শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে আগে যে উন্মুক্ত সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল, এখন সেটা নেই৷ তবে শীত এখনো কবি-সাহিত্যিকদের পছন্দ৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে একসময় শীতকালে অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো৷ কিন্তু এখন সেই সংখ্যা কমে গেছে৷ ডয়চে ভেলেকে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন ড. ইসলাম৷ ‘‘এখন তো আর গ্রামদেশে ঐগুলি বেশি দেখা যায় না৷ তার কারণ হচ্ছে আগে যে উন্মুক্ত একটা সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল, এখন সেটা নেই৷ এখন অনেকটাই আমরা রক্ষণশীলতার ভেতরে পড়ে গেছি৷ এখন অনেকে ছেলে-মেয়ের অংশগ্রহণে কোনো কিছু করাকে নিরুৎসাহিত করেন৷ এখন ধর্মীয় উৎসবগুলি বেশি জাঁকজমক দিয়ে হয়,'' বলেন তিনি৷
তবে রক্ষণশীলতাই সাংস্কৃতিক চর্চা কমে যাওয়ার একমাত্র কারণ নয়, বলে জানান ইংরেজির এই অধ্যাপক৷ গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নও একটি বড় কারণ বলে মনে হয় তাঁর৷ ‘‘এখন অনেক মানুষের বাড়িতে টেলিভিশন এসে গেছে, অনেক মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে৷ ফলে সেই মানুষগুলি আর মাঠে গিয়ে রাতভর যাত্রাপালা দেখার উৎসাহ পায় না,'' মনে করেন অধ্যাপক ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে পালা-পর্বনে যে সমস্ত অনুষ্ঠান হত গ্রামে, সেগুলো খুবই ক্ষুদ্র পর্যায়ে হতো, কিন্তু গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে সেটি অনেকটাই সাড়া তুলতো৷ এখন টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং ফেসবুক এসে যাওয়ায় ঐ তাড়াটুকু মানুষ আর অনুভব করে না৷''
‘রক্ষণশীলতা বাড়ছে বলে সাংস্কৃতিক চর্চা কমছে'
ড. ইসলাম বলেন, এখন বেশিরভাগ গ্রামে বিদ্যুৎ আসায় গ্রামের মানুষের জীবন শহরের মতো হয়ে গেছে৷ ‘‘আগে গ্রামের মানুষ মনে করতেন, কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানই সারা বছরের সম্পদ৷ ফলে সবাই সেগুলোতে যেতেন৷ কিন্তু এখন টেলিভিশনে সব পাওয়া যাচ্ছে৷''
অবশ্য এই পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন নন তিনি৷ কিছুদিনের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা কমে গেলেও আবার তা ফিরে আসবে বলে আশাবাদী এই শিক্ষাবিদ৷ ‘‘সংস্কৃতির একটা শক্তি হচ্ছে, সংস্কৃতি স্মৃতিনির্ভর৷ মানুষের স্মৃতির উপর সংস্কৃতি বেঁচে থাকে৷ সেজন্য অনেক পুরনো সংস্কৃতি আবার নতুন করে হাজির হয়৷ গত শীতে আমি আবাহনীর মাঠে দেখলাম কয়েকজন ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আর সেখানে সব বুড়োরা হাজির হয়েছেন৷ তাঁরা কিন্তু স্মৃতি থেকেই সেখানে গিয়েছেন৷ অর্থাৎ সংস্কৃতি কখনই ভুলে যাওয়ার বিষয় না৷ যে সংস্কৃতি সকলের অংশগ্রহণে একসময় তৈরি হয়েছিল, এখন তার উপর যতই বিপদ আসুক, তাকে যতটাই অবহেলিত করে রাখা হোক না কেন, সেটি আবার ফিরে আসবে,'' বলেন অধ্যাপক ইসলাম৷
বাংলাদেশের কিছু লোকসংস্কৃতি
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে বৈচিত্রময় সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে৷ কিন্তু এর অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে কালের হাওয়ায়৷ বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য কিছু উপাদান দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: M. M. Rahman
নৌকা বাইচ
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে শত শত বছরের ঐহিত্য হিসেবে এখনো টিকে আছে নৌকা বাইচ৷ সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে নদীনালা যখন পানিতে টইটম্বুর থাকে, সেসময়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়৷ নৌকা বাইচের সময় ঢোল ও করতালের সাথে সাথে মাঝি-মাল্লারা এক সুরে গান গেয়ে বৈঠা চালান৷
ছবি: M. M. Rahman
ষাঁড়ের লড়াই
