ব্রিটেনে সাবেক এক রুশ গোয়েন্দার উপর নার্ভ এজেন্ট দিয়ে হামলার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের কয়েকটি রাষ্ট্র তাদের দেশে থাকা ১০০-র বেশি রুশ নাগরিককে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
চলতি মাসের চার তারিখে সাবেক রুশ গোয়েন্দা সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়েকে ব্রিটেনের সলসবেরি শহরের এক বেঞ্চে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়৷ তাঁদের শরীরে বিষ প্রবেশ করাতে ‘নোভিচক' নামে একটি ‘নার্ভ এজেন্ট' ব্যবহার করা হয় বলে ব্রিটেনের অভিযোগ৷ এবং একমাত্র ক্রেমলিনই এর জন্য দায়ী বলেও মনে করছে ব্রিটেন৷ তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় ২২টি দেশের সরকার৷ সে কারণে সোমবার ঐসব দেশ একে একে তাদের দেশে থাকা রুশ নাগরিকদের বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়৷
১৪ মার্চ ব্রিটেন প্রথমে ২৩ জন রুশ নাগরিককে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছিল৷ তাঁরা কূটনীতিক পরিচয়ের আড়ালে গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছিলেন বলে ব্রিটেনের দাবি৷ এরপর সোমবার যুক্তরাষ্ট্র ৬০ রুশ নাগরিককে বহিষ্কারের কথা জানায়৷ এর মধ্যে ৪৮ জন দূতাবাসসহ বিভিন্ন কনস্যুলেটে কর্মরত আছেন৷ বাকি ১২ জন আছেন জাতিসংঘে৷
যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণার পর জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিশ্বের আরও প্রায় ২১টি দেশ তাদের দেশে কূটনীতিক পরিচয়ের আড়ালে কাজ করা রুশ গোয়েন্দাদের ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে৷ সবমিলিয়ে সোমবার কমপক্ষে ১১৬ জন রুশ ‘গোয়েন্দাকে' বহিষ্কারের ঘোষণা এসেছে৷
এদিকে, অস্ট্রেলিয়া রুশ গোয়েন্দাদের বহিষ্কার করা ছাড়াও রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ফুটবল বিশ্বকাপ বয়কটেরও আভাস দিয়েছে৷
পশ্চিমা দেশগুলোর এমন প্রতিক্রিয়াকে নৈতিক জয় হিসেবে দেখছে ব্রিটেন৷ ‘‘ইইউ, ন্যাটো, অ্যামেরিকাসহ অন্য বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমি দারুণ সংহতির বার্তা পেয়েছি,'' সোমবার সংসদকে জানান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে৷
এদিকে, ব্রিটেনের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে রাশিয়াও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছেন দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রায়াবকোভ৷ অবশ্য ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনার পথ এখনও খোলা বলেও জানান তিনি৷
এর আগে ব্রিটেনের ২৩ জন রুশ গোয়েন্দা বহিষ্কারের জবাবে রাশিয়াও ২৩ জন ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল৷
যুক্তরাষ্ট্রের একসঙ্গে এতজন রুশ এজেন্টকে বহিষ্কারের ঘটনা এবারই প্রথম৷ এর আগে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে ৩৫ জন রুশ নাগরিককে বহিষ্কার করেছিল বারাক ওবামা প্রশাসন৷
গোয়েন্দা সব দেশেরই আছে
মার্কিন কর্মকর্তারা সোমবার জানান, যুক্তরাষ্ট্রে ১০০-র বেশি রুশ গোয়েন্দা কাজ করছেন৷ তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন মাত্র ৬০ জনকে বহিষ্কার করা হলো? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গোয়েন্দাগিরি বিষয়টি অবৈধ হলেও এটি একটি আন্তর্জাতিক রীতি হয়ে উঠেছে৷ যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই কূটনীতিক পরিচয়ের আড়ালে বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাপাঠিয়ে থাকে৷ ‘‘শত শত বছর ধরে দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনগুলো শত্রু দেশে গোয়েন্দা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে,'' বলেন ওয়াশিংটনের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জাদুঘরের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল ক্রিস্টোফার কস্টা৷ তিনি বলেন, ‘‘সব দেশই একসময় জানতে পারে তাদের মাটিতে কারা গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করছে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের বহিষ্কার না করে গোয়েন্দাদের উপর নজর রাখাকেই শ্রেয় মনে করে দেশগুলো৷''
কস্টা বলেন, রুশ গোয়েন্দাদের খবর জানার পরও যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে বহিষ্কার না করার কারণ, তাদেরও রাশিয়ায় গোয়েন্দা আছে৷ যেহেতু পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়াও একটা ব্যবস্থা নেবে, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদেরও সে দেশ থেকে বহিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে বলে মনে করেন তিনি৷
জেডএইচ/এসিবি (এএফপি, এপি, রয়টার্স)
রাজনীতির ইতিহাসে বিষ দিয়ে হত্যার যত চেষ্টা
রাজনীতির ইতিহাসে বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা বহুবার হয়েছে – কখনো সফল, কখনো অসফল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sazonov
আলেক্সি নাভালনি
রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কট্টর সমালোচক আলেক্সি নাভালনিকে সাইবেরিয়া থেকে জার্মানিতে নেওয়া হয়েছে৷ নাভালনির শরীরে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন সমর্থকরা৷ ১৯ আগস্ট ৪৪ বছর বয়সি সাবেক এই আইনজীবী চা খাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Kudrayavtsev
