প্রচলিত প্রয়োগের বাইরেও সৌরশক্তির আরও অনেক ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে৷ তবে সূর্যের রশ্মি কাজে লাগিয়ে শুধু বাতাস থেকে বিমান চালানোর জ্বালানি উৎপাদনের সাহসি প্রচেষ্টা সত্যি বিরল৷
বিজ্ঞাপন
রাইনহার্ড মাই প্রায় ২৫ বছর আগে বিমানে চড়ার রোম্যান্টিক অনুভূতি নিয়ে গান বেঁধেছিলেন৷ কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে৷ এখন হয়তো তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও বিমানে ভ্রমণের লজ্জা নিয়ে গান লিখতেন৷ কারণ আকাশ বিমানে ভরে যাচ্ছে৷ দিনের পর দিন আমরা গোটা বিশ্বে সেকেন্ডে ১১,৫০০ লিটার এভিয়েশন ফুয়েল বা তেল পোড়াচ্ছি৷ এভাবে কোটি কোটি বছর ধরে মাটির নীচে চাপা গাছপালা থেকে খনিজ তেলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়া তরান্বিত করছে৷
কিন্তু কোনো কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে না, বিমানের জন্য যদি এমন জ্বালানী তৈরি করা যেত, তাহলে কেমন হতো? শুধু পানি, বাতাস ও সূর্যের আলোই যদি তার উপাদান হতো?
জুরিখ শহরের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক সেই লক্ষ্যেই গবেষণা চলছে৷ ছাদের উপর এক বিশেষভাবে তৈরি সৌর চুল্লি বসানো হয়েছে, যা সূর্যের ঘনিভূত রশ্মির সাহায্যে চারিপাশের বাতাস থেকে জ্বালানী সৃষ্টি করে৷
সেটি আডো স্টাইনফেল্ড ও তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সেরা সৃষ্টিকর্ম৷ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই টিম সেই যন্ত্র নিয়ে কাজ করছে৷ সূর্য, বাতাস ও পানি থেকে জ্বালানী তৈরির তত্ত্ব যে সত্যি কার্যকর হতে পারে, এই প্লান্ট তার সাক্ষাৎ প্রমাণ৷
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাতাস শুষে নেওয়া হয় এবং তার মধ্য থেকে পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড সংগ্রহ করা হয়৷ তারপর আয়না বসানো ডিশে সূর্যের রশ্মি পুঞ্জিভূত করা হয়৷ এভাবে দুটির মধ্যে একটি রিয়্যাক্টরকে দেড় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উত্তপ্ত করা হয়৷ এই দুই চুল্লির মূলে রাখা এক ক্যাটালিটিক কনভার্টার রূপান্তরের প্রথম ধাপ সম্ভব করে৷
স্পঞ্জের মতো বৈশিষ্ট্যের এই কনভার্টারের উপর সেরক্সাইড নামের বিরল ধাতুর প্রলেপ থাকে৷ এর মাধ্যমে পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উপাদানগুলি বিভক্ত করে আবার নতুন করে জোড়া দেওয়া হয়৷ ফলে তথাকথিত ‘সিনগ্যাস' সৃষ্টি হয়৷
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ছয়টি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটবে
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অবিশ্বাস্য বেশ কিছু ঘটনা ঘটবে৷ বিমান চলাচল দুরুহ হবে, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বাড়বে, বাড়বে বজ্রপাত৷ চলুন জেনে নিই ছয়টি ঘটনা যা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে ঘটবে৷
বিমানযাত্রা কঠিন হবে
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিমানে ঝাঁকুনি বেড়ে যাবে, ফলে বিমানযাত্রায় শারীরিক ও মানসিক চাপ আরো বাড়বে৷ বিশেষ করে যাত্রীবাহী বিমানগুলো যে পথে চলাচল করে, সেই পথ আগের চেয়ে আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে বলে এক গবেষণায় জানা গেছে৷
