মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত নয়, জিন্স বা স্কার্ট পরা উচিত নয়৷ আসলে তাদের ভালোর জন্যই নাকি এ সব বলা৷ ঈশা ভাটিয়া মনে করেন, ভারতে আইনের অভাবের কারণেই কিছু দল ভালোমন্দের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব নিয়েই ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে মানুষের হৃদয় জয় করে নিলেন৷ ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছিলেন, মেয়েদের বাইরে যেতে বাধা দেওয়ার বদলে বাবা-মায়েদের উচিত নিজেদের ছেলেদের উপর নজর রাখা৷ এমন মন্তব্যের পর অনেক করতালি পড়ে৷ সোজা ও কড়া কথা বলে তিনি শুধু ভারতীয় নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ারও বাহবা কুড়িয়েছিলেন৷
কিন্তু তাঁর নাকের ডগায় হিন্দু মহাসভা যখন জিন্স ও মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে ধর্ষণ ও নারীদের উত্ত্যক্ত করার মতো প্রবণতা বন্ধ করার দাওয়াই বাতলে দিলো, তখন কিন্তু সেই একই মোদী ও তাঁর সরকার মুখে কুলুপ আঁটলেন৷ এমনকি সবে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সদ্য শপথ নিয়ে মনোহরলাল খাট্টারও নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলেন৷ অথচ হরিয়ানার যে খাপ পঞ্চায়েত বার বার নারীদের মর্যাদার পাঠ দেবার চেষ্টা করে থাকে, তারাও হিন্দু মহাসভার ধর্মপাল সিবাচের সঙ্গে একমত বলে মনে হলো না৷ অথচ সরকার নীরবই রইল৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
হরিয়ানা ব্যতিক্রম নয়৷ তথ্য জানার অধিকার আইন – আরটিআই অনুযায়ী পেশ করা এক প্রশ্নের জবাবে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের পুলিশ প্রধানের কণ্ঠেও শোনা গেল একই সুর৷ তাঁর মতেও ধর্ষণের কারণ মোবাইল ফোন ও নারীদের পোশাক৷ টিভি চ্যানেলগুলি বিষয়টি নিয়ে খুব সক্রিয় হয়ে পড়েছিল৷ যারা এমন মনোভাব পোষণ করে, তাদের আরও একবার ‘ভারতের তালেবান' বলার সুযোগ পেয়ে গেলেন নারী অধিকার রক্ষায় মিছিল করতে অভ্যস্ত রঞ্জনা কুমারী৷ কিন্তু এত সব কিছুর পরেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় প্রধানমন্ত্রী একটিও টুইট করার সময় পেলেন না৷ এই নীরবতাকে কি সমর্থন হিসেবে গণ্য করা যায়? নাকি সরকার নারীদের সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট আইন প্রণয়ন করতে ব্যর্থ৷
বজরং দল বা হিন্দু মহাসভার মতো সংগঠন ভারতীয় সংস্কৃতি ও মর্যাদার দোহাই দিয়ে এই প্রথম ফরমান জারি করেনি৷ বহু বছর ধরে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা ভালোবাসা দিবসের দিন তারা ভাঙচুর করে চলেছে৷ ক্লাব বা পার্কে ঢুকে প্রেমিক যুগলদের মারধোরও করেছে তারা৷ কিছুদিন আগেই দক্ষিণ ভারতে বিজেপি দলের কয়েকজন কর্মকর্তা এক ক্যাফের মধ্যে মারধোর করেছিলেন৷ এর বদলা নিতে কোচি শহরে তরুণ-তরুণীরা এক ‘কিস ডে' বা চুম্বন দিবস পালন করার পরিকল্পনা করেছেন৷ তাদের বক্তব্য, ঘৃণার জবাব ভালোবাসা দিয়েই দেওয়া উচিত৷
এখন প্রশ্ন হলো, এমন পদক্ষেপ নিলে ‘মরাল পুলিশ'-এর ভূমিকায় এই গোষ্ঠীগুলি চুপ করে যাবে? নাকি তাদের আরও জঙ্গি রূপ দেখা যাবে? জিন্সের উপর নিষেধাজ্ঞার জবাব স্কার্ট পরে দেওয়া যাবে না৷ কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক – তা নিয়ে ব্যক্তিগত স্তরে লড়াই করা যেতে পারে না৷ টেলিভিশন চ্যানেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চেঁচামেচি করেও কোনো ফল পাওয়া যাবে না৷ নারীদের সুরক্ষা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব৷ এর জন্য চাই কড়া আইন৷ প্রধানমন্ত্রী অ্যামেরিকায় দেওয়া তাঁর ভাষণে বলেছেন বটে, যে কথায় কথায় আইন তৈরি করতে তিনি পছন্দ করছেন না৷ কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীদের সুরক্ষা ও তাঁদের ভালোর জন্য এটুকু তো তাঁকে করতেই হবে৷