অতীতে গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় একটি শৌখিন একটি খেলা ছিল ষাঁড়ের লড়াই৷ ফসল তোলার পরে ফাঁকা মাঠে আয়োজন করা হতো জনপ্রিয় এ খেলাটির৷ দূর-দূরান্ত থেকে মানুষেরা জড়ো হতেন শ্বাসরুদ্ধকর এ খেলা দেখতে৷ বর্তমানে এই শৌখিন এ খেলাটি বিলুপ্তির পথে৷ বাংলাদেশে অবশ্য খেলাটির আয়োজনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে৷
ছবি: M. M. Rahman
গরুর গাড়ির দৌড়
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় খেলা৷ ফসল তোলার পর কৃষকদের আনন্দ দিতে খালি মাঠে এ দৌঁড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়৷ আর গরুর গাড়ি নিয়ে এ খেলায় অংশ নেন মূলত কৃষকরাই৷ রোমাঞ্চকর এই প্রতিযোগিতাকে ঘিরে গ্রামীণ মেলাও বসে৷
ছবি: M. M. Rahman
মোরগ লড়াই
গ্রামবাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী একটি খেলা মোরগ লড়াই৷ বাংলাদেশ থেকে এ খেলাটি হারাতে বসলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকায় এখনো মোরগ লড়াইয়ের ঐতিহ্য টিকে রয়েছে৷
ছবি: M. M. Rahman
লাঠি খেলা
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতির একটি অংশ লাঠি খেলা৷ ঢোলের তালে নেচে নেচে আত্মরক্ষার নানান কৌশল দেখানো হয় লাঠি খেলার মাধ্যমে৷ একসময় রোমাঞ্চকর এ খেলাটি গ্রামাঞ্চরে বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হতো৷ তবে এখন আর আগের মতো খেলাটির আয়োজন হয় না৷
ছবি: M. M. Rahman
সার্কাস
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো কিছু সার্কাসের আয়োজন হয়৷ তবে লোকসংস্কৃতির এই অনুষঙ্গটির এখন দুর্দিন বলা যায়৷ নানারকম শারীরিক কসরত, পশু-পাখির খেলা আর হাস্যরসের খোঁজে সার্কাস দেখতে অতীতে দলবেঁধে যেতেন গ্রামবাংলা মানুষেরা৷ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারণে এ শিল্পটি এখন সংকটের মুখে৷
ছবি: M. M. Rahman
গ্রামীণ মেলা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অন্যতম উপাদান গ্রামীণ মেলা৷ বাংলাদেশের সর্বত্রই এখনো প্রচুর মেলা বসে৷ গ্রামের পরিমণ্ডল অতিক্রম করে এখন শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে মেলার সংস্কৃতি৷ তবে হাজার বছরের পুরনো গ্রামীণ মেলা দিনে দিনেই জৌলুশ হারাচ্ছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
বায়োস্কোপ
বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্য বায়োস্কোপ৷ রং-বেরঙের কাপড় পরে, হাতে ঝুনঝুনি বাজিয়ে গাঁয়ের মেঠোপথে এখন আর ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না বায়োস্কোপওয়ালার৷ খঞ্জনি আর খালি গলায় গাওয়া গানের তালে বাক্সের ভেতর বদলে যাওয়া ছবি দেখে এককালে গল্পের জগতে হারিয়ে যেত গ্রামবাংলার মানুষ৷ টেলিভিশন শত শত চ্যানেলের ভিড়ে বায়োস্কোপের এখন তাই হারাতে বসেছে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
যাত্রা-পালা
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে যাত্রাপালাও বেশ উল্লেখযোগ্য৷ তবে জঙ্গিবাদ আর অশ্লীলতার ছোবলে যাত্রাপালা এখন হারাতে বসেছে বাংলাদেশ থেকে৷ অতীতে শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামমাঞ্চলে যে যাত্রাপালা বসত নানা কারণে এখন আর তার দেখা মেলে না৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
লোকজ গান
বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নানারকম লোকজ গান৷ ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, বাউলগান, গম্ভীরাসহ নানান লোকজ গানে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
নকশিকাঁথা
বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতিতে যুগ যুগ ধরে টিকে আসে নকশিকাঁথা৷ এখনো বাংলাদেশের যশোর, জামালপুরসহ গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকার ঘরে ঘরে তৈরি হয় নজরকাড়া নকশিকাঁথা৷ ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথা এখন বাংলাদেশের গণ্ডি পেড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছ বিশ্ব দরবারেও৷
ছবি: M. M. Rahman
তাঁত শিল্প
