ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘ক্লিন ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন’-এর মাধ্যমে দেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাড়াতে চান৷ সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে টয়লেট বসানোর সঙ্গে গণসচেতনতার মতো বিষয়ের প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে৷
বিজ্ঞাপন
উদ্দেশ্য মহৎ – এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ ভারতের মতো বিশাল ও জটিল দেশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করা ও তা বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব বলে ধরে নেওয়া হতো৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী এমন অসাধ্য সাধন করতে চেয়েছিলেন৷ দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ‘ক্লিন ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন'-এ শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷ গত ২রা অক্টোবর, মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিবসে শুরু হয়েছে এই অভিযান৷
শুক্রবার ল্যান্সেট মেডিকাল জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে ভারতের গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে৷ শুধু গ্রামাঞ্চলে শৌচাগার বসিয়ে এই পরিস্থিতির যথেষ্ট পরিবর্তন সম্ভব হবে না বলে তাতে মন্তব্য করা হয়েছে৷ ১৯৮৬ সাল থেকে বিভিন্ন স্যানিটেশন কর্মসূচির জন্য প্রায় ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করেও গোটা বিশ্বে ভারতের স্থান সবচেয়ে নীচে৷ নরেন্দ্র মোদীর সরকার এবার তার প্রায় ১০ গুণ ব্যয় করতে বদ্ধপরিকর৷ শুক্রবার প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী শৌচাগার তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য পদক্ষেপের প্রতিও মনোযোগ দিতে হবে৷ এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে গণ সচেতনতা সৃষ্টি করা৷ ভারতের মানুষের একটা বড় অংশ এখনো স্যানিটেশন সম্পর্কে তাদের প্রাচীন ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে ধরে রয়েছে৷ ফলে বাড়ির বাইরে গিয়ে প্রাতঃকৃত্য সারা বা প্রস্রাব করার মতো অভ্যাস বদলানো অত্যন্ত জরুরি৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
ল্যান্সেট মেডিকাল জার্নালে এই রিপোর্ট লিখতে মার্কিন ও ভারতীয় গবেষকরা ২০১১ সালে উড়িষ্যা রাজ্যের ১০০টি গ্রামে এক সরকারি স্যানিটেশন অভিযানের প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন৷ তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এই উদ্যোগ সত্ত্বেও শিশুদের ডায়েরিয়া বা আন্ত্রিক রোগ কমেনি৷ কৃমি থেকে সংক্রমণ থেকে শুরু করে শিশুদের অপুষ্টির ক্ষেত্রেও কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ বিশ্বব্যাংকের সূত্র অনুযায়ী এমন সব কারণে বছরে ৫,৪০০ কোটি ডলার অঙ্কের উৎপাদনশীলতা নষ্ট হয়৷
গবেষকরা কিন্তু এই কর্মসূচির আওতায় নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সন্তুষ্ট৷ অর্থাৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী শৌচাগার তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সব পরিবার এই কর্মসূচিতে অংশ নেয়নি৷ দলের প্রধান অ্যাটলান্টার এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টমাস ক্লাসেন অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল৷ গোটা চিত্রটা বুঝে তবেই তার সমাধান খুঁজতে হবে৷ যেমন হাইজিন সংক্রান্ত ভুল মনোভাবের পাশাপাশি সংক্রমিত জলের মতো বিষয়ও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷
বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী আজও প্রায় ৬৪ কোটি ভারতীয় খোলা আকাশের নীচে প্রাতঃকৃত্য সারেন৷ এমনকি নিজের বাড়িতে অথবা কাছাকাছি টয়লেট থাকা সত্ত্বেও অনেকে এই অভ্যাস ছাড়তে প্রস্তুত নন৷ অন্য একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বিহার, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তর প্রদেশ রাজ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবারের বাড়িতে টয়লেট থাকা সত্ত্বেও কমপক্ষে একজন সদস্য মাঠেই নিজের কাজ সারেন৷ অনেকের কাছেই এই অভ্যাস অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর৷ কিন্তু এর ফলে ডায়েরিয়ার মতো রোগে যে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটে, সে বিষয়ে সচেতনতা নেই বললেই চলে৷
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক উইলিয়াম ইস্টারলি এ প্রসঙ্গে অ্যামেরিকা সহ অন্য অনেক দেশের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন৷ তাঁর মতে, শুধু টয়লেটের মতো একটি বিষয়ের দিকে নজর দিলে চলবে না৷ সঙ্গে চাই স্থানীয় গণতান্ত্রিক প্রশাসনের স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্যোগ৷ তাঁদেরও জবাবদিহিতা থাকা চাই৷ মোটকথা উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হবে না, এমন উদ্যোগকে সফল করতে হলে তা তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসতে হবে৷