জার্মান পড়শিরা বলেন: সে কি? এতদিন হয়ে গেল...৷ সাকুল্যে ৩৮ বছর, কিন্তু আমি আজও শীতকাতুরে৷ পড়শিকে বোঝাই: ধরুন পৃথিবীটা একটা কিচেন আর আপনার জন্ম ওভেনে, কিন্তু বাস রেফ্রিজারেটরে৷ তাহলে?
বিজ্ঞাপন
প্রবাস আর প্রবাসীর শেষ অবস্থা হলো, সে দেশে গেলে গরমে মরে, আর বিদেশে থাকলে শীতে৷ শুনেছি নাকি প্রশান্ত মহাসাগরে কী সব খোলার মতো দ্বীপ আছে, যেখানে সারা বছর মলয়ানিল আর লোকে লুঙি আর মাথায় ফুলের মুকুট পরে কলার পাতে ভাপা মাছ খায়৷ এবার ম'লে সেখানেই জন্মাব ঠিক করেছি৷
এক রাশিয়ান বন্ধুর শুনে সে কি হাসি! তার আদত বাড়ি সাইবেরিয়ার ওদিকে৷ বলল শীতকালে নাকি মাছ ধরে বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে ট্রাকে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে মাছ বাতাসেই জমে গিয়ে টঙাস করে ট্রাকের মেঝেতে পড়ে৷ পরে সেই মাছ যখন বাজারে বিক্রি হয়, তখন কায়দা করে ফ্রিজারে রাখা হয় বটে, কিন্তু সে ফ্রিজারের কোনো বিদ্যুতের কনেকশান থাকে না – বলতে কি, গোটা বাজারেই ইলেকট্রিক নেই৷ কিন্তু শীত তো আছে৷ ‘‘আরে খুঁড়লে এখনও ম্যামথ পাওয়া যায়, আর এ তো শুধু মাছ,'' ডাঁটিয়ে বলল আলেক্স৷
জার্মানরা শীতে যা খেতে ভালোবাসেন
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে মুখরোচক খাবার খেলে মন ভালো হয়ে যায়৷ জার্মানদের এরকম নানা খাবার আছে, যেমন এই ১০টি...
ছবি: Colourbox/Christian Fischer
‘সাওয়ারব্রাটেন’ – টক রোস্ট
সাওয়ারব্রাটেন সাধারণত গরুর মাংস দিয়ে তৈরি হয়, তবে অন্য ধরনের মাংসও ব্যবহার করা যেতে পারে৷ মাংস ১০ দিন ম্যারিনেট করে রাখার পর তা রান্না করা হয়৷ মশলা দেওয়া ওয়াইন বা ভিনিগারে ভিজিয়ে রাখার দরুণ মাংসটা খুব নরম হয়ে যায়৷ প্রথাগতভাবে সাওয়ারব্রাটেন সার্ভ করা হয় ‘রোটকোল’ বা লাল বাঁধাকপির সঙ্গে৷ আপেলের টুকরো, ভিনিগার আর নানা ধরনের মশলা মিশিয়ে কম আঁচে রোটকোল রান্না করা হয়৷
ছবি: imago/Westend61
‘রিন্ডস-রুলাডে’ – বিফ রোল
গরুর মাংস পাতলা করে কেটে, সেই মাংসের স্লাইসে বেকন, আচার, পেঁয়াজ আর সর্ষেবাটার পুর দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়৷ পরে রোলগুলো প্রায় এক ঘণ্টা ধরে প্যানে সেদ্ধ করা হয়৷ আমিষ যারা পছন্দ করেন, এই খাবারটি তাঁদের বিশেষ প্রিয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/Stockfood
‘কার্টোফেল-ক্ন্যোডেল’ বা ‘ক্ল্যোসে’ – পটেটো ডাম্পলিং
আলু সেদ্ধ করতে যা কাজ, তার অনেক বেশি কাজ এই ডাম্পলিং-গুলো তৈরি করতে! আলু সেদ্ধ করে ডিম, বিস্কুটের গুঁড়ো আর আলুর ময়দার সঙ্গে ভালো করে মেখে নিতে হয়৷ তারপর সেই মাখা থেকে গোল গোল ডাম্পলিং গড়ে নিয়ে জলে সেদ্ধ করতে হয়৷