ছবি: Colourbox/M. Gann
জাহাজের পথে আইসবার্গ
সমুদ্রে জাহাজ চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি করবে ভাসমান আইসবার্গ৷ গত এপ্রিলে চারশ’ আইসবার্গ নর্থ আটলান্টিকে জাহাজ চলাচলের জলসীমায় প্রবেশ করে৷ ফলে অনেক জাহাজ গন্তব্যে পৌঁছাতে বেশি সময় নিয়েছে, ঘুরে যাওয়ার কারণে তেল খরচও গেছে বেড়ে৷
ছবি: Getty Images/J. Raedle
বজ্রপাত আরো ঘনঘন হবে
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাত আরো ঘনঘন হবে৷ যদিও এতে দাবানলের ঝুঁকি বাড়বে৷ তবে বজ্রপাতের ফলে নাইট্রোজেন অক্সাইড উৎপন্ন হয় যা বিশ্বের বায়ুমণ্ডলির জন্য উপকারী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বাড়বে
ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরিগুলো ভবিষ্যতে সক্রিয় হতে শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমনটা ঘটার আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: Getty Images/S. Crespo
আপনার রাগ বাড়বে
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের মুডও পরিবর্তন করে দেবে৷ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে অস্থিরতাও বাড়বে৷ এমনকি সহিংস আচরণ করার প্রবণতাও দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷
প্রাণীর আকার ছোট হবে
এই পরিবর্তনটি অবশ্য চোখে পড়তে সময় লাগবে৷ তবে কয়েক কোটি বছর আগে দৈত্যাকারের প্রাণিগুলো ছোট হয়ে গিয়েছিল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও৷ ভবিষ্যতেও তেমনটা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: Fotolia/khmel
6 ছবি1 | 6
হাইড্রোজেন ও কার্বন মনোক্সাইডের এই মিশ্রণ অবশেষে এক ধরনের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এভিয়েশন ফুয়েলের মতো জ্বালানীতে রূপান্তরিত করা যায়৷ এভাবে তৈরি করা কৃত্রিম জ্বালানী ব্যবহার করলে বায়ুমণ্ডলে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন করা হবে, সেটি তো বাতাস থেকেই নেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তার ফলে সমস্যা দূর হবে না৷ জুরিখ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফিলিপ ফুরলার বরেন, ‘‘এই মুহূর্তে এই প্লান্টে দিনে এক ডেসিলিটারেরও কম জ্বালানী তৈরি হয়৷ অর্থাৎ উৎপাদনের ব্যয় এখনো খুব বেশি৷’’
অন্যদিকে অ্যাটলান্টিক মহাসাগর পেরোতে একটি বিমান সেকেন্ডে প্রায় এক লিটার তেল পোড়ায়৷ অর্থাৎ ঘণ্টায় ৩,০০০ লিটার৷
জুরিখের এই প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে স্পেনে আরও বড় পরীক্ষামূলক প্লান্ট চালু করেছে৷ কিন্তু সেখানেও জ্বালানী উৎপাদনের পরিমাণ অতি সামান্য৷ তবে ‘সান টু লিকুইড’ নামের কৌশল যে বড় আকারেও কার্যকর হতে পারে, এই উদ্যোগ তা প্রমাণ করতে পেরেছে৷
তাহলে এখনই কেন মরুভূমির উপর আরও বড় প্লান্ট তৈরি করা হচ্ছে না? এর ব্যয়ভার হলো মূল সমস্যা৷ পেট্রোলিয়াম থেকে যে এভিয়েশন ফুয়েল তৈরি হয়, তার দাম এখনো যথেষ্ট কম৷ বিমানের টিকিটের প্রায় এক তৃতীয়াংশই জ্বালানীর খরচ মেটাতে চলে যায়৷
ক্রিস্টিয়ান অফনব্যার্গ/এসবি
২০১৮ সালের ছবিঘরটি দেখুন...
পরিবেশবান্ধব বিমান কেমন হবে?