সের্গেই স্ক্রিপাল
৬৬ বছর বয়সি সাবেক রুশ গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালকে ব্রিটেনের স্যালিসবেরি শহরের একটি শপিং মলের সামনে অজ্ঞান অবস্থায় একটি বেঞ্চের উপর পাওয়া যায়৷ তিনি কোনো অজ্ঞাত বিষের শিকার হয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা৷ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ এই পরিস্থিতিকে ‘দুঃখজনক’ বললেও যোগ করেছেন যে, ‘‘(ঘটনার) কারণ কী হতে পারে অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কী করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Tass
কিম জং নাম
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বৈমাত্রেয় ভাই কিম জং নাম ২০১৭ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে প্রাণ হারান৷ দৃশ্যত দুই নারী তাঁর মুখে ভিএক্স নামের একটি রাসায়নিক মাখিয়ে দিয়েছিলেন৷ মালয়েশিয়ার একটি আদালতে অভিযুক্তদের বিচার চলার সময় জানা যায় যে, আক্রান্ত হওয়ার সময় কিম জং নাম-এর পিঠের ব্যাগে ভিএক্স বিষের ডজন খানেক অ্যাম্পুল ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Kambayashi
আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো
সাবেক রুশ গুপ্তচর লিটভিনেঙ্কো দেশ ছেড়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নেবার পর সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং রাশিয়ার ফেডারাল সিকিউরিটি সার্ভিস এফএসবি ও পুটিনের বিরুদ্ধে দু’টি বই লেখেন৷ ২০০৬ সালের ২৩শে নভেম্বর দু’জন সাবেক কেজিবি কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর লিটভিনেঙ্কো অসুস্থ হয়ে পড়েন ও পরে হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন৷ সরকারি তদন্তে দেখা যায় যে, তেজস্ক্রিয় পলোনিয়াম-২১০ বিষের ক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Kaptilkin
ভিক্টর কালাশনিকভ
সোভিয়েত কেজিবি গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক কর্নেল ভিক্টর কালাশনিকভ তখন সাংবাদিক হিসেবে সস্ত্রীক বার্লিনে বসবাস করছিলেন৷ ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে কালাশনিকভ ও তাঁর স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়৷ সেখানে তাদের রক্তে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৭ ও ৫৬ মাইক্রোগ্রাম পারদ পাওয়া যায়৷ স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তে এক থেকে তিন মাইক্রোগ্রাম পারদ থাকা নিরাপদ৷পরে এক সাক্ষাৎকারে কালাশনিকভ বলেন, ‘‘মস্কো আমাদের বিষ দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/RIA Novosti
ভিক্টর ইউশ্চেঙ্কো
ইউক্রেনের বিরোধী নেতা ইউশ্চেঙ্কো ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন ও দেখা যায় যে, একটি ভাইরাল ইনফেকশন ও সেই সঙ্গে রাসায়নিকের বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটিস হয়েছে৷ এর ফলে ইউশ্চেঙ্কোর জন্ডিস হয়, মুখ ফুলে যায় এবং ত্বকে এক ধরণের দাগ থেকে যায়, যা ডাইঅক্সিন বিষের প্রভাবে ঘটে থাকতে পারে বলে চিকিৎসকদের ধারণা৷ সরকারি চররা তাঁকে বিষ দিয়েছে বলে ইউশ্চেঙ্কো দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Leodolter
খালেদ মেশাল
১৯৯৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ইসরায়েলের গুপ্তচর বিভাগ হামাস নেতা খালেদ মেশালকে হত্যা করার চেষ্টা করে৷ কথিত আছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু স্বয়ং নাকি হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ মেশাল জর্ডানের আম্মানে অবস্থিত হামাসের কার্যালয় থেকে বেরোনোর সময় দু’জন ইসরায়েলি গুপ্তচর তাঁর কানে কোনো বিষাক্ত পদার্থ স্প্রে করে৷ মেশাল অক্ষতই থাকেন এবং পরে ঐ দুজন ইসরায়েলি গুপ্তচরকে ধরাও সম্ভব হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sazonov
গেয়র্গি মার্কভ
১৯৭৮ সালে বুলগেরীয় সরকারবিরোধী মার্কভ বিবিসি-তে কাজ শেষ করে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন – হঠাৎ কিছু একটা তাঁর থাই ফুঁড়ে দেয়৷ ওদিকে মার্কভ দেখেন, এক পথচারী তার ছাতা মাটি থেকে তুলছে৷ ছুঁচ ফোটার জায়গাটা ফুলে উঠে চারদিনের মধ্যে মার্কভ প্রাণ হারান৷ ময়না তদন্ত বলে, একটি শূন্য দশমিক দুই মিলিগ্রাম রিসিন বিষের পেলেট থেকে মার্কভের মৃত্যু ঘটেছে৷ পথচারীর ছাতা থেকেই পেলেটটা ছোঁড়া হয়েছিল, বলে অনেকের বিশ্বাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/Stringer
গ্রিগরি রাসপুটিন
রুশ বিপ্লবের ঠিক আগে রাসপুটিন একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন গুনিন হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷ ১৯১৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের ইয়ুসুপভ প্রাসাদে আসেন প্রিন্স ফেলিক্স ইয়ুসুপভের আমন্ত্রণে৷ প্রিন্স ইয়ুসুপভ তাঁকে পটাসিয়াম সায়ানাইড বিষ মাখানো কেক খেতে দেন ও সায়ানাইড মাখানো পাত্রে সুরা পরিবেশন করেন৷ সেই বিষাক্ত কেক ও সুরা থেকে রাসপুটিনের কিছুই হয় না৷ অতঃপর রাসপুটিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