ছবি: Colourbox/DIGIFOODSTOCK
‘কার্টোফেল-পুফার’ – আলুর প্যানকেক
কাঁচা আলু কুরে নিয়ে, সেই আলু কোরা কিছুটা ময়দা আর ডিমের সঙ্গে মিশিয়ে, প্যানকেক হিসেবে প্যানে ভেজে নিতে হয়৷ সাধারণত আপেলের মোরব্বার সঙ্গে সার্ভ করা হয় এই আলুর প্যানকেক৷
ছবি: Colourbox/Christian Fischer
‘ফ্ল্যাডেল-সুপে’ – প্যানকেক নুডল দেওয়া সুপ
দক্ষিণ জার্মানিতে এই ময়দার নুডল নিজেরাই তৈরি করে নেন পাকা রাঁধুনিরা, অর্থাৎ প্যানকেক তৈরি করে সেগুলো লম্বা লম্বা ফালি করে কেটে রাখেন৷ পরে গরম সুরুয়ায় সেই ‘নুডল’ দিয়ে সুপ সার্ভ করা হয়৷ খাবারটা নিরামিষাশীদের পক্ষেও আদর্শ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Weißbrod
‘কেসে-স্পেট্সলে’ – চিজের ‘ছোট ছোট চড়াইপাখি’
জার্মানে ‘স্পাট্স’ মানে চড়ুইপাখি৷ আসলে একটা ক্রিম দেওয়া সসে নরম ডিমের নুডল – সে হিসেবে ম্যাকারোনি আর চিজ বলা যেতে পারে৷ ভাজা পেঁয়াজ আর বেকনও দেওয়া যায়, তবে নিরামিষ সংস্করণটি খেতে দারুণ৷
ছবি: DW/L. Frey
‘মাউলটাশে’ – নোসব্যাগ
অর্থাৎ ঘোড়াদের ঘাস খাওয়ানোর জন্য নাকে যে ধরনের ঝুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়৷ আসলে বড় বড় ব়্যাভিওলি, আকারে ঐ ঘোড়াদের নাকের ঝুলির মতো৷ শোয়েবিয়ার লোকেরা বলে, শোয়েবিয়া ছাড়া নাকি অন্য কোথাও ঠিকমতো মাউলটাশে তৈরি হয় না৷ মাউলটাশে শোয়েবিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য৷ ক্যাথলিকদের যে সব দিনে মাংস খাওয়া নিষেধ, সে সব দিনে তারা মাউলটাশে খায়৷ পুরের ভিতর মাংস থাকে, দয়াময় ঈশ্বর তো আর সেটা দেখতে পান না – কাজেই দোষ হয় না!
ছবি: picture alliance/DUMONT Bildarchiv/R. Schmid
গ্রুনকোল-আইনটপ্ফ’ – কেল স্টু
কেল হলো লিফ ক্যাবেজ বা এক ধরনের বাঁধাকপি৷ রংটা সবুজ বলে জার্মানে তার নাম সবুজ বাঁধাকপি৷ আজ এই কেল ক্যাবেজকে সুপারফুড বলে মনে করা হয়, কিন্তু উত্তর জার্মানিতে তার চল বহুদিনের৷ এমনকি সেখানে কেল উৎসবে কেলের রাজা আর কেলের রানি নির্বাচন করা হয়৷ ক্ষেতে ঠান্ডা পড়লে নাকি সবুজ বাঁধাকপির স্বাদ আরো ভালো হয়৷ শীতকালে ঘাটেবাজার আলু আর নানা ধরনের সসেজ মিশিয়ে কেলের স্টু বিক্রি করা হয় – লোকজন খেয়ে প্রাণ গরম করেন৷
ছবি: Colourbox
‘কোল-রুলাডে’ – ক্যাবেজ রোল
জার্মানরা শীতে বাঁধাকপির পাতায় মোড়া, কিমা আর বাদামের পুর দেওয়া ক্যাবেজ রোল খেতে খুব ভালোবাসেন৷ রোলগুলো সুরুয়া বা টমেটো সসে কম আঁচে সেদ্ধ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Stockfood
‘আয়ার মিট সেন্ফসোসে’ – ডিম আর মাস্টার্ড সস
সেদ্ধ ডিমের ওপর মাস্টার্ড সস, সাথে সেদ্ধ আলু৷ সোজা রান্না, স্বাদও সহজ-সরল৷ ছোটরা খেতে ভালোবাসে – সে কথাটাও তো ভাবতে হবে!
