বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন চেষ্টা করেও কোন ফল পাচ্ছেনা৷ কারণ কমিশন সুপারিশ ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা৷ কমিশনের চেয়ারম্যান ডয়চে ভেলের কাছে এই অসহায়ত্বের কথা স্বীকার করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরও বাংলাদেশে ৩০ জনকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে৷ আর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে৷ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলিসহ ১০ জনকে গুমের অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে৷ এছাড়া রাজিনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, নারীর প্রতি সহিংসতা, সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় ও বাড়িঘরে হামলা, কারখানায় আগুনে শ্রমিকদের মৃত্যুসহ বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে৷ গত ডিসেম্বর থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি বিরোধী দলের সভা সমাবশে পুলিশ এবং সরকার সমর্থকদের হামলার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে৷
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
অ্যামনেষ্টির প্রতিবেদনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন৷ তাঁদের কমিশন এরকম অনেক ঘটনা তদন্ত করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের সুপারিশও করেছেন৷ কিন্তু তাদের সুপারিশে তেমন কোন কাজ হয়নি৷ তিনি বলেন, সুপারিশ করা ছাড়া তাদের তেমন কিছু করার নেই৷ ফলে তাদের সুপারিশ কার্যকর হয়না৷ তিনি মনে করেন, সরকার যদি তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করে এবং তাদের জবাবদিহিতা থাকে, তাহলে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব৷
তিনি আরও বলেন, সরকারকে অবশ্যই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে হবে৷ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘুরা রাজনৈতিক কারণে ব্যাপকভাবে নির্যাতনে শিকার হয়েছেন৷ যারা করেছে, তাদের শাস্তি দিলেই চলবেনা৷ নির্যাতিতদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে৷
ড. মিজান বলেন মানবাধিকারের সঙ্গে রাজনৈতিক পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা নিবিড়ভাবে জড়িত৷ তাই বিরোধী দলকে যেমন দমন করা যাবেনা, তেমনি বিরোধী দলকেও সহিংসতা পরিহার করতে হবে৷ তা না হলে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার রক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে৷
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানবাধিকার কমিশনকে কার্যকরভাবে কাজ করতে দিতে হবে৷ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হলে কমিশন যতই কথা বলুক, তাতে কাজের কাজ কিছু হবেনা৷ তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশনের মামলা করার ক্ষমতা আছে সত্য৷ তবে মামলা পরিচালনা করার লোকবল কমিশনের নেই৷ আর কমিশন মামলা করতে গেলে তাদের শুধু তাই নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে৷ তাঁর মতে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জবাবদিহিতাই পারে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমাতে৷