একসময় ঢাকাই মসলিনের সুনাম ছিল বিশ্বজোড়া৷ মসলিন হারিয়ে গেলেও টিকে আছে ঢাকাই জামদানি৷ এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো টিকে আছে এই তাঁত শিল্প৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কুমিল্লার খাদি, ঝালকাঠীর গামছা নরসিংদীর লুঙ্গি ইত্যাদি৷
ছবি: DW/M. Mamun
12 ছবি1 | 12
অবশ্য সব সংস্কৃতি যে ফিরে আসে তাও মনে করেন না এই সাহিত্যিক৷ তবে পুরোপুরি না আসলেও সংস্কৃতি বিবর্তিত হয়ে আসে৷ ‘‘যেমন ধরুন আমাদের পল্লিগীতিটা যদি ফিউশন মিউজিকের মধ্য দিয়েও আসে মন্দ কী?,'' বলেন ড. ইসলাম৷
সাহিত্যে শীত
সাহিত্যে শীত বলতে সাধারণত জরাজীর্ণ একটা সময়কে বোঝায়৷ কিন্তু শীতের একটা আনন্দও আছে, বলে মনে করেন অধ্যাপক ইসলাম৷ ‘‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে; পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে' গানের মাধ্যমে শীতের দারুণ একটা আনন্দের বিষয় সঞ্চারিত করেছেন৷''
শীত নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শীতের সময়টা কুয়াশার জন্য একটু রহস্যঘেরা থাকে৷ তাই যখনই কোনো রহস্যঘেরা আবহ তৈরি করতে হয় তখন মানুষ শীতের কাছে ফিরে যায়৷ ‘‘আমি আমাদের পেইন্টিংয়েও দেখেছি শীতের উপস্থিতি৷ আমাদের কাইয়ুম চৌধুরী শীতের ছবি এঁকেছেন, সফিউদ্দিন আহমেদ সাহেবের ‘শীত' নামে একটা ছবিই আছে,'' জানান অধ্যাপক ইসলাম৷ শীতের সময় প্রকৃতি যে ঘোমটা পরে বসে থাকে, কবি-সাহিত্যিকদের তা পছন্দ৷ তাই তাঁরা শীতকাল নিয়ে লেখালেখি করেন৷
পশ্চিমে যেভাবে শীতকে আঁকা হয়, বাংলাদেশে তার চেয়ে অনেক বেশি উত্তাপ নিয়ে, আনন্দ নিয়ে আঁকা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ ‘‘কারণ আমাদের জন্য শীত একটা খুব গতিশীল ও বিপরীতধর্মী ঋতু, জুবুথুবু কোনো ঋতু বটেই নয়৷''
ইংরেজি কবি শেলি তাঁর এক কবিতায় শীতকে আশাবাদের ঋতু হিসেবেও তুলে ধরেছেন৷ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘‘ও, ভিন্ড, ইফ ভিন্টার কামস্, ক্যান স্প্রিং বি ফার বিহাইন্ড?'' অর্থাৎ ‘‘যদি শীত আসে, বসন্ত কি খুব দূরে থাকতে পারে?''
শীতের গ্রাম বাংলা
শীত মৌসুমে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে আসে বড় ধরণের পরিবর্তন৷ আর এ পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি ধরা দেয় গ্রাম-বাংলায়৷ বাংলাদেশের শীতকালের কিছু ছবি দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: Muhammad Mostafigur Rahman
কুয়াশা ঢাকা সকাল
শীতের সকালে প্রায়ই কুয়াশার চাদরে ঢেকে যায় গ্রাম বাংলার প্রতিটি প্রান্তর৷ ঢেকে যায় কুয়াশার চাদরে৷ অনেক সময় ঘন কুয়াশায় সূর্যের দেখা মেলে অনেক দেরিতে৷
শীত মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার ফসলের মাঠ হলুদ গালিচায় ঢেকে ফেলে সরিষার ফুলে৷ এ সৌন্দর্যের জুড়ি নেই৷
ছবি: Muhammad Mostafigur Rahman
শীতের শবজি
শীতে গ্রাম বাংলায় চাষ হয় নানা ধরণের সবজি৷ এ সময়ে ফসলের মাঠ সবুজে ভরে ওঠে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আগুন পোহানো
গ্রাম-বাংলায় এখনো আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেন অনেকেই৷ শীতের সকালে চাদর মুড়িয়ে আগুনের পাশে বসে থাকার মজাই আলাদা৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শীতের পিঠা
শীতে খেজুরের রস দিয়ে গ্রাম বাংলায় তৈরি হয় নানা রকম পিঠা৷ এটা শীতের আরেক আকর্ষণ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শীতের খেলা
শীতে মাঠ থেকে ফসল তোলা হয়ে গেলে ছেলে-মেয়েরা মেতে ওঠে নানান গ্রামীণ খেলায়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
মাছ ধরা
শীতে জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেলে খালে-বিলে মাছের আধিক্য দেখা যায়৷ এ সময়ে বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই হয় মাছ ধরার উৎসব৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শীতের কষ্ট
সব ভালোর বিপরীতেই খারাপ কিছু দিক থাকে৷ তেমনি শীতেরও আছে খারাপ দিক৷ শীত বেশি জেঁকে বসলে নিম্ন আয়ের অনেক মানুষই কষ্টে পড়েন৷ শীতের কষ্ট ছাড়াও ঠান্ডাজনিত নানান রোগেও ভোগেন কেউ কেউ৷