ছবি: Colourbox
10 ছবি1 | 10
ওর দাদুর বাড়ি আর একটু গাঁয়ের দিকে৷ দাদু-দিদার কাছে গেলে, জানলার কার্নিশ থেকে জল চুঁইয়ে যে সব বরফের চোঙা হয়ে থাকে, তার একটা ভেঙে নিয়ে প্যানে গলিয়ে চায়ের জল গরম করা হয়৷ মাংস রাখা থাকে হিটিং বিহীন পাশের একটা ঘরে: দিব্যি জমে বরফ হয়ে থাকে রেইনডিয়ারের মাংস৷ দাদু গিয়ে করাত দিয়ে সেই মাংস কেটে নিয়ে এলে, তবে দিদা নাতির জন্যে মাংস রাঁধেন৷ আহা৷
কত টেম্পেরেচার সে দেশে? এই প্রশ্ন করতে আলেক্স বলল: শীতে না গরমে? দু'টোই, আমি বললাম৷ শীতে মাইনাস ৬০ অবধি নামে শুনেছি, গরমে ৪৫ অবধি উঠতে দেখেছি৷ এ তো দেখছি ওভেন আর রেফ্রিজারেটরের মহামিলন – বললাম আমি৷ বলে আবার প্রশান্ত মহাসাগরের ম্যাপ দেখতে শুরু করলাম৷
সে তুলনায় ইউরোপ নাতিশীতোষ্ণ, কিন্তু এখানকার শীতের আবার নানান ফ্যাকড়া আছে৷ সে সব ফ্যাকড়ার অনেকটাই গিন্নির কাছে শেখা, কেননা সে এই শীতের দেশের মেয়ে৷ ধরুন ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে শীত নাকি শুকনো শীতের চাইতে বেশি কষ্টদায়ক৷ শুনেই আমি বললাম, হ্যাঁ, কলকাতার ভ্যাপসা গরমের চেয়ে যেমন দিল্লির শুকনো গরম ভালো৷
ঐ একই কারণে নাকি তাপমাত্রা যখন শূন্যের কাছাকাছি নামে, তখন শীতে অনেক বেশি কষ্ট পেতে হয়, কিন্তু মাইনাস দশে ততটা শীত করে না! দেখেছি, কথাটা সত্যি৷ ব্যাখ্যাটাও খুব সহজ-সরল: তাপমাত্রা শূন্যের নীচে নামলে আর বাতাসে আর্দ্রতা থাকে না৷ ঐ সেই স্যাঁতসেঁতে গরমের মতো স্যাঁতসেঁতে শীত আর কি৷
শীতের জামাকাপড়৷ জার্মানিতে থাকলেই মানুষজনের কাছে দু'টি আপ্তবাক্য শুনবেন৷ প্রথমত, খারাপ আবহাওয়া বলে কিছু নেই; আছে শুধু ভুল বা অপর্যাপ্ত জামাকাপড় পরা লোকজন৷ অর্থাৎ ঠিকমতো শীতের জামা পরলে আবার শীত কোথায়? দ্বিতীয়ত, সেই জামাকাপড় পরতে হবে ‘‘পেঁয়াজের নীতি'' অনুসারে, অর্থাৎ পরতের ওপর পরত জামাকাপড়৷ একখানা ভারী সোয়েটার বা কোট বা ওভারকোট নয়, একটার ওপর আরেকটা৷ প্রতি দুই পরতের মধ্যে বাতাসের ইনসুলেশান থাকায় শীত আর ঢুকতে পারে না, আবার শরীরের তাপ বেরতে পারে না৷
তৃতীয়ত, পরিশ্রম৷ হাঁটাহাঁটি, চলাফেরা করলে শরীর যত গরম হয়, শীত তত কম লাগে৷ শীত দেখলেই যাদের কম্বলের ভেতরে সেঁধোতে ইচ্ছে করে, আমি তাদের একজন – ওদিকে গিন্নির আবার বরফ পড়া দেখলে মেয়েবেলায় ব্রেসলাউতে স্যাচেল কাঁধে লিসিয়ুম যাবার কথা মনে পড়ে যায়, পথে বরফের গোলা তৈরি করে ছোঁড়াছুঁড়ি, মারামারি, সে নাকি ভীষণ মজা৷ বিশেষ করে পাভেউ নামের একটা ছেলে –
ব্যস, ঐ অবধি শুনেই আমার শীতের ওপর আরো রাগ বেড়ে যায়৷ আমি সেই পাভেউ-এর ছবি দেখেছি৷ ছোঁড়াকে সত্যিই দেখতে ভালো – তবে নিশ্চয় আমার মতো বুদ্ধিমান নয় – হ্যাঁ, কি বলছিলাম? শীতের সঙ্গে আমার আড়ি কিন্তু টেম্পারেচারের দরুণ নয়, আলোর দরুণ৷ শীতকালে দিনটা যে ছোট হতে হতে ঘণ্টা আটেকের হয়ে দাঁড়ায়, তাতেই আমার আপত্তি৷ মানুষজন অন্ধকারে উঠে অফিসে গিয়ে আবার অন্ধকারের মধ্যেই বাড়ি ফেরেন৷ রাত যেন শেষই হতে চায় না৷ মনস্তাত্ত্বিকরাও বলেন, শীতে আলো থাকে না বলেই নাকি এদেশের মানুষজন বিষাদে ভোগেন৷