বিমানে চড়ছেন মানেই আপনি পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি করছেন৷ তাহলে কি বিমান ভ্রমণ ছেড়ে দেবেন! না, তবে সমাধান তখনই হবে যখন পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি ইলেকট্রিক বিমানগুলো পুরোদমে চালু হবে৷ কেমন হবে ভবিষ্যতের সেই বিমান? চলুন, দেখে আসি-
ছবি: Eviation
ছোট, হালকা এবং দূষণমু্ক্ত বিমান
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলা বিমান কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন গ্যাস বা কণা– যেমন নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন করে না৷ এসব বিমান জীবাশ্ম জ্বালানিতে চলা বিমানের চেয়ে ছোট, হালকা এবং কার্যকরী হয়৷ ২০১৫ সাল থেকে স্লোভেনিয়ার স্টার্ট-আপ বিমান পরিবহন সংস্থা পিপিস্ট্রেল তাদের আলফা ইলেক্ট্রো মডেলের বিমান দিয়ে তা ইতিমধ্যে প্রমাণ করছে৷
ছবি: Pipistrel
ছোট বিমান নিয়ে নতুন আশা
বেশিরভাগ কোম্পানি আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইলেকট্রিক বিমান ব্যবহারের কথা ভাবছে৷ ইসরায়েলি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন তাদের নয় আসন বিশিষ্ট ‘নাইন সিটার’ বিমান দিয়ে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে৷ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি অ্যালিস বিমানটির প্রটোটাইপ ঘণ্টায় সাড়ে ছয়শ’ মাইল বা এক হাজার কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে৷ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৯ সাল নাগাদ তারা বাণিজ্যিকভাবে এই বিমান চালু করতে পারবে৷
ছবি: Eviation
সরাসরি ওঠানামা
জার্মান কোম্পানি লিলিয়ামের চালু করা ফ্লাইং ট্যাক্সি ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রথম সফলভাবে উড্ডয়ন করে৷ পাঁচ আসন বিশিষ্ট এই বিমানটি ওড়ার সময় রানওয়েতে না চলেই সরাসরি উড়তে পারে৷ আবার নামার সময় সরাসরি নামতে পারে৷ এটি ১৯০ মাইল যেতে পারে৷ লন্ডন থেকে প্যারিস যেতে এর এক ঘণ্টার বেশি সময় এর লাগে না৷
ছবি: Lilium
পুরনো এবং নতুনের মিশ্রণ
কিছু বিমান তৈরির প্রতিষ্ঠান প্রথমেই ইলেকট্রিক বিমান তৈরির দিকে না গিয়ে হাইব্রিড বিমান তৈরির কথা ভাবছে৷ ২০১৭ সালের নভেম্বরে এয়ারবাস, রোলস রয়েস এবং সিমেন্স বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিড-ইলেকট্রিক বিমান তৈরির ঘোষণা দেয় ৷ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তৈরি ই-ফ্যান এক্স মডেলের বিমানটিতে ৩টি গ্যাস টারবাইন এবং একটি ইলেকট্রিক মোটর থাকবে৷
ছবি: Airbus
পরিবেশবান্ধব হওয়ার চেষ্টা ইজিজেটের
ব্রিটেনের সাশ্রয়ী বিমান পরিবহন সংস্থা ইজিজেট আরও বেশি পরিবেশবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করছে৷ অ্যামেরিকার স্টার্ট আপ কোম্পানি রাইট ইলেকট্রিকের সাথে সর্বোচ্চ ১৫০ যাত্রী বহন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিমান তৈরির ব্যাপারে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে৷ তবে এটি নিশ্চিত নয়, কবে নাগাদ ওই বিমানের একটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন দেখতে পাওয়া যাবে৷
ছবি: Wright Electric
বিদ্যুতায়িত ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইলেকট্রিক বিমানে ২০ বছরের মধ্যেই পুরোদমে চালু হয়ে যাবে৷ বেশ কিছু বিমান তৈরির সংস্থা ১৫০ থেকে সাড়ে ৬০০ মাইল যেতে সক্ষম৷ কিন্তু ইতিহাসের যে-কোনো সময়ের চেয়ে প্রযুক্তি এখন সবচেয়ে দ্রুত গতিতে ৷ কে জানে অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো আমরা নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলা বিমান দিয়ে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবো৷