এটা ইউরোপের প্রথম পানির নীচের রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ৷ এছাড়া ১০০ অতিথির বসার জায়গাসহ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এমন রেস্তোরাঁ৷ ৫ মিটার গভীর রেস্তোরাঁটির দৈর্ঘ্য ৩৪ মিটার৷
ছবি: Reuters/L. Karagiannopoulos
যেন সাগরের শিলা
রেস্তোরাঁটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন একে সাগর থেকে বেরিয়ে আসা এক শিলা মনে হয় এবং সাগরের নীচের পরিবেশের সঙ্গে মিলে যায়৷ এর অসমতল বাহ্যিক আবরণ বা খোলসটি কৃত্রিম প্রবালপ্রাচীর হিসেবে কাজ করবে৷
ছবি: Reuters/L. Karagiannopoulos
সবাইকে নিমন্ত্রণ
গাউটে উবোস্টাড এই রেস্তোরাঁর একজন প্রতিষ্ঠাতা৷ তৈরি হবার পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় যান এই নরওয়েজিয়ান ব্যবসায়ী৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকর্ষণ করতে চাই৷ এটাই আমাদের লক্ষ্য৷’’
ছবি: Reuters/L. Karagiannopoulos
স্থপতি
অসলো ভিত্তিক প্রখ্যাত ভবন নকশা প্রতিষ্ঠান স্ন্যোহেটা এই রেস্তোরাঁর নকশা করেছে৷ তারা এর আগে নিউইয়র্কের সেপ্টেম্বর ১১ মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, অসলোর অপেরা হাউসের মতো বড় বড় সব কাজ করেছে৷
ছবি: Reuters/L. Karagiannopoulos
বিরাট এক জানালা
রেস্তোরাঁটিতে একটি বিরাট জানালা আছে৷ খেতে খেতে সেই জানালা দিয়ে সাগরের জীববৈচিত্র্য দেখা যায়৷ স্থপতি থরসেন বলেন, ‘‘এই জানালার কারণে একেবারে বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে, অ্যাকুরিয়ামের মতো মনে হবে না৷’’
ছবি: Reuters/L. Karagiannopoulos
খরচ কত?
উবোস্টাড আশা করেন বছরে ১২ হাজার মানুষ এখানে খাবার খাবেন৷ একটি মিলের দাম পড়বে সর্বোচ্চ ৪৩০ ডলার বা ৩৭৬ ইউরো (প্রায় ৩৬ হাজার টাকা)৷