আর আমি এদেশে বিষাদে ভুগি শীত কি গ্রীষ্মের কারণে নয়; আমি বিষাদে ভুগি এ দেশটা সে দেশ নয় বলে৷ ভেবে দেখেছি, ভাদ্দরমাসের তালপাকা গরমের জন্যেও যেরকম মন কেমন করে, সেরকম শীতের ফুলকপির জন্যে৷ গরমকাল মানে যেদেশে আম-কাঁঠাল আর লিচুর মরশুম, সেদেশের মানুষ গরমের ওপর রাগ করবে কী করে? বর্ষার ওপরে রাগ করতে গেলে মনে পড়ে রবি ঠাকুরের হাজারটা গান আর খিচুড়ি৷ শীতের ওপর রাগ করা সম্ভবই নয়, হর্টিকালচারাল গার্ডেন আর সেই-মেয়েটা-যার নাম-করতে-নেই, তারা আছে কী করতে? মাসির বুনে দেওয়া একমেবাদ্বিতীয়ম নীলরঙের হাফহাতা সোয়েটার পরে বড়মামার সঙ্গে ইডেন গার্ডেনের সোনালি রোদ্দুরে জয়সীমার সারাদিন ধরে ঠুক ঠুক করে ৭৪ রান –
প্রবাসী শীতে কষ্ট পায়, না প্রবাসে, সে কথাটা তাকে কে বলে দেবে?
শীতের গ্রাম বাংলা
শীত মৌসুমে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আসে বড় ধরণের পরিবর্তন৷ আর এ পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি ধরা দেয় গ্রাম-বাংলায়৷ বাংলাদেশের শীতকালের কিছু ছবি দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: Muhammad Mostafigur Rahman
কুয়াশা ঢাকা সকাল
শীতের সকালে প্রায়ই কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় গ্রাম বাংলার প্রতিটি প্রান্তর৷ ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে৷ অনেক সময় ঘন কুয়াশায় সূর্যের দেখা মেলে অনেক দেরিতে৷
শীত মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠ হলুদ গালিচায় ঢেকে ফেলে সরিষার ফুলে৷ এ সৌন্দর্যের জুড়ি নেই৷
ছবি: Muhammad Mostafigur Rahman
শীতের শবজি
শীতে গ্রাম বাংলায় চাষ হয় নানা ধরণের সবজি৷ এ সময়ে ফসলের মাঠ সবুজে ভরে ওঠে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আগুন পোহানো
গ্রাম-বাংলায় এখনো আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন অনেকেই৷ শীতের সকালে চাদর মুড়িয়ে আগুনের পাশে বসে থাকার মজাই আলাদা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শীতের পিঠা
শীতে খেজুরের রস দিয়ে গ্রাম বাংলায় তৈরি হয় নানা রকম পিঠা৷ এটা শীতের আরেক আকর্ষণ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শীতের খেলা
শীতে মাঠ থেকে ফসল তোলা হয়ে গেলে ছেলে-মেয়েরা মেতে ওঠে নানান গ্রামীণ খেলায়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
মাছ ধরা
শীতে জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেলে খালে-বিলে মাছের আধিক্য দেখা যায়৷ এ সময়ে বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই হয় মাছ ধরার উৎসব৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শীতের কষ্ট
সব ভালোর বিপরীতেই খারাপ কিছু দিক থাকে৷ তেমনি শীতেরও আছে খারাপ দিক৷ শীত বেশি জেঁকে বসলে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই কষ্টে পড়েন৷ শীতের কষ্ট ছাড়াও ঠান্ডাজনিত নানান রোগেও ভোগেন কেউ কেউ৷